ধীরুভাই আম্বানি, বাল ঠাকরেদেরও বোকা বানিয়েছিলেন প্রীতীশ নন্দী
Pritish Nandy: দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিন্দুত্ববাদী বালাসাহেব ঠাকরে ভেবেছিলেন প্রীতীশ নন্দী হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বালাসাহেবের আনুকূল্যে তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হন।
প্রীতীশ নন্দী ছিলেন বিচিত্রকর্মা, অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং বিতর্কিত এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম ভাগলপুরে। পড়াশোনা কলকাতার লা মার্টিনিয়ের স্কুলে, তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে। আমি লা মার্টিনিয়ের স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলাম। তাঁর মা পড়াতেন লা মার্টিনিয়ের-এ। ৭৪তম জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর প্রয়াণ।
প্রীতীশ নন্দী কাজ করেছেন সাহিত্য, সাংবাদিকতা সহ নানা ক্ষেত্রে। ইংরেজি ভাষার কবি হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন দেশ জুড়ে। বিভিন্ন ভাষার কবিতা, বিশেষত বাংলা ভাষার কবিতা ইংরেজি অনুবাদ করেছেন প্রীতীশদা। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ই শুরু করেছিলেন কবিতা পত্রিকা প্রকাশ, যদিও কলেজের পাঠ শেষ না করেই অগ্রসর হয়েছেন কর্মক্ষেত্রে। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন এবং প্রকাশেও উদ্যোগী হয়েছেন। বাংলা, পঞ্জাবী, উর্দু এইসব ভাষার কবিতা তাঁর ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। ঈশোপনিষদের ভাষ্যও অনূদিত হয়েছে ইংরেজিতে। সংস্কৃত সাহিত্যের ধ্রুপদী প্রেম-প্রণয়ের কবিতাও বৃহত্তর পাঠকের জন্য তর্জমা করেছেন ইংরেজি ভাষায়। ভারতবর্ষে পশুদের অধিকার সুরক্ষিত করতে মানেকা গান্ধির সঙ্গে জোট বেঁধে গড়ে তুলেছিলেন একটি অসরকারি সংস্থা। এক্ষেত্রে তাঁদের এই উদ্যোগ বাস্তবিকই দৃষ্টান্তমূলক।
গত ২০০১ সাল থেকে ব্রতী হয়েছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনায়। ‘Pritish Nandy Communications’ নামের ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থার কর্ণধার ছিলেন তিনি। সুধীর মিশ্রর ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’ দেশ জুড়ে প্রশংসিত হয়। একই পরিচালকের ‘চামেলি’, অঞ্জন দত্তর ‘বো ব্যারাকস ফর-এভার’, সুজয় ঘোষের ‘ঝংকার বিটস্’ ইত্যাদি ছবিও উল্লেখের দাবি রাখে। একদিকে এইসব ছবি, অন্যদিকে সানি লিওনের মতো অভিনেত্রীকে নিয়ে ‘মস্তিজাদে’ ছবিটির প্রযোজনাও তাঁরই কীর্তি।
এর আগে প্রীতীশ নন্দী ‘The Times of India’ গোষ্ঠীর প্রকাশন অধিকর্তার (Publishing Director) গুরুভার নির্বাহ করেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। একইসঙ্গে তিনি ‘The Illustrated Weekly of India’-র সম্পাদনাও করেছেন। তিনি শিবসেনা দলের সমর্থনে রাজ্যসভার সাংসদও হয়েছিলেন। তাঁর দাদা আশিস নন্দী দেশজানিত চিন্তক ও লেখক। তাঁর আরেক ভাই মণীশ নন্দী।
আরও পড়ুন- ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও মস্তিষ্ককে বিক্রয়যোগ্য করে তোলেননি প্রীতীশ
প্রীতীশদা ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত। ভালো ছবি আঁকতেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘Gods and Olives’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। গত শতাব্দীর সাতের দশকে ‘Dialogue’ নামের কবিতাপত্র প্রকাশ শুরু করেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড আকাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড কালচার’-এর পঞ্চম বিশ্ব সম্মেলনে তাঁকে ‘Poet Laureate’ আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর লেখা ‘Calcutta If You Must Exile Me’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ভাবলে অবাক লাগে, ‘The Independent’ নামের সংবাদপত্রের সূচনা হয় তাঁর হাত ধরে, আবার ‘Filmfare’-এর মতো প্রবল জনপ্রিয় পত্রিকারও প্রধান পরিকল্পনা তাঁর। ১৯৯৩ সালে টাইমস গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তোলেন ‘প্রীতীশ নন্দী কমিউনিকেশনস’। কলাম লিখেছেন টাইমস ছাড়াও দৈনিক ভাস্কর, দিব্য ভাস্কর, সংবাদ প্রতিদিন, মুম্বই মিরর প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়। বম্বের Hotel Leela Kempinski-তে ১৯৯৬ সালে স্থাপন করেন ভারতবর্ষের প্রথম সাইবার ক্যাফে। তাঁর কর্মজীবন ছিল বিপুল বিস্তৃত এবং বহুব্যাপৃত। নিত্যনতুন ভাবনায় উজ্জীবিত প্রীতীশদা এগিয়ে গিয়েছেন অভিনব প্রকাশের অভ্যর্থনায়। টেলিভিশনের জন্যেও বহু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করেছেন। ‘The Pritish Nandy Show’, ‘Fiscal Fitness : The Pritish Nandy Business Show’ তাঁর সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান। ওটিটি মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া ‘Modern Love Mumbai’ (২০২২) সম্প্রতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এই গেল প্রীতীশদার কর্মজীবনে বিশেষ কিছু অধ্যায়ের প্রসঙ্গ। সাংবাদিক হিসেবে অকুতোভয় মনে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন সহকারীদের। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। নিন্দার ঝড়ও উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তাঁর মৃত্যুর পরও অভিনেত্রী নীনা গুপ্তা তাঁকে একজন ধিকৃত এবং নিন্দিত মানুষ বলতে কসুর করেননি। নীনা গুপ্তা গত শতকের আটের দশকে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হন কিংবদন্তি ভিভিয়ান রিচার্ডসের সঙ্গে। নীনা-কন্যা মাসাবার জন্ম হয় ১৯৮৯-তে। নীনা চেয়েছিলেন একক মাতৃত্বের অধিকার। অর্থাৎ একাই তিনি বড় করবেন মাসাবাকে। নীনা গুপ্তার অনুমতি ছাড়াই প্রীতীশ নন্দী মাসাবার জন্মের শংসাপত্র জনসমক্ষে আনেন, যেখানে মাসাবার বাবা হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান এই ক্রিকেট তারকার নাম ছিল।
১৯৮৬ সালে, ‘The Illustrated Weekly of India’-তে উড়িষ্যার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জানকীবল্লভ পট্টনায়েককে নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সম্পাদক প্রীতীশ নন্দী। প্রতিবেদক, কলকাতার সাংবাদিক এস.এন.এম আব্দি। ‘The Strange Escapades of JB Patnaik’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে রীতিমতো ঝড় ওঠে। পরবর্তীকালে ‘moneycontrol.com’-এ আব্দি লেখেন, জানকীবল্লভের কর্মকাণ্ড যখন উন্মোচিত হচ্ছে, সম্পাদক প্রীতীশ নন্দী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর পাশে থেকেছেন।
Reader’s Digest পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক তথা খুশবন্ত সিংয়ের পুত্র রাহুল সিং লিখেছেন, প্রীতীশ নন্দীর বেশ কয়েকটি কাজ স্মরণীয়। তিনি নীনা-কন্যার পিতৃত্বের খবর জনপরিসরে এনেছেন। আবার ভণ্ড প্রতারক অথচ স্বঘোষিত সাধক চন্দ্রস্বামীর কুকীর্তিও ফাঁস করেছেন। রাহুলের স্পষ্ট বক্তব্য, সমীর জৈন, ধীরুভাই আম্বানি এবং বালাসাহেব ঠাকরের মতো অত্যন্ত প্রভাবশালী তিন ধুরন্ধর ব্যক্তিকে এক অর্থে বোকা বানাতে সফল হয়েছিলেন প্রীতীশ নন্দী। রাহুল সিং বিস্তারিতভাবে বলেছেন, ‘The Times of India’ গোষ্ঠীর প্রবল প্রতাপশালী সমীর জৈন তাঁকে ‘The Illustrated Weekly’ এবং ‘The Evening News’ এই দু'টি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব দেন। পত্রিকা দুটোই বন্ধ হয়ে যায়। ধীরুভাই আম্বানি তাঁর হাতে তুলে দেন ‘The Sunday Observer’-এর দায়িত্ব। সেই সময় এই পত্রিকাটি ছিল বহুল প্রচারিত। এই পত্রিকারও ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিন্দুত্ববাদী বালাসাহেব ঠাকরে ভেবেছিলেন প্রীতীশ নন্দী হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বালাসাহেবের আনুকূল্যে তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হন। প্রীতীশ নন্দী আসলে ছিলেন খ্রিস্টান। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এইসব কীর্তি রীতিমতো চমকপ্রদ।
আরও পড়ুন- মাটির মানুষ আমার ‘ইরফান ভাই’
প্রীতীশদাকে নিয়ে বলা যায় আরও নানা কথা। তবে আমার মনে পড়ছে, বেশ কিছু বছর পর, গত অক্টোবরে তাঁর নারিমান পয়েন্টের অফিসে আমার সাক্ষাৎ হয় তাঁর সঙ্গে। আমি তাঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলি, ‘The Illustrated Weekly’-তে তিনি আমাকে যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে উৎসাহিত করেছেন, তা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তাছাড়াও এই পত্রিকার জন্য জ্যোতি বসু, অশোক মিত্র প্রমুখের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। তবে তিনি শিবসেনার সমর্থনে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেকেই জানেন, শিবসেনা-প্রধান বালাসাহেব ঠাকরে ছিলেন তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষী। তাঁর ঘৃণা-ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে কোর্টের নির্দেশে তাঁর ভোটে লড়াও বন্ধ করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, মুম্বইতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শিবসেনার নেতৃত্বে রীতিমতো মুসলমান নিধন সংঘঠিত হয়। এ ধরনের কোনও প্রসঙ্গ কথার মাঝে উত্থাপিত হলে প্রীতীশদা আমায় বলতেন, তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন সাংসদ। এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তিনি ফিরে যেতেন তাঁর কলকাতার দিনগুলিতে। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কাব্যচর্চা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ— এসব নানা কথা ঘুরে ফিরে আসত। তিনি Guest Keen Williams নামক এক বহুজাতিক সংস্থার জনসংযোগ বিভাগে কাজ করতেন। সেই সময়ে সংস্থার প্রধান ছিলেন সুখেন্দু রায়।
যাই হোক, আমার মনে হতো তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ড নিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিই। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম। প্রীতীশ বলেছিলেন, আমি ফের মুম্বই গেলে আবার দেখা হবে। আমি বুঝতে পারিনি, ক্যানসার তাঁকে গ্রাস করছে অত্যন্ত দ্রুত। কখনও ভাবতে পারিনি, তিনি এমন অকালে চিরবিদায় নেবেন। তাঁর ৭৪তম জন্মদিনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে তিনি চিরতরে চলে গেলেন।
অনুলিখনে সুদেব সিনহা