প্লেগের কারণেই হু হু করে বাড়ছে আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি! বিজ্ঞানীদের গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য
Rise in Diabetes and Arthritis: যাঁরা সেই সময় মারা গিয়েছিলেন তাঁরা তো বটেই, যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরাও নিজেদের দুর্বল ইমিউনিটি জিনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করেছেন।
আমরা সকলেই জানি যে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় প্লেগ মহামারিতে কয়েক কোটি মানুষ মারা যান। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দেখা দেওয়া এই অতিমারি মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সংক্রামক এক অতিমারি ছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউরোপের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ এই বিউবনিক প্লেগে মারা যায়। গবেষকদের মতে, এই প্লেগের সূত্রপাত ১৩৩০-এর দশকে মধ্য এশিয়ার কিরজিস্তানে। সেই অতিমারির কারণে মারা যাওয়া মানুষদের এখানে কবরস্থানগুলোতে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এই কবরস্থানের সমাধিফলকগুলোয় মৃত্যুর তারিখও লেখা আছে। সেই থেকেই আনুমানিক একটি সময় সম্পর্কে ধারণা পান বিজ্ঞানীরা। সেখানে গবেষণা করতে গিয়ে দু'টি কবরস্থান থেকে মৃতদের দাঁতের নমুনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। বিউবনিক প্লেগের কারণে মৃত্যু হলে তাকে ব্ল্যাক ডেথ বলা হয় কেননা এই রোগে হাতের আঙুল এবং পায়ের আঙুল কালো হয়ে যায়।
স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টার্লিং, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ও ইউনিভার্সিটি অব টিউবিনজেনের গবেষণা দল ৭টি কঙ্কালের দাঁত থেকে ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করেছে। সেই ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁরা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু তথ্য পেয়েছেন। তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস-সহ একাধিক সংক্রামক রোগ আমাদের দেহে ফিরে আসতে পারে ব্ল্যাক ডেথের কারণে। লন্ডন ও ডেনমার্কে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সময় ব্ল্যাক ডেথের কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাঁত থেকে নেওয়া ৫১৬টি ডিএনএ নমুনার উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বিজ্ঞানীরা। এই তথ্য সামনে আসতেই হইচই পড়ে গেছে বিশ্বজুড়ে।
বিউবনিক প্লেগ গোটা ইউরোপ জুড়ে কেমন তাণ্ডব চালিয়েছিল কথা কারও অজানা নয়। গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহরকে শ্মশানে পরিণত করেছিল ব্ল্যাক ডেথ। এই রোগের কারণে গোটা ইউরোপ সহ বিশ্বের অনেকাংশে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে এবং এভাবেই বিবর্তন হয়েছে মানব সভ্যতার। ফলত অদূর ভবিষ্যতেই যদি আরও একটি কোভিড-১৯ আসে এবং আমরা মৃত্যু মিছিল দেখতে পাই তাহলে তা অবাক করার কিছু নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, যাঁরা সেই সময় মারা গিয়েছিলেন তাঁরা তো বটেই, যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরাও নিজেদের দুর্বল ইমিউনিটি জিনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করেছেন।
আরও পড়ুন- করোনার পর কোন ভাইরাস? অতিমারীর ভয়াল দিন ফেরাচ্ছে জলবায়ুর ভোলবদল?
এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অন্টারিওর ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির প্রবাদপ্রতিম জিনতত্ত্ববিদ এবং প্রফেসর হেন্ড্রিক পোয়নার বলেছেন, “যে মহামারিতে কোনও দেশের জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মারা যায়, বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মহামারির কারণে মানুষের জিনে মিউটেশন দেখা যাবে। এই সকল মানুষের জিনে প্রতিরক্ষামূলক মিউটেশন হবে এবং তারা প্যাথোজেনের প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারবে। আর স্বাভাবিকভাবেই যারা সামলাতে পারবে না তারা মারা যাবে। এহেন পরিস্থিতিতে আপনার বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া নির্ধারণ করে আপনার জিনের মিউটেশনের ধরন। তবে এই রোগের সঙ্গে লড়তে গিয়ে মানুষের ইমিউনিটি দুর্বল হয়েছে। বিগত ২-৩ প্রজন্মের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্তত ১০ থেকে ২০ শতাংশ কম। এত বড় পরিবর্তন মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেখা গিয়েছে বলে মনে করা যায় না।”
এই জেনেটিক মেকানিজম নিয়ে বিজ্ঞানী জেমস লী একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে আমাদের ডিএনএর বিভিন্ন অংশ শরীরে রোগের প্রাদুর্ভাবকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই রিজিয়ন বা অংশগুলি তৈরি হয় কীভাবে? বিজ্ঞানী জেমস লীর মতে, এই প্লেগ অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষের জিনের কিছু বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তন তৎক্ষণাৎ বোঝা না গেলেও দীর্ঘ সময়ে এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে। এই পরিবর্তন বা মিউটেশনের ফলেই মানুষের জেনেটিক মেকানিজমের পরিবর্তন হয়েছে এবং ইমিউনিটি সিস্টেম আরও দুর্বল হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে যে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে, তা বলার মতো সময় এখনও আসেনি। তবে জেমসের মতে, মানুষের জেনেটিক মিউটেশনের জন্য একটি আদর্শ পরিস্থিতি ছিল বিউবনিক প্লেগ অতিমারি।
আরও পড়ুন- জীবনযাত্রায় ছোট্ট একটা বদল! তাতেই ম্যাজিকের মতো সারবে ডায়াবেটিস
১৩৪৬ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ব্ল্যাক ডেথ কয়েক কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, সেই সময় এই প্লেগটি ছড়িয়েছিল এরসিনিয়া পেস্টিস নামক এক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা। ইংল্যান্ড এবং ডেনমার্কে ব্ল্যাক ডেথের সময়কার গণকবরগুলি দেখে এবং সেখানকার দেহাবশেষের জিনোম কালচার করে, বিজ্ঞানীরা চারটি মিউটেশন পরিলক্ষিত করেছিলেন। মিউটেশনের ফলে মানুষের জিনের বৈশিষ্ট্যে অনেক প্রভাব পড়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টগুলির মধ্যে একটি জটিল ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে যার নাম, RS-25449794। এই ভ্যারিয়েন্টটি ক্রন’স ডিজিজের সঙ্গে জড়িত। ক্রন’স ডিজিজের অর্থ হল অস্থিসন্ধির প্রদাহ ঘটিত সমস্যা। একে আর্থ্রাইটিস বা গাঁটের সমস্যা ভাবাও যায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম বিভিন্ন প্যাথোজেনের সঙ্গে লড়ার জন্য একটু একটু করে বিকশিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন প্যাথোজেনের সঙ্গে লড়তে পারলেও বেশ কিছু অটোইমিউন রোগ যেমন- আর্থ্রাইটিস বা ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাইরে থেকে প্রবেশকারী বিপজ্জনক কোশগুলিকে রুখতে ব্যর্থ হয় তখন সে ভুলবশত শরীরের প্রতিরক্ষাকারী কোশগুলিকেই ধ্বংস করে ফেলে। এই ভাবেই শরীরে বিভিন্ন প্রকার অটোইমিউন রোগ ঘটে। এই ধরনের রোগগুলির কারণে শরীরের ভেতরের ৮০টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এই বিউবনিক প্লেগের কারণে মানুষের জেনেটিক প্রতিরক্ষা ক্ষমতা যে বৃদ্ধি পেয়েছে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, প্রথম প্লেগ অতিমারিতে ব্ল্যাক ডেথের কারণে যতজনের মৃত্যু হয়েছিল, তার ৫০০ বছর পরের প্লেগ প্রাদুর্ভাবে তার চেয়ে মৃত্যুর হার অনেক কম ছিল।