নির্বিচারে খুন-ধর্ষণ, বন্ধ‍্যা করে দেওয়া! চিনে কতটা অত‍্যাচারের মুখে উইঘুর মুসলিমরা

দেখা যাক, উইঘুর মুসলিমদের সামগ্রিক অবস্থা। তাদের বন্দিদশা, তাদের ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি!

কতটা কান পাতলে পরে কান্না শোনা যাবে
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে!

-কবীর সুমন

মানবিকতা আর মানুষের সার্থক বন্ধুত্ব আদিকাল থেকেই আজও অধরা। যেটুকু যেখানে রয়েছে সবটাই যেন ব্যতিক্রম! সবটাই যেন আলো আঁধারির খেলায় মত্ত থাকা কয়েকটা জোনাকি। সমগ্র বিশ্বের কোণায় কোণায় এই জোনাকির খেলা বড্ড কম। প্রতি মুহূর্তেই অন্ধকার আর বারমুডা রহস্যের মতো গোলধাঁধায় বাধা পড়ে সবটা। দিনের পর দিন শেষ হয় আলো। অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যায় প্রাণ। মানুষ আর মানবিকতার শেষ ঘটে ক্রমে ক্রমে!

প্রত্যেক মুহূর্তে এমনই একদল জোনাকি, একদল প্রাণ, বাঁচার চেষ্টা করলেও মুক্ত বাতাসে ফেরার লড়াই লড়লেও হেরে যাচ্ছে বারবার। শুধুই রাষ্ট্র আর তার রক্তচক্ষুর কাছে, বিষময় তরবারির কাছে হেরে যাচ্ছে ওরা। রোহিঙ্গা অথবা পৃথিবীর বহু অঞ্চলে এমনই জর্জরিত, অত্যাচারিত জনজাতির কথা আজ বলা হচ্ছে না। খুঁচিয়ে তুলে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে, বহু-আলোচিত উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়কে। দেখছি উইঘুর মুসলিমদের সামগ্রিক অবস্থা। তাদের বন্দিদশা, তাদের ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি! উইঘুর মহিলাদের জনন-ক্ষমতা নষ্ট, যোনিপথে বিদ্যুৎবাহী যন্ত্রের অত্যাচার, ধর্ষণ! দিনের পর দিন যে নৃশংসতার অভিযোগ সামনে এসেছে বা আজও আসছে, তাই-ই ফিরে দেখব আমরা।

আরও পড়ুন: হাজার বছর ধরে অত্যাচারিত, কেমন আছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরনার্থীরা?

কিন্তু ফের কেন আলোচনার কেন্দ্রে এল উইঘুর মুসলিমরা? মূল প্রসঙ্গের আবহে হঠাৎ উইঘুর আলোচনার সূত্রটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সম্প্রতি, ইউনাইটেড নেশন অর্থাৎ রাষ্ট্রপুঞ্জের (United Nations) মানবাধিকার শাখার (Human Rights) পক্ষে বুধবার, ভারতীয় সময় অনুযায়ী রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায়। ৪৯ পাতার রিপোর্ট যখন জেনেভায় (Geneva) প্রকাশিত হচ্ছে, ঠিক তার ১৩ মিনিট পরেই ওই শাখার প্রধান হিসেবে চার বছরের মেয়াদ শেষ করবেন মিচেল ব্যাখলেট (Michelle Bachelet)। যে রিপোর্টে বলা হয়, শিনজিয়াং (Xinjiang) প্রদেশে চিন (China) সরকারের তরফে উইঘুরদের (Uyghur) উপর অত্যাচারের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যেখানে মানবতার উপরে নির্মম অত্যাচার চলছে বলেও বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এক আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাকে মিচেল বলেন, আমার কার্যকালের মেয়াদ ফুরনোর আগেই আমি এই রিপোর্ট প্রকাশ করতে বধ্যপরিকর ছিলাম। এটি একটি বৃহৎ ইস্যু যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে খতিয়ে দেখা উচিৎ। 

চিনা প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আড়ালে শিনজিয়াং প্রদেশের লক্ষ লক্ষ উইঘুর মুসলিমকে অত্যাচার, আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। যেখানে শিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চলের (Xinjiang Uyghur Autonomous Region - XUAR) আড়ালে এই কাজ চলছে। যে প্রসঙ্গে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই অঞ্চলের অভ্যন্তরে আসলে কী ঘটছে তা খতিয়ে দেখা উচিৎ। সঠিক তদন্তের পক্ষেও সওয়াল করা হয় প্রতিবেদনে। যেখানে আরও বলা হয়েছে, উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখে তাদের চিকিৎসা না দেওয়া, জোর করে ওষুধ খাওয়ানো, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখা, যৌন অত্যাচারের মতো যে অভিযোগ উঠছে তা খতিয়ে দেখে তড়িঘড়ি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক বেজিং (Beijing)। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলেই মন্তব্য করা হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে। যদিও বরাবরের মতোই ফের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে চিন সরকার। উইঘুর মুসলিমদের একটা বড় অংশকে সরকার তাদের ইচ্ছাতেই ওই কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে দাবি বেজিংয়ের। এই প্রসঙ্গে, রাষ্ট্রপুঞ্জে চিনের প্রতিনিধি ঝাং ঝুং (Jhang Jhung) বলেন, তথাকথিত শিনজিয়াং ইস্যুটি পরিকল্পনা করে, চিনের এগিয়ে যাওয়া আটকে দিতে, রঙ চড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। ঝাংয়ের দাবি, আশা করব রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখা রাজনীতি বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ কাজ করবে, পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে নতিস্বীকার করবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে এই প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক বন্দীদের সঙ্গে অপরাধমূলক আচরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনাও রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে চিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কাজের অভিযোগ তোলা হয়েছে।

উইঘুর রিপোর্ট
উইঘুরদের প্রতি চিনের এই অত্যাচারের কাহিনি আগেও প্রকাশিত হয়েছে বারবার। বিশ্বের সামনে এসেছে ভয়ানক ইতিহাস। অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন 'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' (Amnesty International)- তাদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করে, চিন সরকার একাধিক উইঘুর মুসলিম গবেষকের একপক্ষ বিচার করেছে। খ্যাতনামা উইঘুর বিশিষ্টদের গত কয়েক বছরে আটক অথবা খুন করা হয়েছে। শিনজিয়াং থেকে উধাও হয়েছেন বহু। যার মধ্যে অন্যতম, শিক্ষাবিদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোকতি, নৃতাত্ত্বিক রাহাইল দাউদ, তরকা-বেহালাবাদক আবদুর রহিম হায়াত, ফুটবলার এরফান হিজিম-সহ একাধিক।

রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটি, ২০১৮ সালের শেষে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুরকে শিনজিয়াংয়ের ‘সন্ত্রাসবাদ সংশোধন’ নামক কেন্দ্রে আটক করে রাখা হয়েছে। প্রায় ২০ লক্ষ উইঘুরকে প্রশিক্ষণের নামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে!

এছাড়াও উইঘুর নির্যাতন নিয়ে একটি তথ্য শোরগোল ফেলে। যেখানে দেখা যায়, ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থার গবেষক, জার্মান নৃতত্ত্ববিদ আদ্রিয়ান জেনজ কিছু সরকারি নথি প্রকাশ করেন। একাধিক ছবি এবং বেজিং প্রশাসনের গোপন নথিতে দেখা যায়, প্রত্যেক মুহূর্তে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে বন্দি থাকা উইঘুরদের উপরে। শিনজিয়াং প্রদেশের সরকারি তথ্যভান্ডার হ্যাক করে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং (Xi Jinping)-সহ একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিক নির্দেশ দিচ্ছেন উইঘুরদের জোর করে ধরে আনার। 'ভিকটিম অফ্ কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফান্ড'- নামে অনলাইনে 'দ্য জিনজিয়াং পুলিশ ফাইলস্' নামে ফাঁস করা হয় এই তথ্য। এই প্রসঙ্গে 'আলজারিরা'-কে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে জেনজ বলেন, 'ওই অঞ্চল থেকে ফাঁস হওয়া নথি ও প্রমাণের মধ্যে এই পর্যন্ত এইগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, উল্লেখযোগ্য। আমরা ইতিপূর্বে যত প্রমাণ পেয়েছি, সেগুলোর চেয়ে এসব আরও বেশি উল্লেখ করার মতো। কেন না এসব ছবি ও নথিতে নির্যাতনের বহু প্রমাণ রয়েছে।'

ধর্ষণ, বন্ধ্যাত্ব এবং উইঘুর
প্রশিক্ষণের নামে আটকে রেখে নির্বিচারে ধর্ষণ করা হচ্ছে মহিলাদের। একের পর এক মহিলাকে ওষুধ দিয়ে, অত্যাচার করে জননক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে চিনা প্রশাসন। শিনজিয়াং জুড়ে এই দুর্বিষহ অত্যাচার চালানো হচ্ছে উইঘুর মুসলিমদের ওপর। এমন অভিযোগ উঠছিল বারবার। কিন্তু কোনও অভিযোগই স্বীকার করেনি বেজিং। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংবাদসংস্থা 'বিবিসি'-র একটি প্রতিবেদন। যেখানে শিনজিয়াং প্রদেশের বন্দিশিবিরে বহুদিন আটক থাকা এক মহিলার বিস্ফোরক জবানবন্দি প্রকাশিত হয়। তুরসুনে জিয়াউদুন নামে ওই মহিলা বলেন, মধ্যরাতে মুখে মুখোশ পরে আসত কেউ কেউ। নিজেদের পছন্দের মহিলাদের নিয়ে যেত ওরা। বয়স মানত না দুর্বৃত্তরা। একটি কালো ঘরে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে কোনও ক্যামেরার নজরদারি ছিল না। সেখানেই চলত অত্যাচার। একের পর এক ধর্ষণ করত। জিয়াউদুন নিজেও মাত্র কয়েক মাসেই তিনবার গণধর্ষিত হয়েছেন ওই বন্দি শিবিরে, এমনই দাবি করেন তিনি। আরও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানান নির্যাতিতা। তিনি বলেন, একবার দুর্বৃত্তরা আমার সঙ্গেই একটি কুড়ি বছরের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। সে ঘরে ফিরে আর কথা বলেনি। একটি ঘরে, একটি অপরিষ্কার বাথরুম আর ১৫ জন মহিলাকে রাখা হত। এক এক দিন এক এক জনকে তুলে নিয়ে যেত ওরা। তিনি বিবিসি-র ওই প্রতিবেদনে দাবি করেন, "বন্দি মহিলাদের জন্য কিছু কাজের জন্য বয়স্ক মহিলা নিয়োগ করা হত। একবার আমার পেটে লাথি মারে ওরা, রক্তপাত হয়। অসুস্থ হয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ মহিলা আমার অসুস্থতার কথা বলেন ওদের। তবুও আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্ষণ না করে আমার গোপনাঙ্গে বিদ্যুৎবাহী লাঠি দিয়ে অত্যাচার চালানো হয়।"

তরসুনের স্বামী পার্শ্ববর্তী দেশ কাজাখিস্তানে কাজ করতেন। তাঁরা আসলে ওই দেশেরই বাসিন্দা। শিনজিয়াং প্রদেশে এসে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন এবং এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর স্বামীকেও আটকে রাখা হয়। পরে সে অসুস্থ হলে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিজের দেশে ফিরে যায় জিয়াউদুনের স্বামী। তারপর প্রায় ১৮ মাসের চেষ্টায় ওই মহিলা বন্দি শিবির থেকে বেরতে সক্ষম হন। কিছুদিন কাজাখিস্তান, পরে আমেরিকায় চলে আসেন। জিয়াউদুন কতটা সত্যি বলছেন, তা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যেই চিনের বাইরে থেকে ওই বন্দিশিবিরে একদা কর্মরত এক নিরাপত্তারক্ষী স্বীকার করেন যে, উইঘুর মহিলা এবং বন্দিদের ওপর অত্যাচারের কথা। এমনকি মহিলাদের জোর করে ওষুধ খাইয়ে জননের ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার ঘটনা ঘটানো হত বলেও দাবি করা হয়। এদিকে শিনজিয়াং প্রদেশের এক বন্দিশিবিরে কাজ করতেন গুলজিরা আওয়েল খান। তিনি বন্দিশিবিরে, যাকে চিনা সরকার প্রশিক্ষণ শিবির বলে দাবি করে। সেখানে পড়াতে যেতেন। তিনি দাবি করেন, ভরদুপুরেও আর্তনাদ শুনতে পেতেন তিনি।

অভিযোগ ওঠে, প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করা হতো মহিলাদের। পুরুষ বন্দিদের ওপর নৃশংস-নির্মমতার সঙ্গেই চলত রাষ্ট্রের পক্ষের নানা অনুষ্ঠান দেখানো। বারবার রাষ্ট্রের পক্ষের কথা বলানোর চেষ্টা চলত শিবিরে। পায়ুপথে ইলেকট্রিক শক-সহ একাধিক অত্যাচার চলত ওই শিবিরে থাকা বন্দিদের উপর, এই অভিযোগ ওঠে বারবার। 

কেন এই পরিস্থিতি?
চিনের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ, পশ্চিমি দুনিয়ার তীব্র প্রতিবাদের মধ্যেই প্রায় চুপ বিশ্বের তাবড় মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, বাংলাদেশের তরফে মাঝে মাঝে খানিক প্রতিবাদ হলেও উইঘুরদের উপর অত্যাচারে, ইহুদি হত্যার মতো খুব একটা বিচলিত নয় বাকিরা। যদিও চিনের তরফে সবটাই মিথ্যা বলেই দাবি করা হয়। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি?

শিনজিয়াং প্রদেশ চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। এই প্রদেশের আয়তন বৃহৎ। প্রায় ১৬ লক্ষ সাড়ে ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো প্রায় ১০টি দেশের সমান। এই প্রদেশ অর্থাৎ শিনজিয়াং আয়তনের দিক থেকে চিনের প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ। এর পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান, কাজাখাস্তান। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান আফগানিস্তানের। রয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের একটি অংশ, আছে মঙ্গলিয়াও। এই প্রদেশটি তেল, গ্যাস, সোনা-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এদিকে বিশ্বের মোট উইঘুর জনজাতির প্রায় ৯০ শতাংশ এখানে বসবাস করে। ২০০৯-১০ সালের হিসেবে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ উইঘুর বাস করেন এখানে। বাকি কয়েক লক্ষ উইঘুর মুসলমান কাজাখাস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তান, তুরস্ক এবং রাশিয়ায় থাকে। ওই সময়ের হিসেবে মাত্র ১৯৭ জন উইঘুর থাকতেন ইউক্রেনে। অর্থাৎ বিশ্বের সিংহভাগ উইঘুর, যাদের প্রায় সবটাই শিনজিয়াং প্রদেশে।

৯৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনে ১৪৪ কোটি মানুষের বাস চিনে। সেই দেশের মোট ২২টি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রদেশের নাম শিনজিয়াং। সমগ্র চিনে আনুমানিক ৪০ হাজার মসজিদের মধ্যে ২৫ হাজার মসজিদই শিনজিয়াং প্রদেশে। অর্থাৎ চিনে মুসলিম জনসংখ্যার অধিকাংশই এই প্রদেশে। সমস্যার শুরু এখান থেকে। প্রথমত, আয়তন। দ্বিতীয়ত, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। তৃতীয়ত, তথাকথিত চিনা সম্প্রদায়ভূক্ত নয় এমন জাতির আধিক্য। যাদের মধ্যে চিনা সংস্কৃতি, ভাষার প্রভাব প্রায় নেই। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বেজিং বরাবর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলকে কখনোই তিব্বতের মতো অবস্থায় যেতে দিতে চায়নি। রাষ্ট্র সবসময় চেয়েছে উইঘুরদের যেনতেনপ্রকারেণ নিয়ন্ত্রণ করতে। নইলে বৃহৎ আয়তন আর নির্দিষ্ট জাতির সুবিধা নিয়ে চিন থেকে বেরিয়ে আসা যে খুব একটা কঠিন হবে না, সেটা বুঝতে পারছিল চিন সরকার। এই পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে এবং চিনাদের মুসলিম অসন্তোষের জোড়া ফলাকে অস্ত্র করে নির্মম অত্যাচার নেমে এসেছে উইঘুরদের ওপর। যেখানে রাষ্ট্রের লাভের জন্য, বাণিজ্যের জন্য, যেমন বিবিধ প্রাকৃতিক সম্পদ আয়ত্ত করা গিয়েছে, বিপরীতভাবে একটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রভাব সহজেই সমূলে বিনাশ করা গিয়েছে। যারা সমগ্র বিশ্বের মূলস্রোতের মুসলমান নয়, খানিকটা সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু জাতি! এই সূত্রেই দমনপীড়নের মাধ্যমেই এগতে চেয়েছে চিন। উত্তর কোরিয়ার মতো অথবা পুরনো তালিবান শাসনের মতো প্রকাশ্য দমন বেজিং না আনলেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অন্দরেই গড়ে তুলেছে 'ব্রেনওয়াশ' এবং ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার যন্ত্র। যেখানে চার দেওয়ালের অন্ধকার কূপের বাইরের চাকচিক্যের মধ্যেই ক্রমশ চলছে অত্যাচার। অর্থাৎ বাইরের বিশ্বের কাছে দেশের একটা গোষ্ঠীর, অনগ্রসরতা নিয়ে তাদের উন্নতি নিয়ে পদক্ষেপের প্রকাশ করলেও আসলে তার আড়ালে; 'হয় আমার হও, হয় আমাদের মত হও, আমাদের মতো থাক, আমাদের মত বলো, নয়তো মর' -এই সূত্রকেই কাজে লাগিয়েছে শি জিনপিং? যেখানে অত্যাধুনিক চিনের গায়ে যাতে বদনামের আঁচ না লাগে, তা নিশ্চিত করতে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টাই কি হচ্ছে নিরন্তর। এই অভিযোগ করে পশ্চিমী দুনিয়াও। উইঘুর মুছতে চিনের দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়  মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কিন্তু সবটাই বাইরে। চিনের অন্দরে উইঘুর এবং শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত করার তত্ত্ব ছাড়া আর প্রকাশ হয় না কিছু। যদিও শি জিনপিং সরকার কোনও দাবিই সমর্থন করে না।

এখানেই ওঠে কিছু প্রশ্ন। যেখানে পরিসংখ্যান বলে, উইঘুর জনজাতির বিলুপ্তির দিন এগিয়ে আসছে দ্রুত, মহিলাদের বন্ধ্যাত্বকরণ এবং নির্মম অত্যাচার, খুন ক্রমশ কমাচ্ছে উইঘুর-সংখ্যা। অর্থাৎ একদা চিনের অন্যতম বৃহৎ জনজাতির অবস্থা কেন এমন? কী কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব? এর সদুত্তর পাওয়া যায় না চিন সরকারের তরফে। তাহলে কি অত্যাচারের সঙ্গেই উইঘুর মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যাও করছে চিন! গণহত্যার তথ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে না বলা হলেও একাধিক অসমর্থিত সূত্রের দাবি, উইঘুর শেষ করতে এই পন্থাও নিয়েছে শি জিনপিং প্রশাসন। যেখানে উঠে আসছে একদা শি জিনপিংয়ের শিনজিয়াং প্রসঙ্গও।

কিন্তু কী লাভ এই ঘটনা ঘটিয়ে?

উইঘুর সম্প্রদায় মূলত তুর্কি বংশোদ্ভুত জনজাতি। মধ্য এশিয়ায় বসবাস। সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি সংখ্যালঘু জনজাতির মধ্যে রয়েছে উইঘুর মুসলিমরা। যাদের সিংহভাগই চিনের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাস করে। যার প্রায় ৮০ শতাংশ, ওই প্রদেশের তারিম বেসিন অঞ্চলে থাকে। এর বাইরে চিনের মধ্য হুনানে উইঘুরদের বাস। এছাড়াও কাজাখাস্তান-সহ একাধিক দেশে এই জনজাতির দেখা মেলে। এরা সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ের। তথাকথিত একাধিক জনজাতির মধ্যে শান্ত প্রকৃতির।  কিন্তু এখানেই বেঁধেছে গোল। বরাবর এক জাতির সংখ্যাধিক্য অন্যের বিনাশের সূত্র হিসেবে কাজ করে। সেই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং হিন্দুদের প্রাণ সংশয় এবং সাম্প্রতিককালের রোহিঙ্গা ইস্যু। সব ক্ষেত্রেই সংখ্যার দিক থেকে বড় কোনও জনজাতির প্রভাবে বাধা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় নিরন্তর। সেখানে ক্রমশ অন্যের প্রভাব খর্বের চেষ্টাও চলে। এই অবস্থায় বিশ্বে উইঘুরের সর্বাধিক প্রভাবের শিনজিয়াংও যে এর কবলে পড়বে, তা-ও বলা যায়। কিন্তু অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, পশ্চিমী দুনিয়ার মাঝে মাঝে প্রতিবাদ এবং চিনের অস্বীকারের যাঁতাকলে আর কতদিন দলিত, নিষ্পেষিত হবে শান্ত সুন্নি ইসলাম ধর্মের উইঘুররা! প্রশ্ন উঠছে, কিন্তু উত্তর?

More Articles