ঘর থেকে দু'পা গেলেই বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি, হয়ে উঠতে পারে আপনার উইকএন্ড ডেস্টিনেশন
প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৭০০ একর জমিতে নির্মিত এই বিনোদনের এলাকা বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি বলে গণ্য হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় বাংলার নিজস্ব একটি ফিল্ম সিটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। এটির নির্মাণ শুরু করেছিল 'প্রয়াগ গোষ্ঠী'। এর নির্মাণ-নকশা, পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন শিল্প নির্দেশক ও চলচ্চিত্র পরিচালক নীতিশ রায়। কলকাতা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে চন্দ্রকোনা রোডের পাশে অবস্থিত ২৭০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গাজুড়ে ফিল্ম সিটিটি গড়ে তোলা হয়েছে। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি। ২০১২ সালে প্রথম দফার নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল ফিল্ম সিটির উদ্বোধন করেন বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা শাহরুখ খান।
জঙ্গলমহলে চন্দ্রকোনা এলাকায় আরাবারির সংরক্ষিত বনে প্রকৃতির কোলে বিশাল এলাকাজুড়ে এই ফিল্ম সিটির অবস্থান। প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৭০০ একর জমিতে নির্মিত এই বিনোদনের এলাকা বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি বলে গণ্য হয়। সেট, সাউন্ড বা স্টুডিও থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে এই ফিল্ম সিটিতে, কলকাতা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার দূরত্বে।
প্রয়াগ ফিল্ম সিটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রও বলা চলে। এই ফিল্ম সিটির স্বত্বাধিকারী প্রয়াগ গ্রুপের চেয়ারম্যান বাসুদেব বাগচী-র মতে, এই ফিল্ম সিটি বলিউডের সিনেমা-সহ উপমহাদেশের চলচ্চিত্রর জন্য এক অনন্য সৃষ্টি। তাঁর মতে, পরিচালক শুধু কলাকুশলীদের নিয়ে এই ফিল্ম সিটিতে হাজির হয়ে সহজেই একটি সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারেন, কারিগরি দিক থেকে এতটাই এগিয়ে এই ফিল্ম সিটি। এই ফিল্ম সিটির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ভার রয়েছে অভীক বাগচীর ওপর, তাঁর মতে পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে প্রয়াগ ফিল্ম সিটি, 'রামোজি ফিল্ম সিটি'-র চেয়েও অনেক বেশি 'আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ'।
আরও পড়ুন: আজও বিস্ময়! ব্রিটিশদের থেকে আত্মগোপন করতে এই রাজবাড়িতে ছিলেন নজরুল
এখানে বন, সাগর, পাহাড়, মরুভূমি এবং বরফের মতো প্রাকৃতিক বিষয়গুলো ছাড়াও আইফেল টাওয়ার, পিরামিড, আধুনিক শহরের সুউচ্চ ভবন- এমন ১১০টি সম্ভাব্য ফিল্ম সেটের প্রতিরূপ করা আছে। অন্য ফিল্ম সিটিতে এই প্রতিরূপগুলি দ্বিমাত্রিক অথবা সাধারণ মানের, যা সামনে থেকে দেখতে হয়। কিন্তু প্রয়াগ ফিল্ম সিটিতে এইসবই ত্রিমাত্রিক, অবিকল আসলের মতো। এছাড়াও এখানে রয়েছে নিজেদের ট্রেন লাইন, রেল স্টেশন, ট্রেন, হেলিকপ্টার-সহ হেলিপ্যাড ও গলফ কোর্স। বিশেষ সুযোগসুবিধা-সহ ৫০টি 'স্টুডিও ফ্লোর' এখানে আছে। আনুপাতিক হারে আছে সাউন্ড স্টুডিও,১৬ মিলিমিটার থেকে ৩৫ মিলিমিটার-সহ ডিজিটাল ও সিনেমাস্কোপ শুটিং-সহ ল্যাবরেটরি। অত্যাধুনিক প্রসেসিংয়ের সুবিধার জন্য দক্ষিণ ভারতের চেয়েও উন্নত আউটপুট পাওয়া সম্ভব এখানে। একসঙ্গে অন্তত ৬০টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজ শুরু করা এবং শেষ করা সম্ভব- এভাবেই এখানকার নকশা ও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে আপনি এই ফিল্ম সিটিতে সফর সারতে পারেন। এখানে 'নকল' রেল স্টেশনে একটি রেলগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওভারব্রিজ আছে, টিকিট কাউন্টার আছে। কিছুতেই ভাবা যায় না যে, এটি সিনেমা বানানোর সেট। এই ফিল্ম সিটির ভেতরে আছে আস্ত একটা শহর। সেখানে বাজার, দোকান, ফ্ল্যাট, মন্দির, মসজিদ, গির্জা- সবকিছুই আছে। সবকিছু লোহার স্ট্রাকচার দিয়ে তৈরি এবং ভেতরে প্লাইউডের কাজ। দেখে আশ্চর্যভাবে সবকিছুই আসল বলে মনে হবে। কিন্তু এই জায়গাটা বর্তমানে পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে বলে কিছু মানুষ নিজেদের নাম লিখে, জায়গাটি খুঁড়ে নানাভাবে এর স্থাপত্যকে নষ্ট করছে।
এই ফিল্ম সিটি অনেকগুলো সিনেমা তৈরির সাক্ষী, তার মধ্যে আছে 'যোদ্ধা', 'কমান্ডো ২', 'পারব না আমি ছাড়তে তোকে', 'দাঙ্গা', হিন্দি ছবি 'বেগম জান' এবং সাম্প্রতিক ছবি 'হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী'।
এখানে নির্মিত ড্রাগন বা মনাস্ট্রি আকারের চূড়া দেখলেই আমাদের মনে পড়ে যায় অবধারিতভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিনের কথা, সেই চৈনিক স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতেই হয়। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এবং নতুন করে রং করার অভাবে সৌন্দর্য কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে এই এলাকার। গথিক শিল্পের মতো বিরাট বিরাট গেট এবং পরিখা দিয়ে ঘেরা একটি সুন্দর প্রাসাদ ভেতরে বর্তমান। অসাধারণ শিল্পকলার কাজ, যা চোখ আপনার টানবেই। এখানে এলে রোমান স্থাপত্যও চোখে পড়বে।
প্রচুর অর্থ ব্যয় এই ফিল্ম সিটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এবং অবিবেচক পর্যটকদের জন্য নষ্ট হতে বসেছে এত সুন্দর একটি ফিল্ম সিটি। এখানে এলে হায়দরাবাদের ফিল্ম সিটি দেখতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন হয় না। নিজের রাজ্যে এত সুন্দর একটা ফিল্ম সিটি রয়েছে, যার কোনও কদর নেই। অনেকেই হয়তো এত সুন্দর ও বিশাল একটি ফিল্ম সিটির ব্যাপারে কিছুই জানেন না।২০১২ সালের পর থেকে এই প্রয়াগ গ্রূপ আইনি সমস্যায় জর্জরিত। ফলে, ফিল্ম সিটিটিও অবহেলিত।