নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনের পরও যেসব প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে

Election Commission: অভিযোগ উঠেছিল, এসআইআর, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (National Register of Citizens) চালু করার প্রথম ধাপ। নির্বাচন কমিশন এই নিয়েও কিছুই বলেনি।

১৭ অগাস্ট নির্বাচন কমিশন যখন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে হলফনামা পেশ করার দাবি করছে তখনও রাহুল গান্ধী বিহারে কমিশনের বিরুদ্ধে 'ভোট চুরি'র অভিযোগ তুলছিলেন। ‘ভোট চুরি’ বিতর্কে নাম না-করে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে নিশানা করে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তাঁর দাবির সপক্ষে এক সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা জমা দিতে হবে। অন্যথায় ক্ষমা চাইতে হবে রাহুলকে। এ ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই বলে স্পষ্ট জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই দিন (১৭ অগাস্ট) দিল্লি থেকে সাংবাদিক বৈঠকে করে এমনটাই জানিয়েছে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনের পরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী ৭ অগাস্ট 'ভোট চুরি'র নিয়ে যা যা অভিযোগ তুলেছিলেন, তার একটারও সদুত্তর মিলল না নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনে, এমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। তাঁদের দাবি, কমিশন এমন কোনো উত্তর দেয়নি যা থেকে বোঝা যাবে রাহুল গান্ধী যা অভিযোগ তুলেছেন তা ভুল।

রাহুল তথ্য দিয়ে বলেছিল, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটচুরি হয়েছিল বেঙ্গালুরুর বিধানসভা কেন্দ্র মহাদেবপুরায়। বেঙ্গালুরুর সেন্ট্রালের অধীনে এই বিধানসভা কেন্দ্র। তিনি বলেছিলেন, মূলত ফর্ম ৬ ব্যবহার করে জাল ছবি, জাল ঠিকানা দিয়ে নতুন ভোটাদের নাম তালিকায় যোগ করা হয়। এই ফর্ম ১৮-২৫ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য। শুধুমাত্র জন্ম শংসাপত্রে নিজের সই থাকলেই এই ফর্ম ভরা যায়। কিন্তু দেখা গিয়েছে, মহাদেবপুরের ৩২,৭০৭ নতুন ভোটারদের বেশির ভাগেরই বয়স ৯৭-৯৮। এই দিন মহাদেবপুরা নিয়ে কোনো মন্তব্যই করেনি ইলেকশন কমিশন।

আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধী, ক্রমেই ভরসাযোগ্য হয়ে উঠছেন যেভাবে

কমিশন বলেছে এক-দুটো ভুলের তদন্ত ডিএম করে নেয়, কিন্তু দেড় লক্ষ ভুয়ো ভোটারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এর প্রমাণ দিতে হবে রাহুল গান্ধীকেই। কমিশনের দাবি, ওই দেড় লক্ষ ভোটারকে ডিএম এর অফিসে ডাকা সম্ভব নয়। প্রশ্ন উঠছে, কেন এই তদন্ত ডিএম করতে পারবেন না? কেন বিএলও বা এসডিএম এর টিম ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য যাচাই করতে পারবেন না? নির্বাচন কমিশন বলেছিল, এসআইআর (SIR) ভোটার লিস্টকে ঝাড়াই-বাছাই করে 'সন্দেহমুক্ত' করবে। এর জন্য কমিশন ১ মাসে বিহারের ৮ কোটি ভোটারের ঘরে যাওয়ার দাবি করেছিল। প্রশ্ন হল, তাহলে কেন এখন দেড় লক্ষ ভোটারের বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়?

নির্বাচন কমিশন বারবার দাবি করেছে রাহুল গান্ধীকে হলফনামা দিতে হবে অন্যথায় ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যদিকে, বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর ৫ কেন্দ্রের ভোট চুরির অভিযোগ তুলেছেন। তৃণমূলের দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবার নিয়ে অনুরাগের দাবি, গত চার বছরে ডায়মন্ড হারবারের ৩০১টি বুথে ১৫ শতাংশ ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নিয়ে অনুরাগ ঠাকুর যা চাইছেন তা-ও করতে পারছেন। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি এবার বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুরের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করবে নির্বাচন কমিশন?

কমিশনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন নির্বাচনের মাত্র কিছু মাস আগে এসআইআর-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? তাছাড়া এমনিতেই এই সময় রাজ্যটি বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২০০৩ সালেও জুলাই থেকে অগাস্টেই এই প্রক্রিয়া চালানো হয়েছিল। কিন্তু কেন এত কম সময়ে এসআইআর-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এই নিয়ে নির্বাচন কমিশন কিছু জানায়নি।

আরও পড়ুন- মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই ইলেকশন কমিশনের কাজ?

আবার নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে হঠাৎই বিহারের ভোটার তালিকার চরিত্র বদলে যেতে দেখা গেল। নিবিড় সংশোধনের প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ১ অগাস্ট কমিশন ‘মেশিন রিডেবল’ তালিকা প্রকাশ করেছিল, এই ফাইলটি কম্পিউটারের মাধ্যমে সার্চ করা সম্ভব ছিল। মেশিন রিডেবল তালিকা থেকে কোনো তথ্য এবং তথ্যের অসঙ্গতি খুঁজে বের করা সহজ। কিন্তু দেখা গেল কিছু দিনের মধ্যেই তালিকার ধরণ বদলে গেল। মেশিন রিডেবল ফরম্যাট সরিয়ে শুধু ছবি দিয়েছে কমিশন। এর ফলে তালিকার ছবি আর সরাসরি কম্পিউটারের মাধ্যমে সার্চ করা যাবে না। এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন আদালতকে জানায়, বিহারে নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় কার নাম এবং কেন বাদ পড়ল, তা যে জানাতেই হবে এমন কোনো আইন নেই। এই সব কিছুর পর বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, কর্নাটকের পরে বিহারের তালিকা নিয়েও যাতে এমন নিখুঁত তথ্য যাচাই না করা যায়, তা এড়াতেই কমিশন এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন ৭ অগাস্টের তাদের সাংবাদিক সম্মেলনে মেশিন রিডেবল ফরমেট সরানো নিয়েও কোনো সদুত্তর দেয়নি। অভিযোগ উঠেছিল, এসআইআর, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (National Register of Citizens) চালু করার প্রথম ধাপ। নির্বাচন কমিশন এই নিয়েও কিছুই বলেনি।

সম্প্রতি দেখা গেল, নির্বাচন কমিশন যাঁদের মৃতের তালিকায় রেখেছে, তাঁরা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে চা খেলেন। ১৪ অগাস্ট এমন সাত জন ভোটারের সঙ্গে দেখা করে, চা খেয়েছিলেন রাহুল। জানা গিয়েছে, ওই সাত জন ব্যক্তি আসলে তেজস্বী যাদবের বিধানসভা কেন্দ্র রাঘোপুরের বাসিন্দা। একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে এমন ৫০ জনের নাম মৃত দাবি করে খসড়া তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

'রিপোর্টারস কালেকটিভ'-এর আয়ুষী কর এবং বিষ্ণু নারায়ণ বিহারের তিনটি বিধানসভা আসনে সমীক্ষা করেছেন। সেই সমীক্ষাতেও উঠে এসেছে, একটি বাড়িতে ৫০৯ জন পর্যন্ত ভোটারের নাম রয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে বিপুল সংখ্যক 'ভোটার' যুক্ত বাড়িগুলির কোনো অস্তিত্বই নেই। তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে মোট ৮০ হাজার সন্দেহজনক ভোটার পাওয়া গিয়েছে। যা মোট ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এমন একের পর এক অভিযোগ উঠলেও তারা সবটাই এড়িয়ে গেল। একটিরও সদুত্তর মিলল না। প্রশ্ন উঠছে, বিরোধীদের সংশয়ই কি তবে সত্য?

More Articles