'ইন্সট্যান্ট' বিপ্লব হয় না! বামেদের এখন যে পথে হাঁটতে হবে...
Rabin Deb: এটা নীতির লড়াই, স্পষ্টত দুই দৃষ্টিভঙ্গির লড়াই। আন্দোলন, বিপ্লব, সংগ্রামে জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন আছে। এটাই বিজ্ঞান, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে এগনো যায় না।
সালটা ১৯৬৫। কলকাতায় এসে তখন সদ্য সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হয়েছি। ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। ওপার বাংলায় থাকাকালীন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছোট বয়স থেকেই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়েছিলাম। তারপরে ১৯৬৫ সালের ১ অগাস্ট সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হয়েই ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়লাম। তখন বিপিএসএফের দু’টি ঠিকানা, ৯৩/১এ বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট (সুভাষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে) আর অন্যটি ১৮৬ বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট (পল্টু দাশগুপ্তের নেতৃত্বে)। সেই থেকেই ছাত্র আন্দোলন, যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অংশ নিয়েছি কেরোসিনের দাবিতে আন্দোলন (নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইত শহিদ), খাদ্য আন্দোলন, বন্দি মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে। আন্দোলনের তরঙ্গ শীর্ষে রাজ্যের প্রথম অকংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট সরকার, ১৯৬৯ সালের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার ফলে গণ আন্দোলনের যে বিকশিত রূপ তাতেও সামিল ছিলাম। আবার এই দুই সরকারের পতনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং ৭২ সালের পরবর্তীতে আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস ও জরুরি অবস্থার প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নানা আঁকাবাঁকা পথে ছাত্রযুব আন্দোলনের কর্মী হিসেবে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছি। সেই সময়েও গ্রামে, শহরে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শহিদ মিনার ময়দান, এমনকী ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডেও অসংখ্য সভা সমাবেশ বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে যেখানে ছাত্রযুবদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর নতুন পরিস্থিতিতে দীনেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে যুব আন্দোলন এবং বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য গণ সংগঠনগুলির পাশে ছাত্র যুবদের সামিল করার নতুন মাত্রা যুক্ত করে। বামফ্রন্ট সরকারের জনস্বার্থবাহী কর্মসূচি রূপায়ণ ও সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে ছাত্র যুব সংগঠন সেখানেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজ্যের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতীক (হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, বক্রেশ্বর ও ফরাক্কায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সল্টলেক ইলেক্ট্রনিক্স) এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। গড়ে ওঠে, রক্ত দিয়ে গড়ার শপথ। ধ্বংসের বিরুদ্ধে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ছাত্র যুবদের অংশগ্রহণ জনমনে ইতিবাচক সাড়া দেয়। এরই পরিণতিতে ব্লক, শহর, জেলা বিকেন্দ্রীভূত জমায়েতের শীর্ষে ১৯৮৭ সালের ২৩ অগাস্ট ব্রিগেডে প্রথম যুব সমাবেশ সংগঠিত হয়। ২০ সেপ্টেম্বরের ধর্মতলার জমায়েত মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই ১৯৮৭ সালের কথা। কল্লোলিনী কলকাতায় যৌবনের ঢল নেমেছিল। জ্যোতি বসু মঞ্চে উঠে বলেছিলেন, “এমন যুব সমাবেশ দেখিনি।”
১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর কেরলের তিরুবনন্তপুরমের কনফারেন্সে এসএফআই তৈরি হল প্রথম। সেই প্রতিষ্ঠা দিবসের কনফারেন্সে আমিও অংশ নিই। কলেজের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে ধীরে ধীরে ইউনিট সেক্রেটারি, তারপর লোকাল কমিটির প্রেসিডেন্ট। ছাত্র আন্দোলন বাংলায় রোজ ইতিহাস গড়ছে বলা যায়। কলেজের আন্দোলনের পাশাপাশি আমাকে সামলাতে হত পানিহাটিও। পানিহাটিতে বাড়ি ছিল আমাদের। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই পানিহাটিতে আগরপাড়ায় আমি ছাত্র ফেডারেশনের ইউনিট তৈরি করি। তার প্রথম সম্পাদক ছিলাম আমি। একদিকে কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথে তখন ছাত্র সংগঠনের কাজ চলছে, এদিকে আবার পানিহাটিতে আমার এলাকাতেও সংগঠন তৈরি করছি। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর সিপিআইএমের সদস্য হলাম। দমদম নাগেরবাজারে ক্লাইভ হাউজ ময়দানে এসএফআইয়ের প্রস্তুতি সভা হল, তারপরেই সেই সর্বভারতীয় সম্মেলনে জন্ম হল স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার। ওটাই আমার শেষ সম্মেলন। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল ইউকো ব্যাঙ্কের চাকরি পেলাম, নিউ আলিপুরের ব্রাঞ্চে। তখন ছাত্র আন্দোলন থেকে বিদায় নিয়ে যুব ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হই।
আরও পড়ুন- বারবার সুযোগ পেয়েও ‘ঐতিহাসিক ভুল’, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস
তখন ছাত্রযুব আন্দোলনে বিরাম নেই কোনও, ভিয়েতনামের লড়াইয়ের সমর্থনে আন্দোলন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিলিতে সালভাদোর আলেন্দেকে হত্যার প্রতিবাদে ১৩ সেপ্টেম্বর দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীরা মিছিলের ডাক দেন। সেই আন্দোলনের ফল হাতে গরমে না মিললেও, এই এত বছর পর চিলিতে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি। আসলে জাতীয় পরিস্থিতি, স্থানীয় সমস্যা, শিক্ষা, চাকরির দাবি, বেকার ভাতার দাবি, সমস্ত আন্দোলনগুলিতেই ছাত্রদের ব্যাপক অংশ ছিল। ছাত্রযুবর বিশাল বিশাল সমাবেশ, জমায়েত হয়েছে প্রথমে বিপিএসএফ, পরবর্তীতে এসএফআইয়ের ডাকে, যুব আন্দোলনের ক্ষেত্রে ডিওয়াইএফ ও পরবর্তীতে ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে।
১৯৮৪ সালে বর্ধমান সম্মেলনে যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক হলাম আমি, যে দায়িত্ব এখন সামলাচ্ছে মীনাক্ষি মুখার্জি। প্রথমে সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তারপর হয়েছিলেন বরেণ বসু, তারপর আমিও হই। তারপর দীর্ঘকালের সফর। এর মাঝে আমি চাকরি ছেড়েছি। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৭ সালে অবধি চাকরি করেছি। তারপর সংগঠনের স্বার্থে আমি দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যাই। সল্টলেকের সম্মেলনে ১৯৯১ সালে আমরা মানব মুখার্জিকে সম্পাদক হিসেবে পাই, আমরা দায়িত্ব থেকে সরে আসি। সর্বভারতীয় সম্মেলন হয় মুম্বইতে, সেখানে মহম্মদ সেলিম সম্পাদক হন।
সেই সময়ের যুব আন্দোলন লাগাতার আক্রমণ, হিংসার মুখে পড়েছে, উঠেও দাঁড়িয়েছে। আমাদের সময় চারদিক থেকে আক্রমণ। মিসা, বিনা বিচারে আটক, প্রিভেনশন অব ডিটেনশন অ্যাক্ট, এগুলোকে উপেক্ষা করেই লড়েছি সবাই। এখন যেমন আক্রমণ হচ্ছে, তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও মারাত্মক রকমের আক্রমণ হয়েছে ছাত্রদের উপরে। মনে আছে, ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সুরেন্দ্র নাথ ল কলেজের রেজাল্ট বের করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ১৯৭১-এ দক্ষিণ কলকাতায় গণেশ ঘোষকে হারিয়ে সাংসদ হন, তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেন না বলে গোটা পরীক্ষার ফলাফল ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন। অতুল গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথের ছবি পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছিল কংগ্রেস। সেই সময় এই ভাঙচুর ছিল ব্যাপক ঘটনা। আমরা কলেজে জমায়েত করি, কলেজ স্কোয়ারে জমায়েত করি শিক্ষার অধিকারের দাবিতে।
তার আগে ১৯৬৯ সালের ১৩ মে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চালু রাখার জন্য পাহারা দিচ্ছে ছাত্রযুবরা। তখন নকশালরা বুর্জোয়া শিক্ষা ধ্বংসের নামে পরীক্ষা ভণ্ডুলের চেষ্টা করছিল। আসলে পরীক্ষা ভণ্ডুল করার জন্য নকশালরা কংগ্রেসের সঙ্গে যোগযোগ রেখে বাম আন্দোলনকে বিপথে চালিত করতে চেয়েছিল। পরীক্ষা চালু রাখতে গিয়ে আমাদের এক যুব কর্মী খুন হয়েছিলেন, নাম ছিল কৃষ্ণ রায়। তখন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি ভট্টাচার্য ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী আর তথ্যমন্ত্রী ছিলেন সোমনাথ লাহিড়ি, অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী। ছাত্র যুব, সমস্ত নেতৃত্ব মিলে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে জমায়েতে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। সেই ছিল এক বিশাল স্বতস্ফূর্ত মিছিল। ২০ সেপ্টেম্বরের মিছিল নিয়ে সকলেই বলছে, সবাই লিখছে ব্যাপক জমায়েত। সেই সময় কৃষ্ণ রায় হত্যার বিরুদ্ধে এরকমই ব্যাপক সমাবেশ হয়। একদিকে নকশালরা বলছে বুর্জোয়া শিক্ষা ধ্বংস হোক, অন্যদিকে আমরা বলেছিলাম, শিক্ষার সম্প্রসারণ হোক।
যুব আন্দোলনের নেতৃত্বে এসে সেই বিশাল অভিজ্ঞতা হল। সেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে কোনও গণ সংগঠনের, ডিওয়াইএফআইয়ের ব্রিগেডে সভা হল, ১৯৮৭ সালের ২৩ অগাস্ট। আমরা আড়াই লক্ষ মানুষের জমায়েত করেছিলাম। ঐতিহাসিক সেই মুহূর্ত, ৩ দিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিল, নাহলে আরও মানুষ আসতেন। স্বাধীনতার পর সেই প্রথম কোনও যুব সংগঠন ব্রিগেডে জমায়েত করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তখন সভাপতি বরেণ বসু আর আমি সম্পাদক। তারও আগে ১৯৮৬ সালের ২৩ অগাস্ট বাঁকুড়ার রায়পুরে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী এক যুব সমাবেশ হয়। তবে ২০ সেপ্টেম্বরে সমাবেশ নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। ১৯৭২ সালে এ রাজ্যে বামপন্থীরা ১৪ টা সিট পেয়েছিল। কিন্তু একজনও বিধানসভায় যায়নি। তখনও শূন্য ছিলাম। ২০ তারিখও আমরা শূন্য হয়েই জমায়েত করেছি।
৭২ থেকে ৭৭ এর মধ্যে এমন অসংখ্য জমায়েত ছাত্রযুবরা করেছিল। ভিয়েতনামের বোমা বর্ষণের বিরুদ্ধে ৭ দিন ধরে অবস্থান হল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তীরা গ্রেফতার হলেন। কিন্তু অবস্থান নড়েনি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জনরা চেয়ার দখলের জন্য রাজ্যের যুবদের লড়িয়ে দিয়েছিল। আর অন্যদিকে আমরা ছাত্র যুবদের অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছি।
লড়াই চিরকালীন। জীবন জীবিকার জন্য সবাই তো এখন লড়ছে, পথ হাতড়াচ্ছে, আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনে কেউ যদি এসে আশ্বাস দেয়, আশ্বাসকে বিশ্বাস করাটা তো অপরাধ নয়। আশ্বাস দিয়ে বিশ্বাসভঙ্গ করাটাই অপরাধ। যারা শাসকদলের কাছে গিয়ে এখন আশ্বাস খুঁজছেন তাঁদের যন্ত্রণার জায়গাটা খুব স্পষ্ট। আন্দোলন মানে নেগোশিয়েশন, আন্দোলন মানে মেমোরেন্ডাম। আগে নিজেদের দাবিকে জনগ্রাহী করে তুলতে হবে। যাদের জন্য দাবি তাদের মধ্যেই আগে প্রচার করতে হবে, এটাই তো আন্দোলনের প্রোপাগান্ডা। তারপর বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং, জমায়েত। এরপরেও কথা না শুনলে ধর্মঘটের পথে যেতে হয়। ছাত্র আন্দোলনকেও এভাবেই এগোতে হবে ধাপে ধাপে। সব একসঙ্গে হয় না। নকশালরা এখানেই ফাউল করেছিল। ওরা প্রথমেই গাড়ি পুড়িয়ে দিল, জোতদারের গলা কাটার জন্য উঠে পড়ে লাগল।
একবার অসীম চট্টোপাধ্যায় যুবশক্তির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট হলে বক্তব্য রাখেন। অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “জোতদারের গলা কেটে ভেবেছিলাম লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থন পাব। হায়রে ভুল রাজনীতি, একজনও সঙ্গে থাকলেন না।” আসলে নকশাল আমলে আন্দোলন শুধু সঠিক নেতৃত্ব পায়নি তাই নয়, সঠিক স্লোগানও পায়নি। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপকে সঠিক মান্যতা দিতে হবে।
আরও পড়ুন- একচিলতে ঘরেই কেটে গেল জীবন, এনার্জিতে আশি বছরের বৃদ্ধ বিমান লজ্জায় ফেলবেন তরুণদেরও
অভাগীর স্বর্গে শরৎচন্দ্র বললেন, “কাঙালি দু’ঘণ্টার অভিজ্ঞতায় বুড়া হইয়া গেল।” ২ ঘণ্টাকে নির্মাণ করেছে কত কত অভিজ্ঞতা, সেগুলোই তো আসল। এখন যারা ‘বুড়োদের দল’ বলেন বামেদের সেসব মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতেই বলা। ইতিহাসটাকে জানতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন যুব ফেডারেশনের সেক্রেটারি হন ওঁর বয়স তখন ২৪ বছর বয়স। ৭১ সালে ২৭ বছর বয়সে তিনি দলের রাজ্য কমিটির মেম্বার হন। মন্ত্রী হলেন ৩৩ বছর বয়সে। উপেন কিস্কু, দেবলীনা হেমব্রম, সইফুদ্দিন চৌধুরীরা কবে শুরু করেছেন কাজ! আগেও তো যুবরা সামলেছেন সঠিক সময়ে। আসলে তখন তো আর এত ব্যাপকভাবে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ছিল না, সোশ্যাল মিডিয়া তো ছিলই না। কে পরিসংখ্যান রেখেছে যে দলে কত সংখ্যক তরুণ ছিল!
আসলে কমিউনিস্টরা যখনই সামান্যতম সাফল্য অর্জন করে তখনই মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়। শাসকদল তৃণমূল বলছে, শূন্য মানে বামেরা মুছে গেছে। আমরা তো মুছে যাইনি। আজকে সমস্ত খবরের কাগজ খুলে দেখতে পাচ্ছি সর্বত্র ডিওয়াইএফআই, এসএফআইয়ের নাম। অথচ ২০১১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১১ বছরে কত জমায়েত হয়েছে, সেসবের কোথায় খবর?
এই ‘মমতা একাদশী’ সময়কালে ছাত্র যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অনেক নব পন্থা ও পদ্ধতি আয়ত্তের মাধ্যমে ধাপে ধাপে আন্দোলন পরিচালনার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। বিজেপি এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে সমস্ত কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যে প্রত্যয় তৈরি করেছে তারই প্রতিফলন এই ২০ সেপ্টেম্বরের ছাত্র যুব সমাবেশ, ২ সেপ্টেম্বর ছাত্রজাঠার শীর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের সমাবেশ এবং ৯ সেপ্টেম্বর সিজিও কমপ্লেক্সে বামপন্থীদের সমাবেশ। ইনসাফ, কাজ, শিক্ষার দাবিতে আন্দোলনে বর্তমান সময়ে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। এই আন্দোলন সংগ্রামের যারা কারিগর তাঁদের প্রতি রইল উষ্ণ অভিনন্দন। এখান থেকেই দুষ্কৃতী, দুর্নীতির প্রতিভূ তৃণমূল এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপির বিরুদ্ধে এই সমাবেশ যে আহ্বান জানিয়েছে, যে শপথ নিয়েছে তাকে কার্যকরী করাটাই এখন চ্যালেঞ্জ।
আমি সংগঠন করব বলে চাকরি ছেড়েছি। এখনও অসংখ্য ছেলে মেয়ে হোলটাইমার হতে প্রস্তুত। এখন যে মুখ উঠে আসছে, অনেকেই তো চাকরি করত। আমাদের মীনাক্ষীও চাকরি করে যুব ফেডারেশন করেছে। আমার মতো অনেক মানুষ তখন কাজ ছেড়ে দল করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে দল করেছেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত একটা ছোটো চাকরি করতেন পুরসভায়, মানব মুখোপাধ্যায় এমবিএর কৃতী ছাত্র, দলের হোলটাইমার হয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, নীতি আঁকড়ে থাকলে হাতেগরম ফল পাওয়া যাবে না, কিন্তু আখেরে যাবে। সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় ‘ইন্সট্যান্ট’ না। তাৎক্ষণিক ফলাফল না পেলে মানুষ দল বদলে নিচ্ছে। আমরা ষাট বছর ধরে একই রাজনীতি করছি। আসলে ইনসাফের লড়াই কঠিন লড়াই। বামপন্থীরা বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের পথে যায়, কেন্দ্র চেয়েছে ধর্মের উপর নির্ভরশীলতা। এটা নীতির লড়াই, স্পষ্টত দুই দৃষ্টিভঙ্গির লড়াই। আন্দোলন, বিপ্লব, সংগ্রামে জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন আছে। এটাই বিজ্ঞান, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে এগনো যায় না।