দেশের নামে উগ্রতার দ্বন্দ্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও

Rabindranath Tagore: গোরার হিন্দুত্ব, সন্দীপের দেশের নামে উগ্রতা — এর মধ্য দিয়ে খানিকটা হলে নিজেও কি জাননি রবীন্দ্রনাথ?

সত্যজিতের ‘ঘরে-বাইরে’ ছবির সেই দৃশ্যটি মনে আছে? নিখিলেশ আর সন্দীপ মুখোমুখি। সন্দীপ গাইছে রবি ঠাকুরের গান। ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান—’ গাইতে গাইতে সন্দীপের ভূমিকায় সৌমিত্র নিখিলেশ-ভিক্টরের দিকে চোখ তুলে চাইছেন। গাইছেন, ‘আছে বল দুর্বলেরও’— ১৯০৫ সালে লেখা স্বদেশ পর্যায়ের এই গানটি সন্দীপের কণ্ঠে কেন দিলেন সত্যজিৎ? ‘ঘরে-বাইরে’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায়। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত এই পত্রিকাটিতে নোবেল প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ভাঙছিলেন, নতুন করে গড়ছিলেনও। তখন ‘গীতাঞ্জলি’ পর্ব আর ‘গোরা’ অতিক্রম করেছেন তিনি। ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার জীবনের দু'টি পর্ব। একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী, কল্পিত ব্রাহ্মণ্য অহমিকায় গোরা তার দেশের সাধারণের থেকে দূরে— অস্পৃশ্য বলে মনে মনে চিহ্নিত করে যার-তার হাতে জল খায় না। শুচিতার বর্ম আর খড়্গ তাকে ঘিরে থাকে। সেই গোরা বদলে গেল উপন্যাসের শেষে। তার ভারতবর্ষ আর হিন্দুর ভারতবর্ষ হয়ে রইল না। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে এসে রবীন্দ্রনাথ বিষয়টির আরও গভীর-বাস্তবতায় গেলেন। সন্দীপ তার দলবলের মধ্যে বিদ্বেষ আর হিংস্রতার রাজনীতির বীজ ঢুকিয়ে দিতে চায়। সেই হিংস্রতা অনুশীলন সাপেক্ষ। তার অনুগতদের নিয়ে চড়ুইভাতি করতে গিয়ে একটি ছাগলের পা কেটে আনতে বলে। যে ছাগলটি ঘুরছিল সেই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে বীভৎসতার আরোপ ঘটে। সন্দীপ তার নির্মোহ দৃঢ়তা প্রদর্শনের জন্য অনুচরদের সামনে নিজে উঠে গিয়ে জ্যান্ত ছাগলটির পা কেটে আনল। এ তো দেবতার সামনে দেবতার নামে ছাগল বলি দেওয়ার চাইতেও ভয়ংকর। দেশের নামে অকারণে ঠান্ডা মাথায় হিংস্রতার অনুশীলনের জন্য সন্দীপ এই কাজকে বীরত্বের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছে। এই যে গোরার হিন্দুত্ব, সন্দীপের দেশের নামে উগ্রতা — এর মধ্য দিয়ে খানিকটা হলে নিজেও কি জাননি রবীন্দ্রনাথ?

আরও পড়ুন- বক্সিং রিং-এ রবীন্দ্রনাথ আমার স্পারিং পার্টনার…

ছেলেবেলার হিন্দুমেলা, কিশোরবেলার গোপন বিপ্লবী-সমিতির উত্তাপ, বঙ্গভঙ্গের সময় স্বদেশগীতির মাধ্যমে দেশকে জাগিয়ে তোলা এসবই দেশের প্রতি ভালোবাসার বিশেষ এক মাত্রা। এক রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলেন আর অন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেকে দেখছিলেন। যখন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বোলপুরে তখন বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে যে চিঠি লিখছিলেন তাতে পুরনো ভারত সম্পর্কে ছিল মরমিয়া-রহস্যবোধ। বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে কোন পথে স্বাধীনতা মিলবে, এই ছিল জিজ্ঞাসা। একরকম করে এ-সবই তাঁর পথের অনুসন্ধান। তবে যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে দেখছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন মাত্রাভেদে স্বদেশ অনুসন্ধানের এই পথগুলি হয়ে উঠতে পারে সংকীর্ণ, তীব্র বিদ্বেষময়। হিন্দুমেলার জন্য যে কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাতে ছিল:

‘শুনেছি আবার, শুনেছি আবার,
রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার,
শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি,
আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!’ (হিন্দুমেলায় উপহার)

 

এক সময় স্বদেশ অনুসন্ধানের যে পথে এগিয়েছিলেন, এগিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবিধান অনুসন্ধান করতে গিয়ে, ক্রমশই বুঝতে পারছিলেন সে-পথের সীমা। বিশেষ করে পাশ্চাত্য সভ্যতার নিদর্শন সামনেই ছিল। উনিশ শতক যখন বিশ শতকে প্রবেশ করছে তখন রবীন্দ্র কবিতায় ধ্বনিত হলো,

‘জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।’ (৬৪ নং কবিতা, নৈবেদ্য)

এ-সবই যেন এক রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্য রবীন্দ্রনাথের দিকে যাত্রা। গোরার দুই চেহারা রবীন্দ্রনাথেরই এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে অগ্রসর হওয়া। আর সেজন্যই হয়তো নিখিলেশের সামনে দাঁড়ানো সন্দীপের কণ্ঠে সত্যজিৎ শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান। দুই রবীন্দ্রনাথ মুখোমুখি, নাটকীয় তাৎপর্যে। সন্দীপ বা হিন্দুত্ববাদী গোরা নিশ্চয়ই পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ নয়, হওয়ার কথাও নয়। তবে যে আবেগের বশবর্তী হয়ে এই রূপ পরিগ্রহ করেছে তারা সেই আবেগের স্বাদ-আস্বাদ মাত্রাভেদে রবীন্দ্রনাথ খানিক উপভোগ করেছিলেন।

এর থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী কালে, বিশেষত নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় যে স্বদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার আদর্শে উপনীত হতে চাইলেন তা নিতান্ত ভাববাদী কল্পনা নয়, তা নিজের এক আমি থেকে অন্য আমিতে অগ্রসর হওয়ার অনুশীলন-সাপেক্ষ ক্রিয়া। জালিয়ানওয়ালা বাগের মর্মান্তিক ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর স্বাদেশিক রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড ত্যাগ করলেন। গান্ধি ও চিত্তরঞ্জন দুই রাজনীতিবিদের চাইতে নাগরিক সমাজভুক্ত রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে অনেক বেশি তীব্র, তাৎক্ষণিক, প্রকাশ্য। সাধারণ মানুষের প্রতি এই বর্বর আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। আবার চিন-জাপান-আমেরিকায় যখন উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তিনি সরব, তখনও তিনি একা। তাঁর এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগ বিরোধী লেখার মর্মার্থ চিত্তরঞ্জন অনুধাবন করতে পারছেন না। অন্যরাও কি পারছেন? গঠনমূলক স্বাদেশিকতার যে আয়োজন তাঁর শিক্ষালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন তিনি সেই আয়োজনের সঙ্গে গান্ধির রাজনৈতিক পরিকল্পনার খানিক মিল আছে, শুধু যে মিল আছে তাই নয় এই মানুষটির সঙ্গেই আজীবন পরিপ্রশ্নমুখর বন্ধুতার সম্পর্ক যাপন করলেন তিনি।

আরও পড়ুন- যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করবে না: ইমদাদুল হক মিলন

এই সম্পর্ক যেন এক গভীর গণতান্ত্রিকতার মডেলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মতান্তর প্রকাশ্য অথচ সেই মতান্তর কখনও পরস্পরের প্রতি সংকীর্ণ বিদ্বেষের গহ্বর উন্মোচন করেনি। দু'জনেই রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ও উপর থেকে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় নিদানকে পরম ঔষধ বলে মনে করতেন না। দু'জনের কেউই ধর্ম-বিবিক্ত ছিলেন না। তবে দু'জনেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উল্লাসে বিশ্বাসী নন। ব্যক্তি উপলব্ধি সংক্রান্ত মানবিক সমূহের ধর্মীয়তায় একরকম বিশ্বাস তাঁদের ছিল। আর একটি মিল ছিল তাঁদের। দু'জনেই এক অর্থে সচল – গান্ধি নিজেকে বলতেন আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদী আর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন অনাগারিকতাই মানুষের ধর্ম। প্রকৃত মানুষের কোনও আগার বা গুহাবদ্ধ বিশ্বাসের অন্ধকার থাকে না। এক বিশ্বাসের আবর্ত থেকে অন্য পরীক্ষার সচলতায় ক্রমশই এগিয়ে যেতে হয় মানুষকে।

গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথের এই মতাদর্শ ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী উগ্রতার পরিপন্থী। কীভাবে তাঁরা এই দুইয়ের বিরোধিতা করছিলেন? তাঁরা উপর থেকে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় নিদানের অনুসারী হতে চাননি। দু'জনেই স্থানীয় সাধারণের নিজেদের গড়ে তোলা সংগঠনের উপর বিশ্বাস রাখতেন। সেই সাংগঠনিকতা সমবায় প্রথা ভিত্তিক হবে — এই ছিল ভাবনা। দু'জনে একথাও মনে করতেন যে, সংগঠনের উপায় ও লক্ষ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। যা স্থির থাকে তা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের নির্দ্বিধ অবিরত সংলাপের পরিসর। এই কথোপকথন উগ্র রাষ্ট্র ও উগ্র ধর্ম করতে চায় না। গান্ধিহত্যা কথোপকথন বিরোধিতার প্রকাশ, আর রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনই ক্রমশই যে নিজেকে ভাঙছেন তা তো নিজের সঙ্গে নিজেরই কথোপকথন। সত্যজিৎ সন্দীপ আর নিখিলেশকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সন্দীপের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান রেখে সেই কথোপকথনের রূপটি দেখাচ্ছিলেন। নিজের সঙ্গে নিজে অবিরত কথা বলাই তো নিজেকে মুক্ত করার উপায়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও ধর্ম তা করতে চায় না, করতে দেয়ও না।

More Articles