ক্ষোভ আর নির্লিপ্তিতে ভাগ হয়ে আছে ডিসেম্বরের লন্ডন
Protest Against Gaza War : রোম যখন পুড়ছিল, প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন নিরো। হাজার হাজার শিশুর লাশ দু'পায়ে মাড়িয়ে ভেটো দিচ্ছে আমেরিকা। গণহত্যা চলছেই।
ট্রাফলগার স্কোয়ারের সামনে ভিড়টা ক্রমশ জমাট বাঁধছে। একটা বড়সড় প্যাকিং বাক্সের উপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন জেরেমি করবিন। চারপাশে কয়েক হাজার মানুষ। প্রচুর প্যালেস্তাইনের পতাকা। অনেকের মাথায় সান্তাক্লজের টুপি, হাতে তরমুজের ছবি৷ কাটা তরমুজ প্যালেস্তাইনের প্রতীক- লাল, সবুজ, কালো। লম্বা ব্যানারে নেলসন ম্যান্ডেলা, ম্যালকম এক্স, প্যাট্রিক লুলুম্বা, কার্ল মার্কসের সঙ্গে যিশু খ্রিস্ট। বড়দিন আসছে। এই বড়দিন অন্যরকম। তার গায়ে লেগে আছে আয়াত ফেরওয়ানার লাশের গন্ধ। আয়াতের বয়স ছিল ১ মাস। বাড়ি গাজার আলরিমালে। লেগে আছে ৩ বছরের মিশক জৌদার লাশের গন্ধ৷ সে থাকত গাজার আল নুসিরাতে। মধ্য লন্ডন জুড়ে অসংখ্য পোস্টারে এই সব ঝরে যাওয়া কুঁড়িদের নাম ও ছবি। গাজা থেকে কত দূর বেথলেহেম?
করবিনের ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৮৫ বছরের ইহুদি বৃদ্ধা এস্থার, হাতে ব্যানার, 'নট ইন মাই নেম'। লম্বা কালো টুপি, কালো কোট, বিনুনি বাঁধা চুলের জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিরা দাঁড়িয়ে আছেন সার বেঁধে। বুকে ব্যানার, 'জায়নবাদ ধ্বংস হোক, স্বাধীন হোক প্যালেস্তাইন'। আর আছেন অ্যালেক্স গ্রিফিথ। গত দু'মাসে সবক'টি যুদ্ধবিরোধী জমায়েতে দেখেছি এই বৃদ্ধকে৷ কখনও স্লোগান দেন না। মুখে স্মিত হাসি৷ হাতে একটা মাঝারি সাইজের পোস্টার, 'যিশু, তুমি গাজার শিশুদের পাশে থেক। ওরা নির্দোষ।'
৭৪ বছরের বৃদ্ধ জেরেমি বলছিলেন বড়দিনের গল্প। তাঁর বড় হওয়ার দিনগুলিতে কেমন ছিল ডিসেম্বর? একটু একটু করে সাজানো হতো বাড়ি৷ ডিনার টেবিলে থাকত কিছু বিশেষ আয়োজন। যত্নে বানানো কেকের গন্ধে ম ম করত ঘর। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। খেতে বসে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন বাবা-মা। সেই আলোচনায় ঢুকে পড়তেন কেনিয়ার মাও মাও বিদ্রোহীরা, ঢুকে পড়তেন লুলুম্বা- কেমন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী থাবায় রক্তাক্ত হচ্ছে কেনিয়া, আলজিরিয়ায় বুকে বসে যাচ্ছে ফরাসি নখের দাগ এবং ভিয়েতনামের অলৌকিক প্রতিরোধ। করবিন বলছিলেন, তিনি বড় হলেন প্যাট্রিক লুলুম্বার কথা শুনতে শুনতে। বড় হওয়ার পর দেখলেন ভিয়েতনামিরা সাম্রাজ্যবাদের শিকড় ধরে নাড়িয়ে দিচ্ছেন। ইতিহাস তৈরি করছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। আটের দশকে তিনি যখন রাজনীতি করছেন, তখন খুন হয়ে যাচ্ছেন থমাস শংকরা।
আরও পড়ুন- ইজরায়েল গাজা যুদ্ধে ভারত কী চায়? উত্তর লুকিয়ে ৭৩ বছর আগের এই ঘটনায়…
হাজার হাজার জনতার দিকে তাকিয়ে করবিন বলছেন, 'এই বড়দিন গাজার শিশুদের, যারা হাজারে হাজারে মরে যাচ্ছে প্রতিদিন, যাদের বিশুদ্ধ জলটুকু পর্যন্ত দিতে পারছে না সভ্যতা। এই বড়দিন সেই সব গর্ভবতী মায়েদের, যাদের খুন করছে ইজরায়েল।' রোম যখন পুড়ছিল, প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন নিরো। হাজার হাজার শিশুর লাশ দু'পায়ে মাড়িয়ে ভেটো দিচ্ছে আমেরিকা। গণহত্যা চলছেই। আপামর ব্রিটিশ নাগরিকের করের টাকায় নেতানিয়াহুর রক্তমাখা হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন ঋষি সুনক। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অ্যালেক্স গর্ডন বলছিলেন, 'মানবতার দোহাই, এই বড়দিনের প্রতিটি ক্রিসমাস ট্রি-র প্রতিটি পাতা বরাদ্দ থাক গাজার শিশুদের জন্য৷ যারা মরে গেল এবং যারা কোনওমতে বেঁচে গিয়ে মরে থাকবে, তাদের জন্য। যুদ্ধ একদিন শেষ হবে, কিন্তু অন্তহীন ট্রমায় থেঁতলে যাবে যে শিশুদের আগামী, তাদের সকলের জন্য কাঁদুক লন্ডন। সেই কান্না আগুন হয়ে উঠুক যুদ্ধের নামে এথনিক ক্লিনজিং-এর বিরোধিতায়। আরও লক্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হন জানুয়ারির মিছিলে।' অতিবৃদ্ধ কেন লোচও শামিল ব্রিস্টলের মিছিলে। জীবন্ত কিংবদন্তি পরিচালকও ঘাড়ধাক্কা খেয়েছেন লেবার পার্টি থেকে, করবিনের মতোই৷ এই বয়সেও দমে যাননি একফোঁটা। তৈরি করেছেন 'ফর দ্য মেনি' নেটওয়ার্ক। বলছিলেন, 'প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়ানো একজন মানুষের মানবিক হয়ে ওঠার প্রাকশর্ত। বলছিলেন, ইতিহাসে এমন কয়েকটা মুহূর্ত আসে, যখন পক্ষ না নেওয়া অপরাধ৷ এখন তেমনই এক মুহূর্ত।'
ডিসেম্বরের লন্ডন বড় সুন্দর। আমার প্যাডিংটনের আস্তানা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ওয়েস্টমিনস্টার, ভিক্টোরিয়া বা কিংস ক্রস। রাস্তাগুলো আলো দিয়ে সাজানো। ঝলমল করছে ক্রিসমাস ট্রি। দোকানগুলোয় উপচে পড়ছে ভিড়। রাস্তায় পশ্চিমবঙ্গের টোটোর মতো রিকশ। এখানে বলে সিভিক ট্যাক্সি৷ প্রমোদভ্রমণের জন্য আদর্শ। এইসব এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, পৃথিবীতে কোথাও কোনও যুদ্ধ নেই, মৃত্যু নেই, কোথাও হাজার হাজার শিশু লাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে না। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো পোস্টার- 'ফ্রি প্যালেস্তাইন' বা 'স্টপ জেনোসাইড'- ওটুকু তো উপেক্ষা করাই যায়। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসে৷ চোখের সামনে ভাসে আয়েষা আওয়াদের মুখ। প্যালেস্তাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেনের হয়ে ডকুমেন্টেশনর কাজে ভিডিও কলে কথা বলেছিলাম আয়েষার সঙ্গে৷ নর্থ গাজায় আটকে আছে ৩১ বছরের মেয়েটি৷ তিন সন্তানের মধ্যে দু'জন মৃত, আরেকটি মায়ের কোল আঁকড়ে, দেড় বছরের। আয়েষার স্বামীর খোঁজ নেই বহুদিন। সে পিএলএফপির সদস্য। আয়েষার খোঁজ দিয়েছিলেন বেন জামাল, প্যালেস্তাইন আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। বলেছিলেন, গোটা ব্রিটেন জুড়ে ছড়িয়ে আছেন আয়েষার মতো অসংখ্য ফিলিস্তিনির স্বজনরা। কারও দুটো পা নেই, উড়ে গিয়েছে ইজরায়েলি হানায়। কারও চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ কেউ পরিবারের সকলকে হারিয়েছেন দ্বিতীয় ইন্তিফাদায়। গত দু'মাস এমন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শিউরে উঠেছি বারবার৷ এই মানুষগুলি যে কেবল বেঁচে আছেন তাই নয়, প্রতিটি মিছিলে অংশ নিচ্ছেন প্রবল প্রাণশক্তিতে। আমি ভিয়েতকংদের দেখিনি, কিন্তু দেখেছি ইব্রাহিমকে। দু'পা হারানো মানুষটি হুইলচেয়ারে বসে নেতৃত্ব দেন মিছিলের৷ ওয়েস্টমিনস্টার টিউব স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে চার্চিলের মূর্তি। তার পিছনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। ইব্রাহিম আমাকে বলছিলেন, ইজরায়েল যদি গোটা গাজাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, তাও প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যাবে। আমি বলছিলাম, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, বলছিলাম দেশভাগ, তিন টুকরো হওয়া স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন- মেরুদণ্ড টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ইজরায়েলি বোমা! যেভাবে অথর্ব হচ্ছে গাজার শিশুরা
অক্সফোর্ড সার্কাস, ব্রড স্ট্রিটের অভিজাত রাস্তাঘাট ছুঁয়ে উঠে পড়ি বাসে। অল্ডগেট বা হোয়াইটচ্যাপেলের দিকে যাব- বাংলাদেশি পাড়ায়। এই এলাকা অন্যরকম। প্রচুর অভিবাসীর বাস। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা মানুষ গুছিয়ে বসেছেন৷ একটু দূরেই কেবল স্ট্রিট, যেখানে 'ব্রিটেনের হিটলার' মোসলেকে রুখে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্ট আর শ্রমিকরা। সেই কোনকালে জাহাজি বাঙালিরা এসেছিলেন এখানে। এখন তো রীতিমতো জমাটি বাংলা টাউন। হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনের নাম লেখা বাংলায়। সেলুনে, ছোট দোকানে উড়ছে প্যালেস্তাইনের পতাকা। ব্রিক লেনে ভর্তা-ভাত খেয়ে বেরিয়ে দেখলাম, আরব খ্রিস্টানরা জমা হয়েছেন আলতাব আলি পার্কে। বড়দিনের প্রাক্কালে খুন হওয়া মানুষদের স্মরণে গানের উৎসবে। আলতাব আলি ছিলেন লন্ডনে কর্মরত বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিক। ১৯৭৮ সালে তাঁকে খুন করে বর্ণবিদ্বেষীরা। তাঁর নামেই পার্ক। সেখানে শহিদ মিনার, ঠিক ঢাকার মতোই। এই পার্ক এখন হয়ে উঠছে পূর্ব লন্ডনের যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, একজন শহিদ বাঙালি মিলিয়ে দিচ্ছেন গাজার গণহত্যা বিরোধী আন্দোলনের সংহতিতে আসা মানুষদের।
ডিসেম্বরের লন্ডন কি বিষণ্ণ? একদম নয়। সে আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে আছে ক্রোধ এবং নির্লিপ্তিতে। উৎসবমুখর অভিজাত লন্ডন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে গাজার বুকে ঘটে চলা এথনিক ক্লিনজিংয়ের দিক থেকে। তার কিছু যায় আসে না কয়েক হাজার আরবের মৃত্যুতে। যেমন যায় আসেনি জালিয়ানওয়ালাবাগ বা মালয়ের গণহত্যায়। ঠিক তখনই লন্ডনের পেটের মধ্যে থাকা আরও অনেকগুলি লন্ডনের বুকে দাউদাউ জ্বলছে ক্রোধের আগুন। উৎসবের দিনগুলি সে প্রস্তুত করছে নিজেকে৷ জানুয়ারিতে আন্দোলনের নতুন বিস্ফোরণ ঘটাবে বলে।