জ্যান্ত অজগরের আরাধনা পাইথন মন্দিরে, দুর্বলচিত্তদের প্রবেশ নিষেধ
Python Temple: ওয়াইদাহের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে সাপের অস্তিত্ব।
সাপ মাত্রেই ভয়াবহ, বিষধর, এমন একটা আতঙ্ক বা ভাবনা কাজ করে কমবেশি প্রত্যেকের মধ্যেই। গালভরা একটি নামও রয়েছে এই ভয়ের। ওফিডিওফোবিয়া। যার প্রকোপ থেকে বাদ যায় না নির্বিষরাও। সেই সব ভয় আর আতঙ্কের বলি বিনা কারণে হতে হয় তাদেরও। সেই মঙ্গলকাব্যের সময় থেকেই আমরা দেখে এসেছি, ভয়কে জয় করতে তাকেই আরাধনার গল্প। সে চণ্ডীমঙ্গলকাব্য হোক বা মনসামঙ্গল কিংবা শিবায়ণ কাব্যের কথাই ধরা যাক না কেন! সুন্দরবনের মতো খাঁড়ি এলাকায় বাঘের হাত থেকে বাঁচতে তাই পুজো করা হয় বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের। কখনও মহামারী এড়াতে পূজিত হন দেবী শীতলা। এমনই ভয়কে বরাবর ভক্তি দিয়ে জয় করতে চেয়েছেন মানুষ।
শুধু গ্রামবাংলাতেই নয়, এমন কাহিনি বোধহয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সমস্ত দেশের উপকথাতেই। আমাদের পুরাণ জুড়েও সাপের অস্তিত্ব রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কখনও মহাদেবের গলায় সে শোভে, তো কখনও বেহুলা-লখিন্দরের বাসরে। সর্পকূলকে নিয়ে ভক্তি এবং আশঙ্কা, কোনওটারই কমতি ছিল না এ বঙ্গদেশে। তবে শুধু বঙ্গদেশেই নয়, সুদূর আফ্রিকাতেও রয়েছে এমনই রেওয়াজ। শুধু লোকাচার বা উপকথাতে নয়, সাপেদের জন্য সেখানে রয়েছে আস্ত একটি মন্দিরও।
আরও পড়ুন: মাঝ সমুদ্রে মন্দির, পাহারায় থাকে শতাধিক বিষধর সাপ! ৬০০ বছরের পুরনো এই স্থান আজও বিস্ময়
শিবভক্ত চাঁদ সওদাগর যে হাতে শিবপুজো করেন, সেই হাতে অন্ত্যজ দেবী মনসার পুজো দিতে চাননি। সেই অহংকার ভাঙতে উঠেপড়ে লাগেন মনসা। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল চাঁদবণিক-সনকার গোটা পরিবার। অবশেষে মনসার পুজো বাঁ হাতে দিতে রাজি হন চাঁদবণিক। স্বীকৃত হয় মনসার দেবীত্ব। চাঁদের পরিবারেও ফেরে সংসারে শান্তি। দেবী মনসার মন্দির খুঁজলে এ দেশে অনেক মিলবে। তবে আফ্রিকার এই সাপের মন্দির, তার থেকে অনেকটাই আলাদা। কারণ যে সে সাপ নয়, আফ্রিকায় আরাধনা করা হয় খোদ পাইথনের। না, মূর্তিপুজো নয়। খোদ অজগরেরাই সেখানে আরাধ্য। এমনই আশ্চর্য মন্দির রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বেনিন রিপাবলিকের ওয়াইদাহ শহরে। দেখলে মনে হবে, সাধারণ একটি বাড়ি। কিন্তু ভিতরে ঢুকে বিস্ময় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। মন্দিরের ভিতরে যত্রতত্র মিলবে 'তেনাদের' দেখা। কোথাও কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে দু-তিনটি অজগর, তো কোথাও রাখা মূর্তির গলা পেঁচিয়ে বসে ইয়াব্বড় আরও একটি। দুর্বল হৃদয়রা এই দৃশ্য দেখে ভিরমি খেতেই পারেন। তবে আফ্রিকার মানুষদের জন্য এ দৃশ্য বড়ই সুখের। আফ্রিকার এই মন্দিরে পাইথনকে ভয় করা তো দূর, বরং তাদের যত্নআত্তি করাই দস্তুর।
দক্ষিণ আফ্রিকা মানেই জঙ্গল। স্বাভাবিক ভাবেই পর্যটকেরা যতটা জঙ্গল সাফারির দিকে ঝোঁকেন, ততটা দেশের অন্যান্য় জায়গাগুলি ঘুরে দেখার দিকে মন দেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে সাংস্কৃতিক ভাবেও যথেষ্ট পুষ্ট দেশটি। বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকায় তো বেশ কয়েকটি ধর্মীয়স্থান রয়েছে দ্রষ্টব্য। যার মধ্যে একটি হল এই পাইথন মন্দির। বেনিন রিপাবলিকের অবস্থান আদতে পশ্চিম আফ্রিকার কাছে। পাশেই রয়েছে নাইজিরিয়া, টোগো, নাইজার রিপাবলিক ও বুর্কিনা ফাসোর সীমান্ত। বেনিন রিপাবলিকর রাজধানী পোর্ট নাভো হলেও গোটা প্রদেশের অর্থনৈতিক বন্দর বলা যেতে পারে কোটনউ শহরটিকেই।
সপ্তদশ শতাব্দীতে এই বেনিন রিপাবলিক পরিচিত ছিল দাহোমে সাম্রাজ্য নামে। ক্রিতদাস কেনাবেচার জন্যেও সে সময় বিশেষ জনপ্রিয় ছিল এই উপকূল-রাজ্যটি। বেনিন রিপাবলিকে মূলত বাস ভোদুন সম্প্রদায়ের। আর তাঁদেরই আরাধ্য এই অজগরেরা। শুধু বেনিনই নয়, টোগো, ঘানা-সহ পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বহু দেশেই অজগর আরাধনা করার রীতি রয়েছে। ভোদুন সম্প্রদায়ের কাছে সাপকে তাঁদের ধর্মের প্রতীক বলা চলে। স্থানীয় বিশ্বাস, জীবিত ও আত্মার সঙ্গে যোগস্থাপন করেন ভোদুনদের দেবতা ড্যান, আর তিনি আদতে রামধনু রঙের একটি সাপ। ফলে বোঝাই যায়, ওয়াইদাহের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে সাপের অস্তিত্ব।
১৭০০ শতকের সময়কার ঘটনা সেটা। ওয়াইদাহের রাজ্যে হামলা চালায় শত্রুরা। প্রাণে বাঁচতে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন রাজা। শত্রুরা তাঁর পিছু নিয়ে ঢোকে জঙ্গলে। তবে রাজার সুরক্ষায় এগিয়ে আসে অজগরেরা। তাঁর চুলের ডগাও স্পর্শ করতে পারেনি হামলাকারীরা। কৃতজ্ঞ রাজা অজগরদের জন্য তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে দেন। এমনই নানা গল্প ঘোরে ওয়াইদাহের হাওয়ায়।
কংক্রিটের বাড়ি, মাথায় পোড়ামাটির চাল। মন্দিরের ভিতরে ঢুকলে বুঝতে পারবেন, নানা প্রজাতির পাইথন রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আর তাদের সকলকেই দেবজ্ঞানে পুজো করে ওয়াইদাহবাসী। কম করে হলেও ৬০টির কাছাকাছি অজগর রয়েছে এই মন্দিরে। তাদের নিয়মিত সেবার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব সুবিধাই রয়েছে এখানে। না, নিত্যভোগ এখানে পান না দেবতা। বরং সপ্তাহে এক-দু'বার ইঁদুর এবং মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয় শিকারের জন্য। না, এক জায়গায় বন্দি হয়ে থাকতে মোটেও পছন্দ করেন না এই মন্দিরের দেবতারা। তাই মাঝেমধ্যেই স্থানীয়দের বাড়িতে ঢুঁ দেয় তারা। ভয় পাওয়া বা তাড়ানো তো দূর, এতে বাসিন্দারা নিজেদের ভাগ্যবানই মনে করেন।
আরও পড়ুন: জ্যান্ত বিষধর সাপের পুজো! এই মন্দিরে মানুষ ও সাপের সম্পর্ক আজও অটুট
এই সব অজগরেরা কার্যতই 'ছোটে না সে হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না'। এখনও পর্যন্ত এরা কারওর উপরে হামলা করেছে বলেও শোনা যায়নি। দর্শনার্থীরা চাইলেই এইসব অজগরকে হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। চাইলে ছবিও তুলতে পারেন অজগরদের সঙ্গে। শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়। ওয়াইদাহবাসী কাছে এ স্থান আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থানও বটে। তাদের বিশ্বাস, জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে সেতু বেঁধে দিতে এই মন্দিরে অধীন করেন স্বয়ং ড্যান। ওয়াইদাহতে অজগর-হত্যা শুধু অধর্মই নয়, আইনত দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। বেনিন রিপাবলিকে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে পাইথন টেম্পল দিনে দিনে হয়ে উঠেছে অন্যতম অ্যাডভেঞ্চার স্পট। কথায় বলে, 'বন্যেরা বনে সুন্দর'। তবে এই পাইথন মন্দিরে অজগরেরা রয়েছে জঙ্গলের মতোই স্বাধীনতায়। আর এটাই যেন এই জায়গার ইউএসপি হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।