নাইটক্লাবে রাহুলের ছবিকে হাতিয়ার করে কী আড়াল করছে বিজেপি?
পারিবারিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, এর বাইরে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষ হিসেবে ইদানীংকালে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় না। তার পরেও উত্তম, মধ্যম, অধমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বারবার উঠে আসে তাঁর নাম। কংগ্রেস (Congress) সাংসদ রাহুল গান্ধীকে (Rahul Gandhi) নিয়ে সেই রীতিই বজায় রাখল শাসক দল বিজেপি (BJP)। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় কাবু অর্থনীতির পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে যখন বিদেশ সফরকে গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠছে, সেই সময় ফের একবার রাহুলের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ এবং ‘অক্ষমতা’-র আখ্যানই তুলে ধরতে দেখা গেল বিজেপি-কে।
মোদির বিদেশ সফর নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই দিল্লিতে রাহুলের অনুপস্থিতি নিয়ে আগেই প্রশ্নবাণ দেগে রেখেছিল বিজেপি। কিন্তু আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানোর জুতসই রসদ মিলছিল না কিছুতেই। পদমর্যাদা সার্থক করে মঙ্গলবার সেই কাজটি করে দেখান দলের আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য। একেবারে টাটকা ভিডিও তুলে এনে চোখে আঙুল দিযে দেখিয়ে দেন, প্রাধনমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে যে কংগ্রেস, তাদের নেতা নিজে নেপালের নাইট ক্লাবে নৈশযাপনে মগ্ন। মালব্য যে একেবারে সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ তাতেই পড়িমড়ি করে ড্যামেজ কন্ট্রোলে ছুটে আসতে হয় কংগ্রেস নেতৃত্বকে। বিজেপি-র অভিযোগ, অস্তিত্ব সংকটে মধ্যে দলকে ফেলে রেখে ফূর্তি করছেন রাহুল। যদিও কংগ্রেস নেতৃত্ব জানিয়েছেন, বন্ধুর বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছেন রাহুল।
রাহুলের হয়ে সাফাই দিতে গিয়ে ২০১৫ সালে মোদির পাকিস্তান সফর এবং তার পরবর্তী পাঠানকোট হামলার প্রসঙ্গও টেনে আনেন তাঁরা। তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ের বিয়েতে মোদির হাজির হওয়াকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যুক্তি দেন যে, আমন্ত্রণ ছাড়াই শরিফের বাড়িতে কেক কাটতে গিয়েছিলেন মোদি। রাহুল তা করেননি। আমন্ত্রণ পেয়ে বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়েছেন। তাই রাহুলের নেপাল সফল মোদির পাক সফরের থেকে কম সাংঘাতিক বলে বিবৃতি দেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। এরপরেই দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: কে বেশি গেরুয়া? শিবসেনা-বিজেপি তরজার নেপথ্যে আসলে কোন কারণ?
একদিকে, মোদির পাক সফর কূটনৈতিক প্রকৌশল, রাহুলের নৈশযাপন তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, পাশ্চাত্যপ্রীতির পরিচয় বলে আক্রমণ শানাতে থাকেন বিজেপি নেতৃত্ব এবং দলের সুবিশাল সোশ্যাল মিডিয়া ফৌজ। তার মোকাবিলায় তরল পানীয় হাতে অটলবিহারী বাজপেয়ী, মোদির প্রাক্তন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের ছবি তুলে ধরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন তুলে ধরতে দেখা যায় বিজেপি-র একচ্ছত্র আধিপত্যের সামনে টিমটিম করতে জ্বলতে থাকা কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া টিম এবং গুটিকয়েক আঞ্চলিক নেতাকে।
ভিডিওতে রাহুলের সঙ্গে থাকা তরুণীর পরিচয় নিয়েও শুরু হয় আকচাআকচি। রাহুলকে ‘দেশদ্রোহী’ প্রমাণে নাইটক্লাবে তাঁর সঙ্গিনী তরুণীর পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে গেরুয়া শিবির। তিনি কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত চিনা রাষ্ট্রদূত, ভারতের বিরুদ্ধে নেপালকে উস্কানি দেওয়ায় যুক্ত ছিলেন বলে দাবি করে তারা। তাই ওই তরুণীর সঙ্গে রাহুলের কী সম্পর্ক, তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবিও তোলা হয়। যদিও সত্যতা যাচাইয়ে উঠে আসে যে, দিল্লিতে মোতায়েন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর সাংবাদিক সুমনিমা উদাস রাহুলের বান্ধবী। তাঁর বিয়েতেই নিমন্ত্রণ গিয়েছেন রাহুল।
সুমনিমা আবার মায়ানমারে নেপালের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ভীম উদাসের কন্যা। ভিডিওর ওই তরুণী সুমনিমার বান্ধবী। নিমা মার্টিন শেরপার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন সুমনিমা। বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠান থেকে ৩ মে বিয়ের অনুষ্ঠান এবং ৫ মে রিসেপশন পর্যন্ত নিমন্ত্রিত রাহুল। শুধু তাই নয়, কাঠমান্ডুর ওই নাইটক্লাবে বর-কনের তরফে সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, রাহুল সেখানে আধঘণ্টামতোই ছিলেন, কোনও চিনা রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না বলে বিবৃতি দিতে হয় সেখানকার কর্তৃপক্ষকেও।
তাই বান্ধবীর বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া আদৌ অপরাধ কি না, প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। সংখ্যালঘু হলেও, রাহুলের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের। রাজনীতি করেন বলে কি রাহুলের ব্যক্তিগত জীবন নেই, প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। কিন্তু এখানেই আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসছে। তা হল, যে নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে রয়েছেন রাহুল, দেশের প্রাচীনতম যে রাজনৈতিক দলের অলিখিত সর্ব্বেসর্বা তিনি, তার গরিমা রক্ষার কি কোনও দায় নেই তাঁর!
একের পর এক রাজ্যে জমি হারাতে হারাতে একেবারে কিনারায় এসে পৌঁছেছে কংগ্রেস। নির্বাচনী রাজনীতিতে মারকাটারি রেকর্ড সত্ত্বেও কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে চাননি প্রশান্ত কিশোর। এই আবহে মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকে নেতা সকলকে আশ্বাস জোগাবেন, তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে মাঠঘাট চষে ফেলবেন, সাধারণত এমনটাই কাম্য রাজনীতিকদের কাছ থেকে। কিন্তু কয়েক দশক রাজনীতিতে কাটালেও, জীবনের ৫০টি বসন্ত পার করলেও, রাহুল আদৌ রাজনীতিক হতে পেরেছেন কি না, বর্তমান রাজনৈতিক পটচিত্রে তিনি মানানসই কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় উপস্থিত থাকার অভ্যাসকে আক্ষরিক অর্থেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন রাহুল। নিজের দায়বদ্ধতার প্রতি তাঁর উদাসীনতাকেও এর জন্য দায় করেন অনেকে। তাঁদের মতে, গাঁধী-নেহরু পরিবারে জন্মানোর দায় বইতে হচ্ছে রাহুলকে। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা বজায় রাখতে গিয়ে খাঁচায় বন্দি হয়ে গিয়েছেন তিনি, যা ভেঙে বেরনোর জন্য ছটফট করতে থাকেন। আসলে তিনি উচ্চবিত্ত শ্রেণির সেই মানুষদের মধ্যে পড়েন তিনি, মোটা টাকার কর্পোরেট চাকরি, সপ্তাহান্তে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-ডিনার, শরীরচর্চা, সময় পেলে ছুটি কাটাতে বেরিয়ে পড়ার জীবনে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন যাঁরা।
রাহুল নিজেও সেই নিয়ে কখনও রাখঢাক করেননি। বরং রাজনীতির প্রতি বরাবরই অনীহা ছিল তাঁর। তাই কেমব্রিজে এমফিল সেরে লন্ডনে একটি ম্যানেজমেন্ট সংস্থায় তিন বছর কাজ করেন তিনি। দেশে ফিরেও প্রথমেই রাজনীতিতে যোগ দিতে ছোটেননি। বরং বাণিজ্যনগরীতে নিজের প্রযুক্তি সংস্থা খুলে বসেন। অর্থাৎ, রাজনীতি বরাবরই তাঁর কাছে অপশন হয়ে থেকেছে। বিজেপি নেতৃত্বও রাজনীতির প্রতি রাহুলের এই উদাসীনতা সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবগত। কিন্তু রাহুলকে ছাড়া তাদেরও চলবে না। নিজেদের ভারতীয়ত্ব, সেবাপরায়ণতার প্রমাণ দিতে পরিবারতন্ত্র, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফসল রাহুলকে প্রতি পদে প্রয়োজন তাদের। আবার নীতি, আদর্শ এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে রাহুলের পক্ষেও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।