গোয়ালন্দ কারি: মাঝিমাল্লার হাতে তৈরি মুরগির ঝোলের স্বাদ আজও ভোলেনি বাঙালি
গোয়ালন্দর খাবার নিয়ে যাঁরা এখনও নস্টালজিয়ায় ভোগেন, তাঁদের জন্য রইল এই উপহার। বাড়িতেও বানিয়ে নিতে পারেন এই রেসিপি।
বাঙালি হেঁশেল চিরকালই রঙিন। নিজস্ব বাঙালি খাবারের স্বাদ ছাড়াও অন্য রাজ্যের বা দেশ-বিদেশের খাবারের স্বাদকে সে ডেকে এনেছে রান্নাঘরে। খেতে ভালবাসে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দায়! তবে শহুরে বাঙালির রান্নাঘরে শুধু যে বিদেশি খাবারই গৃহীত হয়েছে, তা নয়, কখনও কখনও মাঝি-মাল্লার খাবারও ঠাঁই পেয়েছে তার হেঁশেলে।
এপার-ওপার বাংলার রান্না নিয়ে অনেক কাড়াকাড়ি আর মারামারি তো আছেই। এপার-ওপারের ইলিশ নিয়েও আছে দ্বন্দ্ব, কিন্তু ওপারে পদ্মাপারের গোয়ালন্দের কথা মনে রেখেছে ক'জন? ওপার বাংলা থেকে চলে আসা কিছু প্রবীণদের মনে আজও গোয়ালন্দ বিদ্যমান। তাদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে পদ্মার ওপারে গোয়ালন্দের নানা কাহিনি। আর গোয়ালন্দের স্টিমার কারি তার মধ্যে অন্যতম। জাহাজের মাঝি-মাল্লা, খালাসিদের হই হই করে রান্না করা, জিভে জল আনা অনবদ্য এই মুরগির ঝোলের গল্প করতে করতে এখনও তাদের নোলায় জল পড়ে।
অকালপ্রয়াত কবি পিনাকী ঠাকুরের লেখাতেও উঠে আসে গোয়ালন্দ ঘাটের কথা। তিনি লিখেছেন, 'নাম শোনছেন গোয়ালন্দ? স্টিমার ঘাটে ভাতের হোটেল।/ ইস রে সে কী ইলশে মাছের সোয়াদ– কী ভাই শোনছেন নাম?'- এই ঘাট পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলকাতাকে আত্মীয়তায় বেঁধে রেখেছে বলা যায়। গোয়ালন্দ ঘাট হচ্ছে বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার অন্তর্গত একটি নৌবন্দর। এই ঘাট পদ্মা নদীর পারে।
১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়া পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়। এরপর ১৮৭১ সালে এই রেলপথ সম্প্রসারিত হয় গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত। ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার তখন প্রধান ভরসা গোয়ালন্দ ঘাট। আর এই দীর্ঘ জলপথে পরিবেশিত হতো বিখ্যাত স্টিমার কারি। যে খেয়েছে, সে জানে তার স্বাদ! এ এমনই এক পদ, যার স্বাদে, বর্ণে, গন্ধে চারিদিক ম ম করত।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মানকচুর জিলিপি স্বাদে টেক্কা দেবে যে কোনও মিষ্টিকে
কী এই গোয়ালন্দ স্টিমার কারি?
গোয়ালন্দ স্টিমার কারি- এই নাম আজ আর কারও মনে পড়ে না চট করে। কিন্তু একসময় এই পদের নাম শুনলেই জিভে জল আসত বাঙালির। সাধে কি আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ভালবেসেছিলেন তাকে। খাদ্যরসিক সৈয়দ মুজতবা আলিও তাঁর বিভিন্ন লেখায় এই স্টিমার কারির কথা উল্লেখ করেছেন। স্টিমারের নাবিকরা নিজেদের জন্য বানাতেন এই পদ। এর স্বাদ চাখতে গেলে নিত্যযাত্রীদের সাধ্যসাধনা করতে হতো যথেষ্ট। কিন্তু একবার খেলে, ভুলতে পারতেন না কেউই। আজকের গোয়ালন্দে এই পদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কী গোপন রহস্য আছে এই স্টিমার কারির?
আচ্ছা বলুন তো কী আছে এই স্টিমার কারির মধ্যে, যা অধুনা বাংলাদেশের গোয়ালন্দ থেকে কলকাতাগামী স্টিমার যাত্রীদেরও মুগ্ধ করেছিল? মুরগির ঝোল তো কতই হয়। কিন্তু তাও মানুষ কেন এর কাছে বারবার ফিরে যেতে চায়? এই মুরগি রান্না বাঙালি মুরগির ঝোলের থেকে আলাদা। সেই গোয়ালন্দ ঘাটের রেস্টুরেন্টে, কিংবা স্টিমারের পাচকদের হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ যাঁদের হয়েছিল, তাঁদের মুখে যেন এখনও লেগে আছে সেই রান্নার স্বাদ।
গোয়ালন্দ স্টিমার কারির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গুঁড়ো মশলা নয়, কুঁচোনো মশলা দিয়েই রান্না হয় এই পদ। গতানুগতিক রান্নার সঙ্গে স্বাদের তফাৎটা তৈরি হয় সেখান থেকেই। ঝাল এই রান্নার আরেকটি বৈশিষ্ট্য, কিন্তু তাতে মেজাজ বিগড়োনোর ভয় নেই। না আছে শৌখিন মশলার বিলাসিতা, না আছে বাটা মশলা। যা সহজলভ্য ছিল মাঝিদের কাছে, তাই দিয়েই তৈরি এই অসামান্য রান্না।
গোয়ালন্দ স্টিমার কারি রান্নার প্রণালী
কী কী লাগবে
মুরগি ৫০০ গ্রাম, মাঝারি আকারের পেঁয়াজ ৩খানা , ছোট রসুন একটা গোটা, আদা এক ইঞ্চি পরিমাণ, বড় কাঁচালঙ্কা ৪-৫ টা, শুকনো লঙ্কা ২-৩ খানা, হলুদ এক চামচ, নুন পরিমাণ দেখে আন্দাজে, সরষের তেল (৬ টেবিল চামচ), কুঁচো চিংড়ি মাছ ১০০ গ্রাম (এখানেই তো ওস্তাদের মার)।
প্রণালী
পেঁয়াজ একদম ছোট কুচি কুচি করে কাটতে হবে। ঝাল মুড়িতে মাখার সময় যেমন কুচি করে, সেরকম। আদা-রসুন আর লঙ্কাও (কাঁচা ও শুকনো) সেভাবে ছোট ছোট কুচি করে কেটে নিতে হবে। এবারে মুরগি ভালো করে ধুয়ে একটা কাচ বা প্লাস্টিকের পাত্রে রাখুন। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, লঙ্কা , হলুদ আর নুন দিন। ৬ টেবিল-চামচ সরষের তেল দিন। কোনওরকম সাদা তেল দিয়ে এই রান্নাটা হবে না। খুব ভালো করে মাখুন বেশ সময় নিয়ে। এবারে ১ ঘণ্টা রেখে দিন ঢাকা দিয়ে।
এরপর কুঁচো চিংড়ি ভালো করে ধুয়ে মাথা, খোলা ও পা বাদ দিয়ে দিন। এবারে বাকি চিংড়িটা খুব মিহি করে বেটে নিন। ছুরি দিয়ে বারবার করতে থাকলেই হবে। হামানদিস্তা বা শিলনোড়ার দরকার নেই। খুবই কম পরিমাণ হয়ে যাবে চিংড়ি, কিন্তু ওইটুকুই লাগবে। তার বেশি নয়।
রান্না
একটা ছোট ডেকচি বা কড়ায় ৩-৪ চামচ সরষের তেল দিন। চিংড়িবাটাটা মুরগি-মাখায় মিশিয়ে দিন। তেল গরম হয়ে গেলে মুরগি-মাখাটা কড়ায় ছাড়ুন। আঁচ বেশি রাখবেন না। আঁচ অর্ধেক কমিয়ে রাখুন। ৫-৭ মিনিট নেড়ে-ঢেকে দিলেই আসল কাজ শেষ। তারপর আঁচ একেবারে কমিয়ে দিন আর ঢাকা দিন ভালোভাবে, যেন খুব বেশি বাষ্প বেরিয়ে যেতে না পারে। জল দেওয়ার দরকার নেই, মাংস কষে গেলে নিজে থেকেই ঝোল বেরিয়ে আসবে। মাংস সেদ্ধ হয়ে নরম হয়ে এলে উনুন বন্ধ করে দিন। কিন্তু কড়ার ঢাকা খুলুন আরও ১০-১৫ মিনিট পর।
গোয়ালন্দ স্টিমারের মুরগি খাবেন ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে। দয়া করে রুটি, লুচি, পরোটা, পাঁউরুটির সঙ্গে খেয়ে রান্নার বারোটা বাজাবেন না। যাঁরা ঝাল খেতে পারেন না, একটু সাবধানে খাবেন।
গোয়ালন্দ স্টিমার কারির তুরুপের তাস হল কুঁচো চিংড়িবাটা। তবে এই নিয়ে মতভেদও আছে অনেক। কেউ বলেন, মাঝি-মাল্লারা চিংড়ি পেল কোত্থেকে যে তা রান্নায় ব্যবহার করল? আবার অনেকে এর উত্তরে বলেন, দীর্ঘ জলপথে থাকা মাঝিদের কাছে কুঁচো চিংড়ি থাকা বিলাসিতা হবে কোন দুঃখে? তারা জলের থেকেই তো ধরে নিতে পারে। সে যাই হোক, নানা মতভেদ থাকলেও হারিয়ে যাওয়া এই স্টিমার কারি আবার নতুন জীবন ফিরে পেল সোমতপা ব্রহ্মচারীর হাত ধরে। তিনি সম্প্রতি অনলাইনে এই 'গোয়ালন্দ স্টিমার কারি'-র রেসিপি প্রকাশ করার পর তা অনেকেই শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তার 'বংকুক ডট কম' ওয়েবসাইটে এই রেসিপি দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, এই রান্নার গল্প তিনি শুনেছেন তাঁর বাবা-মার কাছেই।
গোয়ালন্দর খাবার নিয়ে যাঁরা এখনও নস্টালজিয়ায় ভোগেন, তাঁদের জন্য রইল এই উপহার। বাড়িতেও বানিয়ে নিতে পারেন এই রেসিপি। আর বাইরে গিয়ে খেতে চাইলে, কলকাতার বেশ কিছু নামী-দামি বড় বড় রেস্তোরাঁ এবং ক্লাবে অর্ডার করলে আজও দেখা মেলে পদ্মাপারের সেই গোয়ালন্দ স্টিমার কারির।