কোভিড সারছে, শরীর সারছে না? অজান্তেই দানা বেঁধেছে এই মারণ অসুখ
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোন বেশি সক্রিয় হয়ে হচ্ছে, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে থাইরোটক্সিকোসিস। আবার দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে থাইরয়েডের কাজ।
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে শরীরে নানা রকম পরিবর্তন দেখা গিয়েছে প্রায় সকলেরই। কারও বা নিশ্বাসে কষ্ট, কারও দীর্ঘকালীন হার্টের সমস্যা, কারও লাগাতার পেটের গোলমাল, কারও বা অবসাদ, দুশ্চিন্তা-সহ একাধিক মানসিক ব্যধি। কিন্তু তারই মধ্যে গবেষকরা জানাচ্ছেন, কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে থাইরয়েড গ্রন্থি, ভারসাম্যের অভাব দেখা গিয়েছে থাইরয়েড হরমোনের কাজে।
শুরুতেই বলে নেওয়া যাক থাইরয়েড গ্রন্থিটির বিষয়ে সামান্য কিছু কথা। থাইরয়েড গ্রন্থি থাকে আমাদের গলার ফোলা অংশটির কাছে। গ্রন্থিটি দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। থাইরয়েড হরমোন আদতে দুই প্রকার: একটি হলো থাইরক্সিন বা টি-ফোর, অন্যটি ট্রাই-আয়োডোথাইরোডিন বা টি-থ্রি। এদের সম্মিলিতভাবে থাইরয়েড হরমোন বলা হয়। তবে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে তৈরি থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন।
থাইরয়েড হরমোনগুলির মূল কাজ শরীরে বিভিন্ন বিপাক বা মেটাবলিজমে সাহায্য করা। তার মধ্যে অন্যতম হলো খাবার বিপাকের পর শর্করাকে পেশিতে সঞ্চয় করা এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা। থাইরয়েডের ক্ষরণ ব্যাহত হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে, ফ্যাটের বিপাকে সমস্যা দেখা যায়। ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ে। এমনকী, ইনসুলিন, গ্লুকাগনের মতো হরমোন, যা রক্তে শর্করার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড হরমোন। এর পাশাপাশি থাইরয়েড হরমোন হৃদপিন্ডের গতি নিয়ন্ত্রণ ও রক্ত সরবরাহে সাহায্য করে। দেহের তাপমাত্রা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই হরমোন। এছাড়াও পেশি ও হাড়ের কাজ ও গঠন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি আমাদের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে দায়ী একাধিক নিউরোট্রান্সমিটারের কাজে সাহায্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করে এই হরমোন।
আরও পড়ুন: জরায়ু বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ভারতীয় মহিলাদের একাংশ, যে ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোন বেশি সক্রিয় হয়ে হচ্ছে, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে থাইরোটক্সিকোসিস। আবার দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে থাইরয়েডের কাজ। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কিছু রোগীর শরীরে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন এবং অন্যদিকে থাইরক্সিন বা টি-ফোরের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে সুস্থ হয়ে ওঠার বেশ কিছুদিন পরে, থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ আবার স্বাভাবিক স্তরে ফিরে এসেছে তাঁদের ক্ষেত্রে।
কোভিডের পর অনেক রোগীরই রক্তে শর্করার পরিমাণ আগের থেকে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা, যার ফলে ওজনও বেড়েছে অনেকের। আবার অনেক রোগীই জানিয়েছেন, কোভিডের পর তাঁরা মানসিক অবসাদে ভুগছেন, কখনও বা অকারণেই দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছেন তাঁদের। কোভিড পরবর্তী মানসিক অবসাদ, রাগ, দুশ্চিন্তার একটি অন্যতম কারণ ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইনের পরিমাণ শরীরে বেড়ে যাওয়া। যার ফলে দেখা দিয়েছে নিউরোইনফ্লেমেশনের মতো সমস্যাও। তবে তার পিছনে যে থাইরয়েডের হাত নেই, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ শরীরে একটি বিষয় আরেকটি বিষয়কে প্রভাবিত করে। হয়তো বা নিউরোইনফ্লেমেশন এবং থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ হ্রাস, এই দুই-ই কোভিড পরবর্তী মানসিক অবসাদ, রাগ, দুশ্চিন্তার পিছনে যুগপৎ ভূমিকা পালন করেছে।
নোভেল করোনাভাইরাস এ.সি.ই.-টু রিসেপ্টর দিয়ে কেবল ফুসফুসেই প্রবেশ করে এমন নয়। এই রিসেপ্টর থাইরয়েড গ্রন্থিতে থাকায় এটি একইভাবে প্রবেশ করে থাইরয়েড গ্রন্থিতে। পুরনো গবেষণাগুলিতে দেখা যাচ্ছে SARS-CoV, অর্থাৎ নোভেল করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2-এর আগের রূপ যেটি, সেটি থাইরয়েড গ্রন্থিতে প্রবেশ করলে থাইরয়েড গ্রন্থির ভেতরে থাকা ফলিকিউলার ও প্যারাফলিকিউলার কোশকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এমনকী, কোভিডে মারা যাওয়ার পর রোগীদের শরীরের ময়নাতদন্ত বা অটোপসি করেও তার প্রমাণ মিলেছে।
গবেষকদের মতে, এর ফলে থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। পাশাপাশি সম্ভাবনা থাকছে শরীরের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি থাইরয়েড গ্রন্থিতেও ইনফ্লেমেটরি সাইটোকাইনের পরিমাণ বাড়ার।
এদিকে ফ্রন্টিয়ার্স ইন এন্ডোক্রিনোলজি-তে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে, কোভিডে ভোগার পর রোগীদের শরীরে থাইরয়েড হরমোন ও থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের পরিমাণ কমেছে। যে সমস্ত রোগী অ্যাকিউট কোভিডের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আরওই ব্যাহত হয়েছে থাইরয়েড হরমোন ও থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের ক্ষরণ। তবে নির্দিষ্ট এই গবেষণায় যতজন রোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার সংখ্যা বেশ কম। ফলে গবেষণার ফলাফলে কিছু ভুল থাকার সম্ভাবনা বেশি, জানিয়ে দিচ্ছেন গবেষকরা নিজেরাই।
জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজমে ২০০০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, প্রো-ইনফ্লেমেটরি সাইটোকাইনের ফলে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের ক্ষরণ ব্যহত হতে পারে। এর পাশাপাশি কর্টিসল হরমোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের ক্ষরণে। তাছাড়া কোভিড ছাড়াও অন্যান্য শারীরিক অসুবিধে, যা শরীরে থাইরয়েডের পরিমাণকে প্রভাবিত করে, সেগুলিকে গণ্য করা হয়নি নির্দিষ্ট এই গবেষণায়।
ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডনের গবেষকরা জানাচ্ছেন, তাঁদের গবেষণায় যে-সমস্ত কোভিড রোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের শরীরে উল্লেখযোগ্য ভাবে কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে।
অন্যদিকে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ বাড়লে গলগণ্ড বা গয়টার, ক্লান্তি, হাত-পা কাঁপা, বুক ধড়ফড় করা, বেশি ঘাম হওয়া কিংবা অস্বাভাবিক ওজন হ্রাসের মতো সমস্যা। শুধু এখানেই শেষ নয়, দেখা যাচ্ছে হার্টের নানান সমস্যা। একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আটত্রিশ বছর বয়সি এক মহিলা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর শরীরে থাইরয়েডের পরিমাণ বেড়ে যায় ও তিনি আর্ট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনে আক্রান্ত হন। অথচ কোভিড হওয়ার আগে তাঁর হৃৎপিণ্ডজনিত কোনও অসুখই ছিল না। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই মহিলার আর্ট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনে ভোগার ক্ষেত্রে ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইনের অতি-সক্রিয়তার পাশাপাশি, থাইরয়েড গ্রন্থির অধিক সক্রিয়তাও যৌথ ভূমিকা পালন করেছে।
এর পাশাপাশি কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে নন-থাইরয়েডাল ইলনেসের শিকার হয়েছেন অনেকেই। যার ফলে ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ড থেকে শুরু করে একাধিক অঙ্গ ও তাদের কাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোভিড থেকে সেরে ওঠার কয়েক মাস পরে থাইরয়েড হরমোন ও থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের পরিমাণ আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।