নাদাল-ফেডেরার রসায়ন: প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বীই যখন নিবিড়তম বন্ধু
Rafael Nadal-Roger Federer: চরম পেশাদার দুই বীরের বন্ধুত্বের রসায়ন হয়তো এমনটাই। যেখানে কর্তব্যের দায়িত্বপূরণের চাইতে মুখ্য হয়ে ওঠে 'শ্রদ্ধা'।
টেনিস থেকে রাফায়েল নাদালের অবসরগ্রহণের প্রাক্কালে রজার ফেডেরারের শুভেচ্ছাবার্তা খেলার দুনিয়ায় এই মুহূর্তে অন্যতম চর্চার বস্তু। খোলা চিঠিটির অন্তর্লীন মিষ্টত্ব, মিঠেকড়া আর্দ্রতার বাইরে আরও একটা জিজ্ঞাসা, আরও একটা বিস্ময় হালকা করে হলেও হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে— 'বিগেস্ট রাইভ্যাল' কী করে 'বেস্ট মেটস্' হতে পারে? রজার কী লিখেছেন চিঠিতে?
“As you get ready to graduate from tennis, I’ve got a few things to share before I maybe get emotional. Let’s start with the obvious: you beat me—a lot. More than I managed to beat you. You challenged me in ways no one else could. On clay, it felt like I was stepping into your backyard, and you made me work harder than I ever thought I could just to hold my ground. You made me reimagine my game—even going so far as to change the size of my racquet head, hoping for any edge.
I’m not a very superstitious person, but you took it to the next level. Your whole process. All those rituals. Assembling your water bottles like toy soldiers in formation, fixing your hair, adjusting your underwear... All of it with the highest intensity. Secretly, I kind of loved the whole thing. Because it was so unique—it was so you.
And you know what, Rafa, you made me enjoy the game even more.”
তাহলে খেলার মাঠে 'বিগেস্ট রাইভ্যাল' 'বেস্ট মেটস্' হতে পারে? এই প্রশ্নটাই আবার কিঞ্চিৎ বিরোধাভাস গোছের ঠেকছে না? টেনিস কোর্টে দুর্দমনীয় দ্বৈরথ না হয় বুঝলাম, যেখানে কেউ কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনী পর্যন্ত ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সামান্যতম ভুলে নিমেষে ঘনিয়ে আসে সেট পয়েন্ট, ম্যাচ পয়েন্টের ভ্রুকুটি। দু-সেট পিছিয়ে থেকেও যে-রাইভ্যাল পরের তিন সেটে কামব্যাক করে ম্যাচ পকেটে পুরতে পারে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দু'জনের বিশ্বস্ত অনুগামী তৎসহ মিডিয়াকুল অঙ্ক কষতে থাকে সেমিফাইনাল না ফাইনাল— কোথায় এবার মুখোমুখির সম্ভাবনা প্রবল— সেই যুদ্ধকে 'বিগেস্ট' বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। যেন আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, নেই কোনও বাধা… শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি রাউন্ডই যেন গা-ঘামানোর আসর। যেই আসুক, হার সুনিশ্চিত। হয়তো এক সেটের 'হোঁচট' খেতে হতে পারে। কিন্তু ছন্দপতন? উঁহু, কক্ষনও না৷ ঘুরেফিরে ফাইনাল শুরুর আগে উইম্বলডনের বিলবোর্ডে জ্বলজ্বল করবে সেই চিরায়ত অমোঘ বিজ্ঞাপন— 'ফেডেরার ভার্সেস নাদাল'।
আরও পড়ুন- নাদালের যাত্রাপথ এখন টেনিস ছাড়িয়ে জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণা
আবার এক হিসেবে এই আপাত-নির্বিঘ্ন প্রিলিউডটুকুরও গুরুত্ব রয়েছে ঠিক। কে কত নির্মম উপায়ে, কখনও হাস্যকরভাবে কিংবা দ্রুততার সঙ্গে প্রতিপক্ষকে ছারখার করে দিতে পারে, সঞ্চার করতে পারে ত্রাস, আগেভাগে আদায় করে নিতে পারে সমীহ— ফার্স্ট রাউন্ড, সেকেন্ড রাউন্ড জুড়ে যেন তারই উৎসব, আয়োজন। ফেডেরার দু'চোখে নেটের ওপারের এক নাদানের সার্ভিস মাপছে ঠিকই কিন্তু তৃতীয় নেত্র সেন্টার কোর্টে নাদালের প্রতিটা মুভমেন্ট ছকে রাখছে৷ আর এক রাউন্ড পরেই তো বড় ম্যাচ। তাই প্রস্তুতিতে ঢিলেমি হতে দিচ্ছে না— অপেশাদার ভক্তের এমন অতিরঞ্জিত, কাল্পনিক বিশ্লেষণ হাস্যকর মনে হতে পারে। তার সমালোচনা চলতে পারে। কিন্তু এমন পুঞ্জীভূত অনুমান, বিস্ময়কর আবেগ, নিঃশর্ত ভালোবাসা জমেতে জমতেই তো নাদাল-ফেডেরারের দ্বৈরথকে এক উত্তুঙ্গ শিখরে নিয়ে গেছে— একে অস্বীকার করিই বা কীভাবে? কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ— তাই নিয়ে মাঠের বাইরে খরশান বাকযুদ্ধ, যুক্তি-প্রতিযুক্তির খেলা না থাকলে এই দ্বন্দ্ব থেমে যাওয়ার অনেক আগেই কি কোনওভাবে কিংবদন্তির আখ্যা পেতে পারত? অনুরাগীদের বিহ্বল প্রেম, একবগ্গা জেদই কি আখেরে এই অমোঘ সংঘর্ষকে 'প্রবলতম' করে তোলেনি?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে পরের প্রশ্নে। 'বেস্ট মেটস্'? নিবিড়তম বন্ধু হয় কী করে? একজন ঘাসে স্বচ্ছন্দ। অন্যজন অপ্রতিরোধ্য মাটিতে। হার্ড কোর্টে লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার হিসেবপাতি নিয়েও এতদিন ইঁদুরদৌড় চলেছে৷ ফেডেরার একটু এগিয়ে থেকে শুরু করলেও প্রতিনিয়ত ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়েছেন নাদাল। রেকর্ড, পরিসংখ্যান বড় বালাই। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে— জয়ের অঙ্কই একজন খেলোয়াড়ের ময়দানি শ্রেষ্ঠত্বকে অজর করে রাখে। উদ্যত কালের থাবাও খানিক পিছিয়ে যায়। প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে ভেসে আসে নাম। 'নাম' জীবিত রাখে রেকর্ড। পরের প্রজন্ম অন্য কোনও তরুণকে উঠতি হিরো বানাতে গিয়েও থমকে যায় নিশ্চিত। শ্রেষ্ঠ। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম কি? রেকর্ডের খাতা যে অন্য কথা বলছে! ভক্তের মনে জেগে ওঠে সন্দেহের কাঁটা। সেঞ্চুরির অঙ্ক, গোলের অঙ্ক, গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের অঙ্ক তাই দেখতে সহজ— আদতে বেজায় কঠিন। নিষিদ্ধ নেশা ছাড়ার মতো কঠিন। কিছুতেই থামতে দেয় না। অস্ত্র তুলে রাখতেও হাত কাঁপে। বিস্মৃতির ভয় যে বড় তীব্র!
তাহলে এক পিছু-ধাওয়া-করা প্রতিদ্বন্দ্বীকে কী করে বেস্ট মেটস্ ভাবতে পারলেন ফেডেরার? অন্যদিকে নাদালই বা কোন যুক্তিতে এক নাছোড় পরাক্রমী সুইসকে এতদিন পরম সুহৃদ ভেবে গেলেন? এটা তো সত্যি যে, দু'জনের কেউই ছেলেবেলার বন্ধু নন। নন সতীর্থও। একই গুরুর কাছে শিক্ষালাভের সুযোগও মেলেনি। সুইজারল্যান্ড থেকে স্পেন। ভৌগোলিক দূরত্বের কথা চিন্তা করলে দু'জনের আকছার আড্ডা, খোশগল্পের কাল্পনিক বেলুনকেও ফোলানো অসম্ভব। গলায়-গলায় বন্ধুত্ব, একজন অন্যজনের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের হিসেব রেখে চলেছে অহরহ— এমন কিছুর সম্ভাবনাও খুব কম। নেই বললেই চলে৷ অন্তত, খবরের পাতায় ফেডেরার-নাদালের এহেন 'নিবিড়তা' নিয়ে চর্চিত আর্টিকেল চোখে পড়েনি।
আরও পড়ুন- নাদাল-জকোভিচের থেকে পিছিয়ে, তবু টেনিস দুনিয়ার রাজা কেন রজারই
তাহলে? সবই গিমিক? কিংবদন্তি হয়ে ওঠা লড়াইকে অমরত্ব দিতে, যাতে তা নেহাত 'কেঠো' না হয়ে ওঠে, তার জন্য মানবিক গুণসঞ্চারের কৌশল? মিডিয়ার পাতা ফাঁদ? বোধহয় না। চরম পেশাদার দুই বীরের বন্ধুত্বের রসায়ন হয়তো এমনটাই। যেখানে কর্তব্যের দায়িত্বপূরণের চাইতে মুখ্য হয়ে ওঠে 'শ্রদ্ধা'। যোগাযোগরক্ষার কেজো ফর্মুলার জায়গা নেয় 'বিশ্বাস'। কোনও শর্তের বাঁধাধরা চাপ গায়েব। সেই সুযোগও নেই হয়তো। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের লড়াইয়ে নিজেকে অবধ্য করে তুলতে অলক্ষ্যে কয়েক সেট এগিয়ে খেলা শুরু করতে হবে। তার জন্য দরকার নিশ্ছিদ্র পরাক্রম, অটুট প্রস্তুতি। পরাজয়ে দ্বেষ নয়, পিছিয়ে পড়ায় ঈর্ষা নয়। ফের ঘুরে দাঁড়াতে হলে চাই এমন এক আলেয়া, যে কিনা থামতে দেবে না। অনবরত ছোটাতে থাকবে। বয়সের ভার, চোট-আঘাতের ধাক্কায় অবসাদ আসবে। হাতছাড়া হবে একের পর এক টুর্নামেন্ট। নয়া প্রজন্মের তারকা কেড়ে নেবে লাইমলাইট। এতদিনের বিশ্বস্ত অনুরাগীদের মনেও দানা বাঁধবে সংশয়। তবে কি সত্যিই থেমে যাবে ফেড-এক্স? এবারের উইম্বলডনই কি হতে চলেছে শেষ লড়াই? ঠিক তখনই… তূণীর চিরতরে গুটিয়ে রাখার আগে ধাক্কা দিয়ে যাবে এত বছরের এপিক দ্বৈরথের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বীটি। কীভাবে?
আমাদের মনে পড়বে ২০০৯ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মহাকাব্যিক ফাইনালের কথা। পাঁচ সেটের ম্যারাথন লড়াই শেষ। চলতি মরশুমে টানা তিনবার নাদালের কাছে হার মানতে হল ফেডেরারকে৷ রড লেভার এরিয়ার সেই সন্ধেয় পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে টেনিস দুনিয়ার চরম আবেগসংযমী মানুষটাও ভেঙে পড়েছে কান্নায়। বীরোদ্ধত ভঙ্গিতে ট্রফি তোলার বদলে সেবার উদযাপনের সুর প্রত্যাশিতভাবে নরম তারে বেঁধেছিল রাফা। রজারের পিঠ চাপড়ে জানিয়েছিল, ফিরে আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। তারপর খানিক হেসে মজার ছলে ভাঙা ইংরেজিতে প্রশ্ন, 'এখনও সাম্প্রাসের গ্র্যান্ড স্ল্যামের রেকর্ডটা ভাঙা বাকি আছে তো, নাকি?'
এখানে, ঠিক এখানেই পরাক্রমী প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে নিবিড়তম বন্ধু। যে কোনোদিন আমায় থামতে দেয়নি। যখনই নুয়ে পড়েছে মাথা, ঝুঁকে গেছে কাঁধ, তখনই কখনও আড়ালে কখনও প্রকাশ্যে বলা তার সামান্য কিছু কথাই আমার সঞ্জীবনী মন্ত্র হয়ে উঠেছে। 'মিউচুয়াল রেসপেক্ট' বা 'পারস্পরিক শ্রদ্ধা' ইদানীং তার কৌলীন্য হারিয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে কেউ কোনোদিন যদি এর প্রমাণ খুঁজতে চায়, রাফা-রজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার নজিরকে যেন সে অগ্রাহ্য না করে।