বিশ্বকাপে তাঁর গলার জাদুতে মুগ্ধ মেসি-এমবাপে, পিটার ড্রুরি যেন মাইকের সামনে শব্দের পিসি সরকার

Peter Drury Commentary World Cup : মাঠে জাদু দেখাচ্ছেন লিওনেল মেসি; অন্যদিকে কমেন্ট্রি বক্সে ফুল ফোটাচ্ছেন আরেক জাদুকর। শব্দের জাদুকর, পিটার ড্রুরি

“Messi's hit. Ohhh! That's what they came for. The Magic man. One more Messi moment and Argentina are alive. They give thanks that he is one of them. How often have they said that prayer of thanks. How often have we seen those bright wide eyes. How often have we seen in the faces of opponents, the dismay, that he should come and scar them”

২৭ নভেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণা যেন ফেটে পড়ছিল সিংহ বিক্রমে। ক্যামেরা বারবার চলে যাচ্ছিল গ্যালারিতে থাকা এক তরুণের দিকে। তাঁর চিৎকার, তাঁর ছলছল চোখ, মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন সমস্ত বাধা ছিঁড়ে আরও ওপরে যেতে চাইছে। ম্যাচের তখন ৬৪ মিনিট। দি মারিয়ার পাস থেকে লিওনেল মেসির গোলটি যেন অক্সিজেনের নামান্তর। সেইসঙ্গে চ্যানেলে চলছে ওপরের ইংরেজি অংশটি। ‘Argentina are alive’ – যেন চরণামৃতের মন্ত্র হয়ে আছড়ে পড়ল লুসাইল স্টেডিয়ামে। আছড়ে পড়ল বুয়েনস আইরেসের ছোট্ট পাবে, ড্রয়িং রুমে। মাঠে জাদু দেখাচ্ছেন লিওনেল মেসি; অন্যদিকে কমেন্ট্রি বক্সে ফুল ফোটাচ্ছেন আরেক জাদুকর। শব্দের জাদুকর, পিটার ড্রুরি (Peter Drury)…

২০২২-এর বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022) স্মরণীয় করে রেখেছেন এমবাপে, মেসি, মদরিচদের মতো খেলোয়াড়রা। স্মরণীয় করেছে মরক্কো, জাপানের লড়াই। দেখেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লুই সুয়ারেজের কান্না। এসবের মধ্যেও নিজের গলা দিয়ে, শব্দ দিয়ে ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন পিটার ড্রুরি। মরা পিচে ফুটিয়ে দিলেন কবিতার ফুল। ভারতীয়দের মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০১১-র আইসিসি বিশ্বকাপের কথা। ক্রিকেট বিশ্বকাপের কমেন্ট্রিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন রবি শাস্ত্রী, হর্ষ ভোগলেরা। সেই কাজটি বহুদিন ধরেই ফুটবল কমেন্ট্রির জগতে করে যাচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ কমেন্টেটর। অনেকের মতে, ফুটবল কমেন্ট্রির জগতে সর্বকালের অন্যতম সেরা মানুষটিকে দায়িত্ব দিয়ে কোনও অন্যায় করা হয়নি। বরং সেটাই বিশ্বকাপকে অন্য আঙ্গিক দিয়েছে।

আরও পড়ুন : মেসির বিশ্বকাপ জেতার মুহূর্তে কত মানুষ মেসেজ করেছেন? সর্বকালের রেকর্ড যেভাবে ভাঙল হোয়াটস্যাপ

রূপকথার বাইরে অত্যন্ত সাদামাটা একজন মানুষ তিনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন বহুদিন হয়ে গেল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা কনফারেন্স লিগ সহ আরও প্রতিযোগিতায় কমেন্ট্রি বক্সে তাঁকে দেখা গিয়েছে। বাড়ি থেকে স্টেডিয়াম, তারপর ফের বাড়ি, নিজের পরিবারকে সময় দেওয়া – খুব একটা লাইমলাইটে দেখা যায় না তাঁকে। ১৯৯০ সালে বিয়ে করেন ভিকি ড্রুরিকে। সেই ইনিংস এখনও চলছে। ফুটবল না খেললেও, তাঁর শব্দ যেন মাঠের প্রতিটি কোণায় ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

একটানা বাক্য নয়; বরং থেমে থেমে, গলার ওপর জোর দিয়ে, শব্দ খেয়াল করে যেন সূক্ষ্ম শিল্প তৈরি করেন পিটার ড্রুরি। কমেন্টেটরদের দুনিয়ার অন্যতম বাদশা এমনি এমনি বলা হয় না তাঁকে। খুব সাধারণ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন না তিনি। প্রতিটা ক্ষেত্রে সেখানে কবিতার ছোঁয়া থাকে। থাকে একটা ঘোর, যা ওই মুহূর্তকে বর্ণনা করে। খেলার মধ্যেও ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ খুঁজে দর্শকদের সামনে রাখেন পিটার।

মাথায় আসছে ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বির কথা। ২০১১ সালের প্রিমিয়ার লিগের যে ম্যাচে বাই সাইকেল কিকে অবিশ্বাস্য একটি গোল করেছিলেন ওয়েন রুনি। তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্ত হয়ে দাঁড়ায় ওই গোলটি। সেইসঙ্গে ভাসতে থাকে পিটার ড্রুরির কমেন্ট্রি। মাত্র কয়েকটি শব্দ, “What a goal, at what a time, in what a place, what a player”… স্রেফ গলার ব্যবহারে ওই মুহূর্তটাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেলেন।

আরও পড়ুন : রোনাল্ডোর গোপন খাবার থেকে ক্রোয়েশিয়ার ‘সেক্সিয়েস্ট ফ্যান’, বিশ্বকাপ রঙিন হয়ে থাকল যে ঘটনায়

কিংবা ২০১০ সালের বিশ্বকাপ। আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবার বিশ্বকাপের আয়োজন। ঐতিহাসিক মুহূর্তে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে খেলতে নামল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারপরই ৫৩ মিনিটে দুরন্ত প্রতি আক্রমণে দক্ষিণ আফ্রিকার শাবালালার গোল। আফ্রিকান সিংহদের গর্জন গোটা স্টেডিয়ামে শোনা গেল। চরম মুহূর্তে কমেন্ট্রি বক্সে ফের ফুল ফোটালেন পিটার ড্রুরি। “Goal for South Africa. Goal for all Africa.” কালো মানুষদের জয়গাথা, আফ্রিকার জয়গাথা। তাঁরাও তো পারেন! তাঁরাও ক্ষমতাবানদের উড়িয়ে দিতে পারেন। শাবালালার গোল আর পিটার ড্রুরির কবিতা যেন জুড়ে দিল সেই লড়াইকে। এই গোল শাবালালার নয়, এই গোল গোটা আফ্রিকার প্রত্যুত্তর।

ফুটবলের ঘাসে ঘাসে লেগে থাকা তাঁর কমেন্ট্রির জাদু বলতে গেলে সময় গিড়িয়ে যাবে। বরং দেখা যাক এই বিশ্বকাপের মুহূর্তগুলো। কাতারে সবাইকে ছাপিয়ে নিজেদের মেলে ধরেছে মরক্কো। হাকিমি, আমরাবাতরা তৈরি করেছেন নতুন রূপকথা। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে শক্তিশালী বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয়ে তাদের চোখে চোখ রেখে খেলে গিয়েছে। ২-০ গোলে পরাস্তও করেছে। ম্যাচের তখন ৯২ মিনিট। এক গোলে পিছিয়ে বেলজিয়াম। জেতার দোরগোড়ায় মরক্কো। সেই সময় ফের একবার কেঁপে উঠল বেলজিয়ামের জাল। মরক্কোর আবুখলা গোল দেওয়ার পর পিটার ড্রুরি তুলে ধরলেন মরোক্কান স্বপ্নকে। “Moroccan mayhem. Drink it in. Casablanca, Relish it, Rabat! This is your night!” সত্যিই সেই রাত মরক্কোর স্বপ্নের রাত। যে স্বপ্ন গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে ছড়াবে তারা।

কিংবা ব্রাজিলের রিচার্লিসনের সেই বাই সাইকেল কিক। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচে এমন সাম্বার জাদু দেখতেই তো রাত জেগেছিল সবাই। গোটা মুহূর্তকে মাত্র কয়েকটি শব্দে ধরলেন পিটার ড্রুরি; “Richarlison! Now that’s… that is Brazil!” অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর ফের বললেন, “That’s what they are here for. They shine.” পিটার ড্রুরির কথা যেন লেগে থাকল “The famous Yellow Shirt”-এর সঙ্গে। লেগে থাকল সেই অবিশ্বাস্য সুন্দর গোলটির সঙ্গে।

আরও পড়ুন : মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার? বিশ্বকাপ কি অবসান ঘটাল এই বিতর্কের

আর মেসি? তাঁর গোল মানে পিটার ড্রুরি নিজের রূপকথার ডালি উজাড় করে দিয়েছেন। হাজারতম ম্যাচে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া। ম্যাক অ্যালিস্টারের পাস থেকে মেসির নিখুঁত ছবির মতো গোল। রেমব্র্যান্টের তুলির শেষ আঁচড়টি দিলেন ড্রুরি। “A thousand games and still he excels. There'll never be another like him. Enjoy him while he is here.” আর শেষমেশ ফাইনালের সেই মহাকাব্য। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচটি খেলার পর সেরাদের স্বর্গ স্পর্শ মেসির। “Scaloni will be fated Messi will be sainted… Lionel Messi has conquered his final peak. Lionel Messi has shaken hands with paradise. The little boy from Rosario Santa Fe has just pitched up in heaven.” মহাকাব্যের ওপর সোনালি রেখা ছড়ালেন পিটার ড্রুরি। শব্দচয়ন, গলার ওঠানামা, পজের খেলা - কমেন্ট্রি বক্সে তিনি নিজেও যেন খেলছেন। লড়ছেন নিজের জন্য। খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুগলবন্দীতে ফোটাচ্ছেন রাতের তারা। লুসাইল স্টেডিয়ামের আকাশে তখন ভ্যান গঘের স্টারি নাইটের আলো। মেসি, এমবাপের সঙ্গে যেখানে গোপনে তুলি বুলিয়েছেন পিটার ড্রুরি। সমালোচকদের একাংশের মতে, দ্য গোট অফ কমেন্ট্রি পিটার ড্রুরি। 

More Articles