পরকীয়ায় লিপ্ত মাদাম কুরি! দু'বার নোবেল জয়ের পরও এই বিজ্ঞানীকে ছাড়েনি আমজনতার ঘৃণা
Nobel Laureate Marie Curie Life : এত ঝড়ঝঞ্ঝার পরেও মাথা উঁচু করেই কাজে ফিরলেন মেরি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ভবন তৈরির কাজ শুরু হল।
সময়টা ১৯১১ সাল। সেই প্রথম কেউ দ্বিতীয়বার নোবেল পেলেন। তিনি একজন মহিলা পদার্থবিদ, নাম মেরি কুরি।
নোবেল কমিটি চিঠি লিখে পরামর্শ দিল, তিনি যেন প্যারিসের ‘ঘটনা-প্রবাহ’ থামার আগে নোবেল পুরস্কার নিতে স্টকহোমে না যান। চিঠি পেয়ে কয়েকদিন ভাবলেন মেরি। প্রথমবার নোবেল পাওয়ার পর অসুস্থতার জন্য পিয়ের বা মেরি কেউই যেতে পারেননি। যদিও ১৯০৫ সালে তাঁরা স্টকহোমে গিয়ে নোবেল কমিটির সংবর্ধনা নিয়ে এসেছিলেন, নোবেল-বক্তব্যও পেশ করেছিলেন পিয়ের। কিন্তু এবার কেন যাবেন না মেরি? তিনি তো কোনও অন্যায় করেননি! মিডিয়ার ভয়ে ঘরে বসে থাকবেন? মেরি নোবেল কমিটিকে জানিয়ে দিলেন– তিনি ডিসেম্বরে স্টকহোমে যাচ্ছেন নোবেল পুরস্কার নিতে। ডিসেম্বরের ৮ তারিখ বড় মেয়ে আইরিন ও বড় বোন ব্রোনিয়াকে সাথে নিয়ে স্টকহোমে পৌঁছলেন মেরি। ১০ তারিখ নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করলেন সুইডেনের রাজা গুস্তাভের হাত থেকে। ১১ তারিখ স্টকহোম কনসার্ট হলে নোবেল বক্তব্য রাখলেন মেরি কুরি। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারে তাঁর পাশাপাশি যে পিয়েরও সারাক্ষণ ছিলেন তা বলতে ভুললেন না তিনি।
মাদাম কুরি সেবার রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পাচ্ছেন— নোবেল কমিটির এই ঘোষণার পরেও ফরাসি মিডিয়ার লাগাতার আক্রমণ কিন্তু বন্ধ হল না। কারণ তার ঠিক আগেই তাদের হাতে এসে পড়েছিল আরও গরম রসালো গল্প, সদ্য স্বামী হারা মেরি কুরির 'প্রেমকাহিনি'। সে কেচ্ছার ঝড়ের চোটেই নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে চিঠি দিয়ে গরহাজির থাকার অনুরোধ। অসাধারণ সেই সাফল্য ফ্রান্সের আমজনতার বিষনজর থেকে মুক্ত করতে পারেনি মাদাম কুরিকে। স্বামী পিয়ের কুরির মৃত্যুর পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন। তারপর থেকেই ক্রমশ পদার্থবিজ্ঞানী পল লঁজেভঁ-র সম্পর্কের শুরু। পল ছিলেন পিয়েরের ছাত্র, মেরি কুরির চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। উপরন্তু বিবাহিত ও চার সন্তানের পিতা। পলের সান্নিধ্যে মেরি জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। দুই বিজ্ঞানীর বন্ধুত্ব প্রেমের ঘনিষ্ঠতায় আরও গাঢ় হল। সেই ‘তেজস্ক্রিয়’ প্রেম আমজনতা, মিডিয়া আর নীতি-পুলিশদের লাগামছাড়া আক্রমণে সমাজের চোখে যেন এক জঘন্য অপরাধ হয়ে উঠল। কুৎসা আর ঘৃণার আগুনে দু'জনে পুড়তে শুরু করলেন।
মেরির কর্মক্ষেত্র সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই অন্য নাম নিয়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন পল। সেখানেই আসতেন কিংবদন্তি এই বিজ্ঞানী। একসঙ্গে সময় কাটাতেন। পল-কে বেশকিছু চিঠিও লিখেছিলেন। আবেগঘন সেসব লেখায় ছিল অনেক অন্তরঙ্গ বিষয়। কিন্তু পলের স্ত্রী জেনি-র কাছে আচমকাই চলে আসে সেই চিঠিপত্র। ব্যাস, কিছুই আর গোপন থাকল না। যথারীতি সমস্ত চিঠিপত্র জেনি হস্তগত করলেন। এবং ক্রোধে-আক্রোশে ফেটে পড়লেন। পরে মেরির ওপর চড়াও হয়ে তাঁকে খুনের হুমকিও দিয়েছিলেন রাগের চোটে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারানো জেনি।
তারপর সমস্ত কাহিনি চলে এল সংবাদমাধ্যমের হাতে। যে খবরটুকু সত্য, সেটিই নাকি তুমুল চাঞ্চল্যকর। তার ওপর কিছু রং চড়ানোও শুরু হল। কাগজে ফলাও করে কিস্তির পর কিস্তি ছাপা হতে লাগল কুরি-লঁজেভঁ রগরগে পরকীয়ার কাহিনি। এরপর প্রকাশিত হল পলের স্ত্রী আর শাশুড়ির সাক্ষাৎকার। কাগজে ছাপা হতে লাগল সেই সব ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও। তারও আগে অবশ্য মেরির মধ্যনাম সামনে এনে এই কথাও রটানো হয়েছে, তিনি নাকি ইহুদি, প্রকৃত ফরাসি নন। আর উন্মত্ত ফরাসি জনতা তখন তাঁর শাপশাপান্ত করছে। তাদের মোদ্দা কথা, অন্যের সংসারে ভাঙন ধরিয়েছেন দুষ্ট বিদেশি মেরি। মার্কিন কাগজেও তত দিনে উঠে এসেছে নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কেচ্ছা। দক্ষিণপন্থী সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি আক্রমণ করলেন আরও নগ্ন, হিংস্র ভঙ্গিতে। যেন হাল আমলের মত টেরি ব্রেকিং নিউজ দিলেন, পিয়েরের মৃত্যুর আগে থেকেই নাকি মারি-পলের গোপন প্রেমলীলা চলে আসছে!
আর সে কথা জানতে পেরে ঘোড়ার গাড়ির তলায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন পিয়ের! এই ভয়ানক ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতো খবরের ইন্ধনে উত্তেজিত জনতা ফেটে পড়ল মেরির বাড়ির সামনে। ঘেরাও করে চলল বিক্ষোভ, তাণ্ডব। তাঁর উদ্দেশে স্লোগান, অশ্রাব্য গালাগাল। সন্তানদের নিয়ে তখন ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন নোবেলজয়া পদার্থবিদ। সবদিক থেকে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। কাজ-গবেষণা খুইয়ে এবার বোধহয় দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবার টেরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন লঁজেভ। ডাক দিলেন খোলাখুলি দ্বন্দ্বযুদ্ধের। ডুয়েল লড়তে চাইলেন তিনি মুখোমুখি সাংবাদিক ও বিজ্ঞানী— দু'জনের হাতেই পিস্তল! শেষমেশ সেই ডুয়েলে গুলি বিনিময় হয়নি কিন্তু টেরি পরে কাগজে লিখলেন তিনি চাইলেই লঁজেভকে ডুয়েলে হারাতে পারতেন, কিন্তু দেশ একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানীকে হারিয়ে ফেলুক সেটা তিনি চাননি।
১৯১১ সালের ডিসেম্বরে স্টকহোম থেকে ফিরে মেরি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। দিনরাত তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে মেরির শরীরের অনেকগুলো কোষ মারা গেছে। তাঁর লিভার মারাত্মক রকমের ক্ষতিগ্রস্ত। ১৯১২ সালে তাঁর অপারেশান করাতে হল। মিডিয়াকে এড়ানোর জন্য হাসপাতালে নিজের নাম ব্যবহার না করে স্ক্লোদভস্কা নামে কেবিন বুক করেছিলেন। সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত গোপন রাখা হল মেরির অবস্থান। কিন্তু কিছু সাংবাদিক দিনকে রাত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। মেরি সিক-লিভ নিয়েছেন শুনে এবং প্যারিসের কোন হাসপাতালে মেরির হদিস না পেয়ে একদল সাংবাদিক লিখতে শুরু করলেন– মেরি লাঁজেভ’র অবৈধ সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন– তাই গোপনে গর্ভপাত করাতে গেছেন।
এত ঝড়ঝঞ্ঝার পরেও মাথা উঁচু করেই কাজে ফিরলেন মেরি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ভবন তৈরির কাজ শুরু হল। ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় সল্ভে কনফারেন্সে যোগ দিতে গেলেন ব্রাসেল্সে। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ শেষ হল। মাদাম কুরি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। শোনা যায়, এই লাগাতার আক্রমণের ফলে একসময় ভীষণ রকম অবসাদগ্রস্থ বয়ে পড়েন তিনি। আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেন। কিন্তু তাঁর নিরন্তর গবেণার কাজে কোনও ছাপ ফেলতে দেননি। অসংখ্য গবেষক তৈরি হয়েছেন এই রেডিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে। তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। পলের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট ছিল বাকি জীবনে, কিন্তু ভালবাসার সেই দিনগুলো আর ফিরে আসেনি দুবার নোবেল পাওয়ার মত অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী মাদাম কুরির। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৩৪ সালের জুলাইয়ে অসাধারণ এই পদার্থবিদের মৃত্যুর পর দেহটি কফিনে ভরে কবর দেয়া হয় প্রয়াত স্বামী পিয়ের কুরির কবরের উপরেই।
তথ্যসূত্র - মাদাম কুরি - শ্যামল চক্রবর্তী
Marie Curie - Robert Reid
মেরি কুরির রেডিয়াম ভালবাসা - প্রদীপ দেব