রাজার ভাত খাওয়া আজও বহাল আলিপুরদুয়ারে, কীভাবে এল শহরের এমন অদ্ভুত নাম?

Raja Bhat khawa : রাজারা কি আজও ভাত খান এ শহরে?

বক্সা। ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রবেশদ্বার। আশেপাশে ফাঁকা কিছু রেলস্টেশন। ট্রেন আসে বেশ পরপর। অপেক্ষারত মানুষের এদিক ওদিক চলাফেরা। পাশেই ঘন জঙ্গল। সবুজের আধিক্যে সে যেন এক অন্য ভুবন। শান্তশিষ্ট এই জায়গাটার নাম ‘রাজা ভাত খাওয়া’। উত্তরবঙ্গের মানচিত্রে এমন একটা নাম দেখা মাত্রই প্রশ্ন জাগে। নামের আকর্ষণে চোখ আটকে যায়। আর এ এমন একটা নাম, একবার শুনলে আর ভোলা যায় না। রাজা ভাত খাওয়া— কোথাকার রাজা? সেই রাজা কি আবার ভাত খাচ্ছেন? নাকি রাজা নামক কোনো ব্যক্তির কাছে ভাত চাওয়ার আকুতি? উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে প্রাচীন এক ইতিহাসের দিকে।

ইঞ্জিনিয়র হ্যামিল্টন সাহেবের নামানুসারে পার্শ্ববর্তী কালচিনি স্টেশন ও কালচিনি বাজারের নাম হ্যামিল্টনগঞ্জ রাখা হয়। সেই কালচিনি ও হ্যামিল্টনগঞ্জ লাগোয়া আরেকটি অঞ্চল রাজা ভাত খাওয়া। বর্তমান জেলা আলিপুরদুয়ার। নামের পিছনে থাকবেন কোচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ। তাঁর ভুটান থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। প্রথম অন্নাহারের অমর কাহিনি। তবে সবই লোককথা। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস। যদিও কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।

আরও পড়ুন - ঘিঞ্জি দিঘা, ভিড় দার্জিলিং নয়, এই রাজবাড়িগুলিই এখন শীতের সেরা ডেস্টিনেশন!

কোনো এক কারণে ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ভুটানে বন্দি হয়েছিলেন। মুক্তি পেয়ে ফিরে আসেন নিজের রাজ্যে। ফিরে আসার সময় কালচিনির কাছে এক অঞ্চলে প্রথম ভাত খেতে বসেন। রাজার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করতে অঞ্চলের এই নামকরণ। যদিও প্রখ্যাত খান চৌধুরী আমানতুল্লা আহমেদের লেখায় এমন ইতিহাসের উল্লেখ নেই। তাঁর লেখায় আছে চেকাখাতার কথা। রাজা ভাত খাওয়া অঞ্চলের কিছুটা দূরেই চেকাখাতা। চেকাখাতায় কোচবিহার ও ভুটান রাজ্যের বার্ষিক ভোজের অনুষ্ঠান হত। সেই ভোজ থেকেই এমন নামকরণ।

রাজা ভাত খাওয়ায় একবার যিনি যাবেন, অঞ্চলের সৌন্দর্যে আর চোখ ফেরাবার জো থাকবে না। নতুন জেলা আলিপুরদুয়ার তার সৌন্দর্য ধরে রেখেছে এখনও। ঠিক যেমন ছিল ১৮০০ সালেও। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অঞ্চল দখল করে নেন ভুটানের রাজা। সেই সময়ই জঙ্গলাকীর্ণ এসব অঞ্চলের রাজা ছিলেন ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ। বেশ রেগে গেলেন। ভুটানের বিরুদ্ধে ডাক দিলেন যুদ্ধের। ধৈর্যেন্দ্র পণ করলেন। ভুটানের রাজাকে এলাকাছাড়া করবেনই। নাহলে অন্নগ্রহণ করবেন না। পরে দুই রাজা একে অপরের শর্ত মেনে নেন। সন্ধির শর্ত মেনে সীমান্তবর্তী এক জায়গায় এসে দুই রাজা অন্নগ্রহণ করেন। লোকমুখে যা পরে রাজা ভাত খাওয়া হয়ে যায়।

আরও পড়ুন - দিঘা-পুরী-দার্জিলিং আর নয়, চেনা ছকের বাইরে সফর সারুন পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শিমোগায়

সে যাই হোক, নামটার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত কবিতা। রাজার ভাত খাওয়া বা রাজাদের ভাত খাওয়া না হয়ে, তা হয়ে গেল, ‘রাজা ভাত খাওয়া’। এ এক অদ্ভুত বাক্য। অদ্ভুত সমাপতনও বটে। ‘র’ বিভক্তির আর তাৎপর্য রইল না। যদিও এটি রাজবংশী শব্দ। একসঙ্গেও লিখে থাকেন অনেকে — রাজাভাতখাওয়া। সড়কপথে এই অঞ্চল জেলা সদরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও চারদিক ঘেরা বক্সা জাতীয় উদ্যান। বঙ্গদর্শনের উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি বাপি ঘোষ এই অঞ্চল প্রসঙ্গে বলছেন, “কাছেই পাহাড়, তার পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল, পাহাড়ি নদী। সবমিলিয়ে প্রকৃতির রানি যেন উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে সৌন্দর্য উজাড় করে মেলে ধরেছে। আর ডুয়ার্সের সৌন্দর্যময় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম ডুয়ার্সের রাজা ভাত খাওয়া।ঐতিহাসিক দিক থেকেও এই স্থান বাড়তি গুরুত্ব বহন করে। তাই পর্যটকরা ডুয়ার্স ভ্রমণের সময় গরুমারা, জলদাপাড়া, জয়ন্তী, বক্সা পাহাড়, বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টকে সঙ্গে রাখলে রাজা ভাত খাওয়ার নামটিও জুড়ে নেন।”

সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, রাজা ভাত খাওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে পাগল করবেই।

More Articles