ছিল না ফুটবল কেনার সামর্থ্য, মোজা দিয়েই বল বানিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন পেলে
Pele Death : আসলে পেলে মানেই ফুটবল, আর ফুটবল মানেই পেলে। এই প্রবাদ বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অমর হয়ে থেকে গিয়েছে।
মিনাস গেরায়েসের ত্রেস কোরাকোয়েসের রাস্তা দিয়ে আজও একদল তরুণ ফুটবল খেলতে খেলতে বাড়ি ফিরে যায়। যত্নে সাজিয়ে রাখে বুট, জার্সি। সমস্ত কাজ শেষের পর এই ফুটবলই যে লড়াইয়ের মন্ত্র। ১৯৪০-৫০ এর দশকেও পরিস্থিতিটা আলাদা ছিল না। হয়তো মানুষগুলো পকেট আরেকটু খালি ছিল। সেই সময় রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াত এক দঙ্গল স্থানীয় ছেলে। পায়ে জুতো নেই, চামড়ায় নেই ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু সঙ্গে আছে লড়াইয়ের অস্ত্র – ফুটবল। খালি পায়েই বিশ্বজয় করার স্বপ্ন। ‘বীরপুরুষ’-এর মতো দিনের শেষে বাড়িতে ফিরে আসা… “আমি আছি ভয় কেন মা করো”।
সেই দঙ্গলের মধ্যেই একটি ছেলের দিকে বারবার নজর পড়ত ত্রেস কোরাকোয়েসের পথচলতি বাসিন্দাদের। ওর বাবা ডডিনহোরও ইচ্ছে ছিল ফুটবলার হওয়ার, কিন্তু বিধি বাম! সংসারে হাঁড়ির হাল, বাধ্য হয়ে স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে টাকা উপার্জনের পথে নামতে হয়। বাবাকে সাহায্য করার জন্য ছোট বয়সেই কাজে নেমে পড়তে হয় ওই ছেলেটিকে। ওর নাম এডসন আরান্তেস দে নাসচিমেন্তো (Edson Arantes de Nascimento)। সংসারে সাহায্য করতে অল্প বয়সেই স্থানীয় চায়ের দোকানে কাজ করতে শুরু করে এডসন।
কিন্তু ফুটবল? সেটা তো ওই ছেলেটিরও স্বপ্ন! এরপর দিন গড়াবে অনেক, অ্যামাজন দিয়ে জল গড়াবে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবে, চাঁদে পা রাখবে মানুষ। আর এতো সব ঘটনার মধ্যে ব্রাজিলের ছোট্ট এই জায়গা থেকে একটা ছেলে লম্বা একটা লাফ দেবে। বাইসাইকেল কিকের জোরে হারিয়ে যাবে ‘এডসন আরান্তেস দে নাসচিমেন্তো’ নামটি। বদলে জ্বলজ্বল করবে একটাই নাম, একটাই পরিচয়, একটাই শিরোপা – পেলে।
আরও পড়ুন : স্তব্ধ হল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের জীবন! যে কারণে পেলে আসলে অমর…
সাও পাওলোর হাসপাতালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইটা ততক্ষণে শেষ হয়েগিয়েছে। সেই দস্যি ছেলেটা, বল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করা সম্রাট নিজের বিছানায় চোখ বুজেছেন। আর উঠবেন না তিনি, জেনে গিয়েছে বিশ্ব। সেই সময় ব্রাজিলের আরেক তারকা নেইমার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেন। ‘আগে ১০ নম্বর জার্সিটি স্রেফ একটি সংখ্যা ছিল। পেলে এসে সেই সংখ্যাটাকে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিলেন।’ আসলে পেলে মানেই ফুটবল, আর ফুটবল মানেই পেলে। এই প্রবাদ বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অমর হয়ে থেকে গিয়েছে। সম্রাট তো আসলে একজনই। কেউ কি তাঁর জায়গা নিতে পারে?
কেবল ফুটবলার নন, বিশ্বের উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন পেলে। যতবারই বল পায়ে এগিয়ে যেতেন, ড্রিবল আর সাম্বার জাদু মিলেমিশে উজ্জ্বল হয়ে উঠত স্টেডিয়াম, পেলের মনে পড়ত ছোটবেলার সেই দিনগুলো। সংসারে তখন হাঁড়ির হাল। খেলার জন্য বুটটুকুও ছিল না। চায়ের দোকানে কাজ করতে করতে স্বপ্ন দেখতেন, একদিন ওই হলুদ জার্সি পরব। কিন্তু কীভাবে? জানতেন না পেলে, কেবল খেলেই যেতেন। পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ছোট্ট একটি দল। ‘দ্য শুলেস ওয়ানস’। ছেলের এই উৎসাহের মধ্যে নিজের স্বপ্নও খুঁজে পেতেন বাবা ডোডিনহো। তিনিই ছিলেন পেলের প্রথম কোচ, মেন্টর।
কিন্তু স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে বাধা যে অনেক! খেলার জন্য প্রধান জিনিসই হল ফুটবল। সেটাই তো নেই পেলের কাছে! ঘরে সামান্য খাওয়ার টাকাও নেই, ফুটবল কিনবেন কী করে! সে তো অনেক দূরের তারা! শেষমেশ নিজেই নিজের রাস্তা খুঁজে নিলেন ছোট্ট পেলে। বাড়িতে পড়েছিল প্রচুর খবরের কাগজ। এপাশ ওপাশ থেকে আরও কিছু কাগজ এনে ভালো করে মুড়িয়ে তৈরি করা হল বড়ো গোলাকার একটা পিণ্ড। তারপর জোগাড় করা হল বাতিল, ফেলে দেওয়া মোজা। সেগুলোকে জড়ো করে একসঙ্গে জোড়া হতো। ব্যস, ফুটবলের মতোই কিছু একটা তৈরি তো হল! সেটা দিয়েই চলত প্র্যাকটিস। লড়াই, লড়াই এবং লড়াই। পেলে হওয়ার রাস্তা কি এতই সহজ?
আরও পড়ুন : কলকাতায় এসে ম্যাচ ড্র! মোহনবাগানের গোলরক্ষককে তবু বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন পেলে
শুধু চায়ের দোকানের সামান্য ক’টা টাকায় কি সংসার চলে? আচ্ছা, যদি ফুটবলই টাকা কামানোর উপায় হয়? শুরু হল খেপ খেলা। বিভিন্ন দলের হয়ে ছোটবেলায় ফুটবল খেলেছেন পেলে। ভাগ্যিস খেলেছিলেন! কারণ সেখান থেকেই তাঁর স্বপ্নের উত্থান শুরু। যে দলগুলির হয়ে খেলতেন, সেরকমই একটি দলের কোচ ছিলেন ওয়ালদেমার দে ব্রিতো। ব্রাজিলের জাতীয় দলের প্রাক্তন সদস্য তিনি। পেলের খেলা দেখে একটু অবাকই হলেন। প্রথাগত ফুটবল কোচিং নেই, ঠিকঠাক ফুটবলও সঙ্গে নেই, বুটও নেই। অথচ এই ছেলে তো সবাইকে ঘোল খাইয়ে রেখে দিচ্ছে! এক মুহূর্তও দেরি করলেন না তিনি। সোজা চলে গেলেন ব্রাজিলের বিখ্যাত স্যান্তোস এফসি ক্লাবে। সেখানে গিয়ে কেবল একটা কথাই বললেন তিনি – He is destined to be the greatest footballer in the world. বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হওয়ার মতো প্রতিভা আছে এই ছেলেটির মধ্যে।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্যান্তোস ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতে নেমে পড়েন পেলে। তারপর? বিশ্ব ফুটবলের অমর এক রূপকথার জন্ম। প্রথম মরসুমেই দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা পেলে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক এল ব্রাজিলের জাতীয় দল থেকে। সেই হলুদ জার্সি… সেই স্বপ্ন… মুখোমুখি হচ্ছেন পেলে। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দিগন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবার তিনি সেরা নন, সেরাদের সেরা হতে চান। ফুটবল তাঁর কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র, লড়াইয়ের অস্ত্র। ব্রাজিলের রাস্তায় খালি পায়ে খেলতে খেলতে যে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ফুটবল দিয়ে বদলে দেওয়া যায় পৃথিবী, বদলে যায় ভাগ্য – মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন পেলে।
১৯৫৮ সাল যেন স্বপ্নের বছর। সুইডেনে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পৌঁছলেন পেলে। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে তাঁর আগমন। স্বাভাবিকভাবেই সবার নজর এই ছেলেটির দিকে। কিন্তু হঠাৎই হাঁটুতে চোট। তীরে এসে তরী ডুববে এবার! পেলের ভেঙে পড়া চেহারার পাশে এসে দাঁড়ালেন ব্রাজিলের সতীর্থরা। না, এই ছেলেটাকে এভাবে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। চোট সারিয়ে ফেরার পর ফুটবল মাঠ যা দেখল, তা বোধহয় রূপকথাই। সেমি ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক, তারপর ফাইনালে সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারানো। ব্রাজিলের প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক তিনি। কতই বা বয়স, ১৭ বছর!
আরও পড়ুন : তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয়! ফিরে দেখা ‘হ্যাট্রিকের রাজা’ পেলের জীবনের সেরা ম্যাচগুলি
এরপর আরও দুটো বিশ্বকাপ হাতে তুলবেন তিনি। ১২৮১ টি গোলের রেকর্ড তৈরি করবেন। শুধুমাত্র পেলেকে দেখার জন্য উপচে পড়বে ময়দান। স্বয়ং ফিফা বলে দেবে, পেলেই হলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার। কেবলমাত্র গায়ের জোরে নয়, ফুটবল যে একটি সুন্দর খেলা, একটি শিল্প, পেলে না থাকলে সেটা বুঝতে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যেত। জীবনের শেষদিনগুলোও হয়তো সম্রাটের মনে পড়বে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ জেতার পর সেই কান্না। পেলে কেবল ফুটবল নন, পেলে একটি প্রতিবাদের নাম। একটি উত্তরণের নাম। তৃতীয় বিশ্বের সর্বহারা এক ছেলের ঈশ্বর হওয়ার নাম।