গুজরাতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুক দেশ, রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্যের আসল কারণ কী
Draupadi Murmu: গুজরাতের নুন খাচ্ছে গোটা দেশ, কেন এই মন্তব্য দ্রৌপদী মুর্মু-র?
নুন খেয়ে গুণ গাহিত কভু
দিয়েধুয়ে সুখ হইত তবু।
উড়ে এসে জুড়ে বসে নিজের দেশেই ভারতীয়দের শুধুমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা নয়, ভারতীয়দের হেঁশেলের ওপরও তখন একচেটিয়া রাজত্ব ঔপনিবেশিক শাসকের। হাতের কাছে মজুত থাকা সত্ত্বেও নিজে থেকে লবণ সংগ্রহ, কেনা এবং বেচার অধিকার থেকে বঞ্চিত আম নাগরিক। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের কাছ থেকে বেশি দামে লবণ কিনতে হতো সকলকে। একপেশে এই আইনের বিরোধিতায় লবণ সত্যাগ্রহর ডাক দেন মহাত্মা গান্ধী। ২৪ দিনের এই লবণ সত্যাগ্রহর দৌলতেই সদরের রোয়াক থেকে বাড়ি বাড়ি হেঁশেলে ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচ। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আইন অমান্য করতে একজোটে শামিল হয় গোটা দেশ। কিন্তু ১৯৩০ সালের সেই ভারতের সঙ্গে ২০২২-এর বর্তমান ভারতের ফারাকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল'-এ। সেই সময় যে লবণকে হাতিয়ার করে গোটা দেশকে একসুতোয় বেঁধে দিয়েছিলেন মহাত্মা, আজকের ভারতে তা ব্যবহৃত হচ্ছে উত্তম এবং অধমের মধ্যেকার ফারাক বোঝাতে, একটি রাজ্যের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে। বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা শাসক নয়, দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদাধিকারীকে দিয়ে অতি সন্তর্পণে সেই কাজ করিয়ে নিচ্ছে ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই।
জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসানোর পিছনে যতই রাজনৈতিক কৌশল থাকুক না কেন, দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়াকে স্বর্ণযুগের সূচনা হিসেবেই গোড়া থেকে দেখিয়ে আসছে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন বিজেপি সরকার। কিন্তু নির্বাচনমুখী গুজরাত সফরে গিয়ে রাষ্ট্রপতির মুখে শোনা গেল শাসকের সুরই। প্রকারান্তরে গোটা দেশকে গুজরাতের কাছে কৃতজ্ঞ থাকার নিদান দিলেন তিনি। আরবসাগরের তীর ধরে, এই গুজরাত থেকেই লবণ সত্যাগ্রহর সূচনা ঘটিয়েছিলেন মহাত্মা। বর্তমানে গুজরাতেই দেশের সর্বাধিক লবণ উৎপন্ন হয়। তাই দ্রৌপদীর কথায়, ‘‘একথা বলাই যায় যে, গোটা দেশ গুজরাতের নুন খায়।’’ দ্রৌপদী যদিও নুন খাওয়ার কথাটুকুই বলেছেন, যার সঙ্গে ভারতীয়দের জীবনের অন্যতম মূল মন্ত্র জড়িয়ে রয়েছে, ‘নুন খাই যার, গুণ গাই তার’। ভারতীয়দের গুজরাতের নুন খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও, বাকিটুকু উহ্য রেখেছেন দ্রৌপদী। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষের পক্ষে ইঙ্গিতটুকু বোঝা অসম্ভব কার্য নয় মোটেই। কিন্তু গুজরাতে তৈরি হওয়া লবণ কি আম ভারতীয় হেঁশেলে বিনেপয়সায় হেঁশেলে ঢোকে? তা যখন হয় না, তাহলে কেনই বা গুজরাতের গুণগ্রাহী হয়ে থাকবেন দেশের মানুষ, প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখেই চলছে ইতিহাস পালটে দেওয়ার খেলা
দ্রৌপদী দেশের রাষ্ট্রপতি হলেও, তাঁর পদটি প্রশাসনিক নয়, সাংবিধানিক। রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ থাকবেন, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, ন্যায়-নীতি কর্তব্য পালনের পদে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, এমনটাই কাম্য। কিন্তু শাসক দলের দ্বারা মনোনীত হওয়ার পর মন্দির ঝাঁট দিয়ে সেই কামনায় আগেই জল ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে প্রকৃতির উপাসক জনজাতি সম্প্রদায়কে হিন্দুত্বর নাগপাশে বেঁধে ফেলার দীর্ঘদিনের যে প্রচেষ্টা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি-র, তারই প্রতিফলন ঘটে দ্রৌপদীর মন্দির ঝাঁট দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু গুজরাত সফরে গিয়ে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদাধিকারী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আনুগত্যেরও প্রতিফলন ঘটল দ্রৌপদীর কথায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গুজরাতের প্রগতিশীল এবং সার্বিক সংস্কৃতির আদর্শ প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদি। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গুজরাত মডেলই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করেছে।’’ চলতি বছরের শেষে গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন। তার পর ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। বিজেপি-র রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে দ্রৌপদীর এই মোদি-প্রশস্তি তাই ইঙ্গিতবহ।
দ্রৌপদীর বক্তব্য অনুয়ায়ী, দেশে উৎপাদিত লবণের ৭৬ শতাংশই গুজরাতের। ২০১৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যানে কোথাও গলদ নেই। লবণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৫০ শতাংশ কর্মীর বসবাস গুজরাতে। ভাবনগর, পোরবন্দর, কচ্ছ, খারগোধায় মূলত লবণশিল্পের রমরমা। গুজরাত ছাড়াও রাজস্থান, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গেও লবণের উৎপাদন হয়। কিন্তু লবণের জন্য যে গুজরাতের কাছে গোটা দেশকে ঋণী ঘোষণা করে দিলেন দ্রৌপদী, সেখানে লবণ শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ ওয়াকিবহাল নন তিনি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সর্বোপরি অতিমারির ধাক্কায় বিগত তিন বছর ধরে লাগাতার গুজরাতে লবণের উৎপাদন কমছে। বার্ষিক ৩ কোটি টন থেকে ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে গুজরাতে উৎপন্ন লবণের পরিমাণ কমে হয়েছে ২.৫ কোটি টন। এর ফলে গোটা দেশে লবণের দামও বেড়ে গিয়েছে তরতর করে। কয়েক বছর আগে এক টন শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত লবণের দাম যেখানে ছিল ১২০০ টাকা, এখন তা ১৬০০ টাকা হয়েছে। এ বছর বন্যায় ভেসেছে গুজরাত। তাই ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে লবণ শিল্পে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ভারতীয় লবণ উৎপাদন সংগঠনের (ISMA) প্রেসিডেন্ট ভরত রাওয়াল জানিয়েছেন, ২০১৮-’১৯ সাল পর্যন্ত চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত লবণ উৎপন্ন হতো দেশে। কিন্তু বর্তমানে লবণের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমেছে। জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য যেখানে তিন মাসের লবণ মজুত থাকত, এখন দৈনিক চাহিদার জোগান দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। আমেরিকা এবং চিনের পর ভারতই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম লবণ উৎপাদনকারী দেশ। মোট উৎপাদনের ১ কোটি টন লবণই বিশ্বের ৫৫টি দেশে রফতানি করে ভারত। ১২.৫ কোটি টন ব্যবহৃত হয় শিল্পক্ষেত্রে। খুচরো বাজারে বিক্রি হয় বাকি অংশ। তাই উৎপাদনে ঘাটতির প্রভাব শুধুমাত্র হেঁশেলেই নয়, কাচ, পলিয়েস্টার, প্লাস্টিক, রাসায়নিক শিল্পেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। উৎপাদনে এই ঘাটতিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে লবণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত গুজরাতের ৫ লক্ষ মানুষকে। প্রতি টনে এই মুহূর্তে লবণচাষিরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের মাপকাঠি না থাকায় নামমাত্র দামে লবণ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। লবণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের মজুরিও নামমাত্র। কোনও রকম সামাজিক নিরাপত্তা পান না তাঁরা।
এর আগে, মোদি সরকারের চালু কৃষক আইন নিয়ে উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। আন্তর্জাতিক সমালোচনা, ৭০০-র বেশি মানুষের মৃত্যুর পর সেই আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। লবণচাষি থেকে এবং শ্রমিকরাও প্রাপ্য অধিকারের দাবিতে দরজায় দরজায় ঘুরে চলেছেন। কিন্তু সাড়া পাননি কোথাও থেকে। লবণ উৎপাদনকারীদের হয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দেন রাওয়াল। দেশের সবচেয়ে সস্তার পণ্যটিই সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে তাতে অভিযোগ করেন তিনি। এভাবে চললে আগামী দিনে লবণ উৎপাদনকারী তৃতীয় বৃহত্তম দেশের মর্যাদাও ভারত হারাতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেন তিনি। তার পরও সুরাহা হয়নি। রাওয়ালের কথায়, ‘‘মহাত্মা গান্ধী লবণের উপর করের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও নিয়ম-কানুন আজও ব্রিটিশ আমলেরই রয়ে গিয়েছে।’’ শুধু তাই নয়, রণ সরোবরের মতো বিশুদ্ধ জল প্রকল্পও লবণ উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ লবণচাষীদের। তার উপর বেশির ভাগ লবণচাষীদের কাছে সরকারি কাগজপত্র নেই। ফলে বড় বড় সংস্থাগুলি জমি খালি করতে চাপ দিচ্ছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে তা জানিয়েও সুরাহা হয়নি।
তাই ২০১৪ সাল থেকে যে গুজরাত মডেলের বাজনা গোটা দেশে বাজিয়ে চলেছে বিজেপি এবং মোদি সরকার, বাস্তবের সঙ্গে তার ফারাক অনেকটাই বলে দাবি লবণচাষীদের। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়েছিল। সেই বছর বিজেপি-কে রীতিমতো টেক্কা দিয়েছিল কংগ্রেস। কোনও রকমে তাতে উতরে গেলেও, ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই বাস্তব পরিস্থিতি উদ্বেগে রেখেছে বিজেপি-কেও। তার জন্য সেপ্টেম্বর মাসেই গুজরাত সফরে গিয়ে এ নিয়ে জমি পরীক্ষা করেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। শ্রমিকের জোগানে ঘাটতি মেটাতে ড্রোনের ব্যবহার থেকে সরকারি সুযোগ-সুবিধার কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। লবণের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টিও তাঁর কাছে উত্থাপন করেন রাজ্যের নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে দু’মাস বাকি থাকতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া সমস্যার সমাধান করা যে অসম্ভব তা ববোঝা অসম্ভব নয়। তাই দ্রৌপদীকে নামিয়ে লবণের হৃত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভোট ধরে রাখার চেষ্টাই হল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। একই সঙ্গে ২০২৪-এর আগে, মোদির নামে গুজরাত মডেলের স্বপ্ন ফেরি করার পাশাপাশি, গুজরাতের ‘নুন খাওয়া’ এবং গুণ গাওয়ার কথাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো বললে অত্যুক্তি করা হয় না।