সৌরভ থেকে রাজু শ্রীবাস্তব, মরণফাঁদের নাম জিম, কেন বারবার হার্ট অ্যাটাক
শুধু অভিনেতা রাজু শ্রীবাস্তবই নয়, অতীতে ফিরে গেলে দেখা যাবে জিম করতে করতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
১০ আগস্ট রাজু শ্রীবাস্তব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দিল্লি এইমসে ভর্তি হয়েছেন। জানা যায়, অন্যান্য দিনের মতোই মঙ্গলবার রাতে জিমে শরীরচর্চা করছিলেন অভিনেতা। সেখানে ট্রেড মিলে দৌড়নোর সময়েই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান তিনি। তবে সময় নষ্ট না করে জিমের ট্রেনাররাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওয়ার্কআউট শুরুর আগে থেকেই তিনি বুকে ব্যাথা অনুভব করছিলেন এবং এরপরই এই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলেও এখনও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাননি রাজু। প্রায় অচেতন অবস্থায় এখনও পড়ে রয়েছেন অভিনেতা।
পরিবারসূত্রে জানা গেছে যে, খুব ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন অভিনেতা। শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও আগামী দশ দিন খুবই জরুরি তাঁর জন্য। ১১ অগাস্ট জানা যায় যে, হার্ট অ্যাটাকের কারণে রাজুর মস্তিষ্কের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠিকভাবে কাজ করছে না তাঁর স্নায়ুগুলি। তবে অভিনেতার ভাইপো জানিয়েছেন যে, চিকিৎসকরা আশা করছেন রাজু খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবেন।
আরও পড়ুন: সামান্য ধুলো লাগলেই শরীর কাহিল, এই খাবারগুলি সুস্থ রাখবে আপনাকে
তবে শুধু অভিনেতা রাজু শ্রীবাস্তবই নয়, অতীতে ফিরে গেলে দেখা যাবে জিম করতে করতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। গত বছরই বলিউডের কোরিওগ্রাফার রেমো ডিসুজা জিম করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কন্নড় সিনেমার সুপারস্টার পুনীত রাজকুমার জিমে শরীরচর্চা করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সম্প্রতি জিম করতে গিয়ে কলকাতার এক কলেজ পড়ুয়া তরুণীরও মৃত্যু হয়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও অ্যাটাক হয় জিমে শরীরচর্চা করার সময়।
শরীরচর্চা করে সুস্থ থাকার বদলে আমরা বড় কোনও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না তো শরীরকে? একের পর তারকা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এমন প্রশ্ন করছেন অনেকেই।
চিকিৎসকের মতে জিম করলে কী কী মাথায় রাখতে হবে?
• স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি
চিকিৎসক মৌমিতা নস্করের মতে, "জিম শুরুর আগে সতর্ক হওয়া উচিত। প্রতিটি মানুষের শারিরীক গঠন ভিন্ন হয়, তাই অতি অবশ্যই জিমে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। কারণ অনেক সময় বাইরে কোনও লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকতে পারে, যা শরীরচর্চার সময় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।" তিনি আরও জানিয়েছেন যে, প্রত্যেকের শারিরীক গঠন ভিন্ন হওয়ার কারণে সব এক্সারসাইজ সকলের জন্য নয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছেন কোনও ব্যক্তি। বেশিরভাগ জিমের ট্রেনারই কোনও ব্যক্তির বয়স, শারীরিক অসুবিধা, রোগের ইতিহাস জেনে তবেই শরীরচর্চার কৌশলগুলি শিখিয়ে থাকেন। তাঁদের পক্ষে কারও শারীরিক গঠন বোঝা সম্ভব নয়, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ, স্বাস্থ্য পরীক্ষার দিকটি একেবারেই অবহেলা করা ঠিক নয়। তাছাড়া ডায়াবেটিস, রক্তচাপ এবং শরীরে কোলেস্টরলের মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত প্রতি ছয় মাসে।
• প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রেনার
যে জিমেই ভর্তি হচ্ছেন সেখানের ট্রেনাররা ভালোভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কি না, তাও জেনে নেওয়া জরুরি। তবেই তাঁরা আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন।
• অতিরিক্ত জিম নয়
পাশাপাশি অতিরিক্ত কোনওকিছুই ভালো নয়। একদিন খুব বেশি শরীরচর্চা করলেই যে কেউ রোগা হয়ে যাবেই, এমনটাও নয়। বরং নিয়ম মেনে শরীরচর্চা করা উচিত। এক্ষেত্রে প্রথম প্রথম জিমে গিয়েই ওয়েট ট্রেনিং করবেন না। ট্রেড মিলে মাত্রাতিরিক্ত জোরে দৌড়বেন না। প্রথম দিকে স্ট্রেচিং, হালকা এক্সারসাইজ এবং ফ্রি হ্যান্ড করুন। ধীরে ধীরে শরীরকে অভ্যস্ত করে তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
• সঠিক ডায়েট এবং তার ফলো-আপ
চিকিৎসক মৌমিতা নস্কর এই প্রসঙ্গে বলেছেন, "অতিরিক্ত প্রোটিন এবং সামান্য কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করার মানেই যে শরীর সুস্থ এমন ভাবনা একেবারেই ভুল।" তাঁর মতে, "শরীর বুঝে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খাওয়া জরুরি। শুধু ডায়েট মেনে খাবার খেলেই হবে না, প্রতি ছ'মাস বা এক বছরে তা বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ ডায়েট এবং শরীরচর্চার ফলাফল কী হল তার ফলো আপ অবশ্যই রাখুন। আমি নিশ্চিত যাঁরা জিম করেন তাঁদের ৯৯ শতাংশই এটা করেন না। ফলে বোঝাই যায় না শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, যা অকালে বিপদ ডেকে আনছে অনেকের জন্যই। যাঁরা জিম করেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই মাথায় থাকে আমি ভালো খাবার খাচ্ছি এবং শরীরচর্চার মধ্যে রয়েছি তাহলে আর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে শরীরের ভেতরে এবং বাইরের পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে জানা গেলে তবেই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।"
করোনা-পরবর্তী সময়ে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী এরপরেও কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতেই পারে। হঠাৎ করে কোনো রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক হলে সেক্ষেত্রে তো যথাযোগ্য চিকিৎসা করাতে হবে। কোভিড পরবর্তীকালে যে হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়েছে, একথা চিকিৎসকরাও মেনে নিয়েছেন। চিকিৎসকের মতে, "করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরে দু'ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ফুসফুসের সমস্যা এবং রক্তনালীর ক্ষতি। এর ফলে দেখা গেছে যে রক্তনালীগুলি ফুসফুস থেকে রক্ত হৃদযন্ত্রে পৌঁছে দেয়, তার মধ্যে থ্রম্বাস বা রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। শরীরচর্চার সময় যে অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, আমাদের শরীরে তার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যার ফলে হার্ট অ্যাটাক কোভিড পরবর্তী সময়ে বেড়েছে।
স্টেরয়েড কীভাবে প্রভাব ফেলে শরীরে?
এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক জানিয়েছেন যে, স্টেরয়েড শরীরের ইমিউনিটি কমিয়ে দেয়। জিমে গিয়ে এনার্জিটিক লাগলেও এর সাইড এফেক্ট ভুললে চলবে না। এর ফলে ছোটখাটো কোনও রোগ, যা আর পাঁচটা মানুষের ক্ষেত্রে সহজেই সেরে যায়, সেগুলি মারাত্মক আকার নিতে পারে স্টেরয়েড গ্রহণ করলে। তাই জিমে শরীরচর্চা করলেও স্টেরয়েড বা সিন্থেটিক প্রোটিন না নেওয়াই ভালো। সীমিত মাত্রায় হলেও সুস্থ থাকতে এগুলি এড়িয়ে চলুন।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
হার্ট অ্যাটাকের আগে শরীর জানান দিতে শুরু করে। অতিরিক্ত ক্লান্তি, বুকে ব্যথা, বমি বমি ভাব, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণ। কারও কারও ক্ষেত্রে পেটেও ব্যথা অনুভব হতে পারে। এই লক্ষণগুলি থাকলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়াই ভালো।