বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহত ২৩? এই মৃত্যুর বাস্তব কারণগুলি আসলে যা

Bangladesh: বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছিল, গত সাড়ে চার মাসে দেশে গ্রামীণ পর্যায়ে ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছে গণঅভ্যুত্থানের পর, গত সাড়ে চার মাসে দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় ২৩ জনের হত্যা হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এই দাবিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করে। উল্লিখিত ২৩টি হত্যাকাণ্ডের তালিকা সংগ্রহ করে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই তালিকা প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূসের দফতর থেকে পাঠানো হয় পুলিশের কাছে। প্রতিটি ঘটনার প্রকৃত কারণ ও ঘটনার পরে কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

পুলিশ প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানায়। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, উল্লিখিত ২৩টি ঘটনার ২২টির প্রাথমিক কারণ সম্পর্কে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে এবং সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে। তবে একটি ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ আরও বলছে, যে ২২টি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য ইতিমধ্যে জানা গেছে, তার মধ্যে একটি ঘটনার সঙ্গেও সাম্প্রদায়িক হিংসার কোনও সম্পর্ক নেই। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ সাতটির সঙ্গে চুরি ও দস্যুতার সম্পর্ক রয়েছে, চারটিতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কলহের ঘটনা জড়িত, তিনটি ক্ষেত্রে সাধারণ অপরাধ যেমন ধর্ষণ, অতিরিক্ত মদ্যপানে মৃত্যু এবং বিদ্রুপ করা নিয়ে দুই পক্ষের মারামরি থেকে মৃত্যু, দুইটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, দুইটি ব্যবসায়িক শত্রুতার জেরে মৃত্যু, একটিতে স্থানীয়দের সংঘাতে মৃত্যু, একটি জমিজমার বিরোধ সংক্রান্ত ঘটনায় মৃত্যু, একটি আত্মহত্যার ঘটনা এবং একটি মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও না জানা গেলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সেখানে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিষয় নেই।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কি সত্যিই নির্যাতিত? প্রকৃত চিত্রটি আসলে যেমন

এই ২৩টি মৃত্যুর তালিকায় এমন ব্যক্তিও রয়েছেন যিনি গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ডিসেম্বর মাসে হাসপাতালে মারা যান। পুলিশের দাবি, এই প্রত্যেকটি ঘটনাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইনি পদক্ষেপ করা হয়েছে। এই ২৩ ঘটনার মধ্যে ২টি— যেখানে আত্মহত্যা ও জলে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে সেই দু'টি মামলার তদন্ত শেষ করে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। অপর ২১টি তদন্তাধীন মামলায় ইতিমধ্যেই ৪৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে ১৭ জন নিজেদের অপরাধের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছিল, গত সাড়ে চার মাসে দেশে গ্রামীণ পর্যায়ে ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের ২১ অগাস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানায় ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার এই হিংসাকে অন্যভাবে দেখতে চাইলেও ঐক্য পরিষদ মনে করে গত ৪ অগাস্ট থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিশানা করে তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যাবতীয় অপরাধ চালানো হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী এ ধরনের হিংসার শিকার হচ্ছেন। ঐক্য পরিষদের দাবি অনুযায়ী, ১৭৪টি ঘটনায় ২৩টি হত্যাকাণ্ড, ৯টি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৬৪টি উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুর, ১৫টি ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার ও নির্যাতন, ৩৮টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট বা অগ্নিসংযোগ এবং ২৫টি জোরপূর্বক বাড়িঘর, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন- ইস্কন করার ‘অপরাধে’ বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত কিশোরী? আসল সত্য জানুন

পরিষদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছে। পরিষদের দাবি, ৪০তম ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে নিযুক্ত ৮০৪ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে ২১ অক্টোবর থেকে ৪ ধাপে চাকরি থেকে সরানো হয়। চাকরি হারানো ৩২১ জনের মধ্যে ১০৩ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ৫৫ জন মহিলা কর্মকর্তার মধ্যে ৩৩ জনের চাকরি গেছে, যাদের মধ্যে ১৬ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ৪৩তম বিসিএসে ২২৭ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৮২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহাম্মদ ইউনূস বারবার জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার কোনও ধরনের হিংসাকেই সমর্থন করে না। একইসঙ্গে, এই ধরনের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হিংসা বলে প্রচার করাকেও উদ্বেগজনক বলেই মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে দেশের সার্বিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের সূত্রপাত ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা সরকারের। তাই সকল পক্ষকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ এক বিবৃতিতে দাবি করেছিলেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। 

More Articles