মোদি দিদির মন্ত্রণাদাতা থেকে নিজেই ভোটপ্রার্থী! কেন মিলল না প্রশান্ত কিশোরের অঙ্ক?

Prashant Kishor’s Political Fail: ‘দিল্লি মডেল’ কপি করার চেষ্টাও অন্যতম ভুল। বিহারের পরিস্থিতি দিল্লির মতো নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি বোঝায় ঘাটতি ছিল।

২ মে ২০২১, বাংলার ভোটের ফলাফল আসছে, তৃতীয়বার অভূতপূর্ব জয়ে ফিরে আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নজর ছিল অন্যত্র। ঠিক সেইদিনই এনডিটিভির লাইভ সাক্ষাৎকারে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর ঘোষণা করলেন,

"I do not want to continue what I am doing. I have done enough. Time for me to take a break and do something else in life. I want to quit this space,"

ভোটের রণনীতি তৈরির বিশাল জগত থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার ঘোষণা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই ভাবলেন, তবে কি এবার ক্ষমতার লড়াইয়ে নামতে চাইছেন তিনি? কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত? তার উত্তর লুকিয়ে আছে প্রশান্ত কিশোরের জীবনের যাত্রাপথে এবং রাজনৈতিক ওঠাপড়ায়।

প্রশান্ত কিশোরের জন্ম সাসারামের কোনার গ্রামে। নিজের শৈশব, পড়াশোনা বা পারিবারিক জীবন নিয়ে তিনি সচরাচর কথা বলেন না। গ্রামেই প্রাথমিক পড়াশোনা করেন। এর পরে পাটনার কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন প্রশান্ত। তারপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়া। তবে কোর্স শেষ হওয়ার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। পাবলিক হেলথকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে তিনি যুক্ত হন জাতিসংঘের (UN) সঙ্গে। সেখানে আট বছর কাজ করেন। এই কাজের সূত্রে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কাজ করার সময়েই তাঁর গবেষণা নজরে পড়ে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। এক গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, গুজরাটে অপুষ্টির সমস্যা প্রকট। এর ভিত্তিতেই মোদি তাঁকে গুজরাটে ডাকেন। সেখান থেকেই শুরু এক নতুন গল্প।

২০১১ সালের কথা। তখন প্রশান্ত কিশোর মোদির সঙ্গে কাজ করছেন মাত্র চার মাস। হঠাৎই দক্ষিণ ভারতের এক বিখ্যাত অনুষ্ঠানে মোদির ভাষণ লেখার দায়িত্ব পড়ে তাঁর উপর। মোদির তা শুনে ভালো লাগে। এরপর একের পর এক ভাষণ, প্রচার অভিযান, সবই করতে থাকেন প্রশান্ত।

২০১২ গুজরাট নির্বাচন, মোদি টানা তৃতীয়বারে মুখ্যমন্ত্রী হন। এই জয়ের পেছনে সবচেয়ে আলোচিত নাম উঠে আসে প্রশান্ত কিশোরের। তিনি মোদিকে 'ডেভেলপমেন্ট ম্যান' হিসেবে তুলে ধরার নতুন ভাবনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
২০১৩ সালে তিন সহকর্মীকে নিয়ে গঠন করেন CAG (Citizens for Accountable Governance), যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে ভারতের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক পরামর্শ সংস্থা I-PAC। চায়ে পে চর্চা, 3D Rally-র মতো ক্যাম্পেইনে ২০১৪ সালের মোদির প্রচারের মূল মস্তিষ্ক ছিলেন তিনিই।

আরও পডুন

২ ঘণ্টার পারিশ্রমিক ১১ কোটি! কাদের থেকে, কী কাজের জন্য নিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর?

২০১৪ সালের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর মোদি সরকারে 'ল্যাটারাল এন্ট্রি' আনার পরামর্শ দেন প্রশান্ত। কিন্তু মোদি তা মানতে রাজি ছিলেন না। এখান থেকেই সম্পর্কের ফাটল শুরু। সেই বছরেই তিনি বিহারে ফিরে আসেন। তখনই হয় বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে প্রথম যুগলবন্দি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে পরাজয়ের দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়েন নীতীশ। বিহারের রাজনীতিতে তখন টানাপড়েন। ঠিক সে সময় বিজেপির সংসদ সদস্য পবন বর্মার দফতরে নীতীশ-পিকের প্রথম দেখা।

২ জুন ২০১৫ প্রশান্ত ফের বিহারে ফেরেন। নীতীশ-লালু-কংগ্রেস মহাজোটের জন্য রণনীতি তৈরি করেন। তখন বিখ্যাত স্লোগান—

“ফির একবার, নীতীশ কুমার”।

এই নির্বাচনে মোদির বিজয়রথ আটকে যায়। এরপর নীতীশকেও 'ল্যাটারাল এন্ট্রি'র বিষয় বলেন। কিন্তু ল্যাটারাল এন্ট্রি চালু করার চেষ্টাতে আবার সমস্যা তৈরি হয়। নীতীশ ‘বিহার বিকাশ মিশন’ বানালেও তা সফল হয়নি। নির্বাচনের পরই প্রশান্ত বিহার ছাড়েন।

২০১৬-১৭, কংগ্রেসের হয়ে ইউপি ও পাঞ্জাবে কাজ করেন। পাঞ্জাবে অমরিন্দর সিংয়ের জোরালো জয় হয় কিন্তু ইউপিতে ভরাডুবি। এটাই ছিল পিকে’র একমাত্র নির্বাচনী ব্যর্থতা। ২০১৮-২০ সালে জেডিইউ-তে জাতীয় সহসভাপতি হন। পাশাপাশি ভোটকুশলীর কাজও চালিয়ে যান। ২০১৯-এ অন্ধ্রপ্রদেশে জগন্মোহন রেড্ডির বিপুল সাফল্য হয়। ২০২০ সালে দিল্লিতে আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরও ঐতিহাসিক জয় হয়। কিন্তু কেজরিওয়ালের জন্য কাজ করাই নীতীশ-পিকে সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ডেকে আনে। CAA-NRC ইস্যুতে প্রকাশ্যে নীতীশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ২০২০ সালে জেডিইউ থেকে বহিষ্কার হন প্রশান্ত।

এরপর ২০২১-এর বাংলা বিধানসভা নির্বাচন। ২০১৯ লোকসভা ভোটে বিজেপির উত্থান দেখে অনেকে ভেবেছিলেন এবার টানটান লড়াই হবে। ঠিক সেইসময় তৃণমূলের রণকৌশল সামলাতে আসে পিকে–র দল I-PAC। সেই বিখ্যাত স্লোগান—

“খেলা হবে”

স্লোগান তৈরি করে পিকের টিমই। ফলাফল, মমতা ঐতিহাসিক জয়। কিন্তু ঠিক এই সাফল্যের পরেই পিকে ঘোষণা করেন, তিনি আর এই পেশায় থাকবেন না।

২০২২ সালের ২ অক্টোবর তিনি ঘোষণা করেন নতুন রাজনৈতিক যাত্রা, জন সুরজের কথা। জন সুরজের তিনটি মূল লক্ষ্য ছিল— বিহারের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন, স্থানীয় সমস্যার সমাধানের রোডম্যাপ, রাজনীতিতে বিকল্প তৈরি। প্রশান্ত কিশোর ৫,০০০ গ্রামের পদযাত্রাও করেন। কিন্তু কোথায় গড়বড় হল?

দুই বছর পর জন সুরজ পার্টি গঠনের কথা ঘোষণা করেন। পিকে প্রতিটি সভায় শিক্ষা, কাজ, পরিযায়ী শ্রমিক, সামাজিক ন্যায় নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু তারপরই শুরু হয় বিতর্ক। পাটনার ছাত্র আন্দোলনে উপস্থিত হন পিকে। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে যখন ছাত্রদের ধস্তাধস্তি হয় তখন আর ময়দানে ছিলেন না তিনি। ছাত্রদের সঙ্গে কথাকাটাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়। পরের দিন থেকে পাটনায় গান্ধী ময়দানে অনশন শুরু করেন। কিছু দিন পর সেখান থেকে গ্রেফতার হন।

আরও পডুন

পরিবারে টানাপোড়েন চরমে! কেন পরিবার ছাড়ার ঘোষণা লালু কন্যা রোহিনির?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫-এর র‍্যালিই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ১১ এপ্রিল ২০২৫, গান্ধী ময়দানে জন সুরজের প্রথম মহার‍্যালি। তিনি দাবি করেন ৫ লাখ মানুষ আসবেন। এসেছিল মাত্র ৫০ হাজার। এই দিন মাত্র ১০ মিনিট বক্তৃতা করে মঞ্চ ছাড়েন পিকে। রাজনৈতিক মহলে তাঁকে 'অপরিপক্ব নেতা' বলে সমালোচনা করা হয়। বিহারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্তোষ সিং তাঁর নিজের বই 'জেডিপি সে বিজেপি'-তে লেখেন,

"যদি অন্য কোনো নেতা হতেন ওই রেলিতে আরও অনেক কথা বলতেন।"

তিনি আরও লেখেন,

"যখন নীতীশ কুমার সমতা পার্টি থেকে আলাদা হয়ে দল বানান, তখন নীতীশও ওই গান্ধী ময়দানেই র‍্যালি করেন। মোট ২৫ হাজার লোক এই রিলিতে আসে। তবুও নীতীশ এই র‍্যালিতে বক্তৃতা রাখেন। "

স্বচ্ছ, টেকনোক্র্যাটিক রাজনীতি দিয়ে বিহারের সমাজ-জাত ব্যবস্থাকে ভাঙা সম্ভব নয়, এই বিষয়গুলিতে তিনি কম গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাছাড়া ‘দিল্লি মডেল’ কপি করার চেষ্টাও অন্যতম ভুল। বিহারের পরিস্থিতি দিল্লির মতো নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি বোঝায় ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে, ছাত্র আন্দোলনে তর্ক, হঠাৎ অনশন এসব তাঁর পরিমিত ইমেজ ভেঙে দেয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এও বলছেন, দলের প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজন বিতর্কিত ছিলেন। যা তাঁর ‘বিকল্প রাজনীতি’র ইমেজ নষ্ট করে। নির্বাচন যত ঘনিয়েছে, জন সুরজের ততই ‘নেতৃত্বের শক্তি’ কম চোখে পড়েছে, বলেও মন্তব্য করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

তিনি ক্ষমতার চালচিত্র খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তার কেন্দ্রে থেকেছেন। সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই নিজেকে রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের জটিল সামাজিক কাঠামো আর সংগঠন গঠনের চ্যালেঞ্জ, প্রশান্ত কিশোরের ‘পলিটিক্যাল ম্যাথ’-কে ভুল প্রমাণ করেছে।

More Articles