কাজ না পাওয়ার অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন 'পথের পাঁচালী'-র হরিহর কানু বন্দ্যোপাধ্যায়
Kanu Banerjee: রবীন্দ্রনাথের সামনে যথারীতি কানু তটস্থ। এই বুঝি তিরস্কার করেন! অথচ অবাক কাণ্ড।
আমার মনে হয়, নাটক ভালোবাসেন যাঁরা, তাঁরা যদি প্রতিদান না চান, তবেই যেন স্টেজে অভিনয় করতে আসেন। ইদানীং আমি ভাগ্যবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। ভাদুড়ি মশাই কী পেয়েছেন? অথচ ওরকম প্রতিভা খুব কমই হয়। অভিনয় যাঁরা করতে চান, সাধক হিসেবে যেতে হবে, প্রোফেশন হিসেবে নিলে কী হবে জানি না। এখন আমি কোথাও অভিনয় করছি না, কেউ ডাকেন না আর। ভাঙা কুলো হয়ে পড়েছি আর কী! জ্ঞান হওয়া অবধি অভিনয় করে আসছি তো, তাই অভিনয় না থাকলে সন্ধেবেলা বড় ফাঁকা লাগে, কষ্ট হয়।
কানু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৭১ সালে এক প্রৌঢ় লিখছেন, নিজের স্মৃতিচারণে। প্রতিধ্বনি যেন। খানিকটা এমন কথাই বলে গিয়েছিলেন মানিক। যদিও তিনি আলোর জগতের লোক ছিলেন না। কিন্তু কানু, অর্থাৎ কানাইলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রঙিন জগতের লোক, আলোকবৃত্তর মধ্যে যেখানে রং ঝলমল করে ওঠে, অথচ ভাগ্যের পরিহাস! মানুষটা সাদাকালোই রয়ে গেলেন জীবনের শেষ দিন অবধি। অনেকখানি পরিশ্রমের পরেও যখন হাত খালি হয়ে আসে, বুক উপড়ে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস, সে বড় কঠিন ভার। সেই শূন্যতার ভারেই এক অনন্য অভিনেতাকে শেষ বয়সে এমন একটা কথা লিখে যেতে হয়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজের দু'-দুটো সরকারি চাকরি অবহেলায় ছেড়ে আসার কথা নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়েছিল। সেদিনের সেই আত্মবিশ্বাস নিংড়ে ছাতু করে ফেলেছে জীবন, শেষ প্রান্তে এসে দলাপাকানো ভগ্নস্তূপের গলায় হতাশা ছাড়া আর কীই-বা আশা করা যায়!
১৯৪৩-'৪৪ সাল। ব্রিটিশদের মধ্যে একটা 'যাব যাব' ভাব এসে গিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের দাগ তখনও জ্বলজ্বল করছে। কলকাতায় তখনও নালা থেকে মাড় চেটে খাওয়ার রেশ মানুষের মনে। চারদিকের এই অবস্থার আঁচ এড়িয়ে বাংলা সিনেমার জগৎ মোটামুটি একটা বৃত্ত তৈরি করে নিয়েছে। পাঁচের দশকে যে বৃত্ত ভাঙবে। এবং বেশ সশব্দে ভাঙবে। অরুণ চট্টোপাধ্যায়কে উত্তম করে তোলায় তার অনুরণন অনেকখানি দায়ী। কিন্তু সে আরও দশক খানেক। যে সময়ের কথা, তখন বিধান সরণিকে লোকে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট বলে চেনে। এই কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে ছিল কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট পোস্ট অফিসটি। আর পাঁচটা পোস্ট অফিসের থেকে আলাদা এই অফিসের একটা বিশেষত্ব ছিল। সকাল দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত কিছু ছেলেছোকরা এমনিই ঘোরাঘুরি করত অফিসটার সামনে। কেউ সিমলে-কাঁসিপাড়ার, কারও বাড়ি রায়বাগান, কারও বা গোয়াবাগান, চালতাবাগান, মায় ঠনঠনে-ও। কখনও দল বেঁধে, কখনও একা একবার না একবার অফিসের ভেতরে তারা ঢুঁ মারবেই। ব্যাপার কী? না, ওই যে ওপাশের কাউন্টারে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, মুখখানি কোমল, একমাথা ঘন কোঁকড়ানো চুল, পরনে সিল্কের শার্ট আর ধুতি… তাঁকে দেখতেই আসা। ভদ্রলোকের কাউন্টারে খুব একটা লোক-টোক আসে না। তবে আশপাশের কাউন্টার থেকে খাম, পোস্টকার্ড ইত্যাদি কেনার পর বা মানি অর্ডার সেরে সবাই এক ঝলক দেখেন ভদ্রলোককে। ব্যাপার আর কিছুই না, তাঁকে নানা সিনেমায় দেখা যায় মাঝেমধ্যেই। টুকটাক সামান্য চরিত্র। সেকালে সর্বত্র ভদ্রলোকের নাম লেখা থাকত, 'কানু বন্দ্যোপাধ্যায় (অ্যাঃ)'। এই 'অ্যাঃ' লেজুড়টিকে নাম থেকে খসাতে আরও বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু কেন এই 'অ্যাঃ'? আদতে আইনি ঝামেলা এড়াতে। 'অ্যাঃ' অর্থে অ্যামেচার। সরকারি দফতরে যাঁরা কাজ করতেন, এবং অভিনয়টাও করতেন, তাই নামের পাশে 'অ্যাঃ'।
সবাই দিন-রাত তাকায়। ব্যাপারটা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় খুব একটা পছন্দ করতেন না, করার কথাও নয়। একদিন দেখলেন কাউন্টারের একেবারে সামনে এক ছোকরা পেতলের রডগুলোর ফাঁক দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। খুব রাগ হলো। রুক্ষ গলায় ধমক দিয়ে বললেন, "অ্যাই খোকা, এখানে কী চাই কী? খাম পোস্টকার্ড কিনতে হয়তো ওদিকের কাউন্টারে যাও। যত্তসব আদেখলের দল।" ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ছেলেটি। এই ছেলেটিই পরবর্তীতে 'রূপাঞ্জলী' এবং 'উল্টোরথ'-খ্যাত সাংবাদিক হয়ে উঠবেন। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্য হবে। আগের সেই ধমকের কথা অবশ্য মনে ছিল না অভিনেতার। কোনওদিন মনে করাতেও চাননি রবি বসু। তবে মানুষটাকে কাছ থেকে দেখেছেন, চিনেছেন। অল্প বয়সে অমন একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলার জন্য নিজেরই অনুতাপ হয়েছে।
কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঙালি দর্শকদের একটা বিশেষ অংশ মনে রেখেছে কেবলমাত্র 'পথের পাঁচালী'-র হরিহর চরিত্রটির জন্য। তার রেশ ধরেই 'অপরাজিত'। এর বাইরে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় খুব একটা আলোচিত হননি তেমন। অথচ এই মাপের অভিনেতা বাংলা সিনেমায় প্রায় আসেনি বললেই চলে। তাঁর অভিনয় দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করেছিলেন। বারবার প্রশংসা পেয়েছেন শিশির ভাদুড়ীর কাছেও।
অভিনেতার জন্ম ২০ জুন, ১৯০৫। রাজস্থানের যোধপুরে পজপতরা নামক একটি গ্রামে। শ্রীকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নর্দান ইন্ডিয়ার সল্ট্ রেভিনিউতে কাজ করেন। সেই সূত্রেই রাজস্থান। পরে তিনি বদলি হয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ছেলের গানবাজনা, আবৃত্তি, অভিনয়ের ঝোঁক চোখ এড়ায়নি তাঁর। তবে বাধ সাধেননি। বরং উৎসাহ দিয়েছেন। কাজেই তিনি যখন বলেন, "জ্ঞান হওয়া অবধি অভিনয় করে আসছি"— একফোঁটাও বাড়িয়ে বলেন না। দশ-এগারো বছর বয়সেই নন্দলাল বসুর ঘরে তাঁর আবৃত্তি শুনে 'সাধু, সাধু' করে গিয়েছিলেন অমৃতলাল বসু। দিন যায়, মাস যায়, বছর। পাড়ায় শখের অভিনয় করেন। কমনীয় চেহারা। মিলত কেবল ফিমেল পার্ট। তাই সই। তাতেই নামডাক হলো। 'সান্ধ্য সমিতি'-র সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক তখনই। ১১ নম্বর কৈলাস বসু স্ট্রিটের এই অপেশাদার দলটি দেখাশোনা করতেন খোদ অর্ধেন্দুশেখরের ছেলে ভুবনেশ মুস্তাফি। অমলেন্দু লাহিড়ি, ভূমেন রায়, রতীন বাঁড়ুজ্যের মতো শিল্পীরা তখন অভিনয় করেন ওই দলে। ১৯৩৫ নাগাদ যখন চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেলেন, এই দলটিই 'প্রতাপাদিত্য' নাটক মঞ্চস্থ করে হাজার টাকা তুলে দিয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর হাতে। নাটকে স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করতেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদিকে অভিনয়, অন্যদিকে কাশিমবাজার পলিটেকনিক থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেই ঢুকে গিয়েছেন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলে। আরও পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু চাকরির ধাক্কায় পড়াশোনা আর এগোয়নি।
'সান্ধ্য সমিতি'-তে এসে রতীনের সঙ্গে খুব জমে গেল। রতীনের হাত ধরেই প্রথম পেশাদার মঞ্চে অভিনয়, এমনকী, ছবিতেও নামা রতীনের দৌলতেই। রংমহলে তখন নরেশ মিত্তির 'মহানিশা' নাটক পরিচালনা করছেন। রতীনেরও পার্ট রয়েছে। নিয়ে গেলেন কানুকেও সঙ্গে করে। কিন্তু কপাল মন্দ। মানানসই চরিত্র মিলল না। যোগেশ চৌধুরী সেসময় রংমহলেই। বললেন, "এখানে তো কিছু শিখতে পারবেন না, শিখতে হলে ভাদুড়ী মশাইয়ের কাছে যান।" তিনি শিশিরবাবুকে একখান চিঠিও লিখে দিলেন এই মর্মে। কিন্তু শিশিরকুমার কিছুতেই অভিনয়ের লাইনে আসতে দেবেন না কানুকে। ভালো সরকারি চাকরি করেন। এই লাইনে এসে তাঁর কাজ কী! "এ লাইন ভালো না, বাড়ির লোকই অপাংক্তেয় করে রাখবে"— এইসব বলে কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন বিস্তর। কাজ হয়নি। কানু অভিনয় করবেনই। শেষ পর্যন্ত শ্রীরামপুর টকিজ-এ 'আলমগীর' নাটকের অভিনয়ের সুযোগ জুটল। বিক্রম সোলাঙ্কির চরিত্র। ১৯৩২-এর এই শিশির-সঙ্গ কানুর বছর ষোলো নিরবচ্ছিন্ন ছিল। দাদাপ্রতিম শিশির যেমন ভালবাসতেন, আবার কোনো অভিনয় পছন্দ না হলে সবার সামনেই চেঁচাতেন—"কোথায় গেল কানাই, ইউ অ্যাক্টেড লাইক আ বাফুন!" দু'জনের সম্পর্ক ছিল এমনই আন্তরিক। পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লখনউ—কোথায় যাননি দু'জনে! সেসময় শিশিরবাবুর বহু নাটকে একাধিক চরিত্রে পর্যন্ত অভিনয় করেছেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। 'বিজয়া' নাটকে প্রথমে একটা ছোট্ট পার্ট ছিল। ধীরে ধীরে দেখা মোটামুটি সব চরিত্রই করছেন, মায় শিশিরকুমার-অভিনীত 'রাসবিহারী'-ও। তাই দেখে শিশির ভাদুড়ী মজা করে বলেছিলেন, "বিজয়াটা বাকি থাকে কেন, এটাও একদিন করে ফেল!" 'আলমগীর' নাটকে একদিনে করছেন 'এরাদত খাঁ' এবং 'ভীম সিংহ'—একটি কমিক, একটি আদ্যন্ত সিরিয়াস। শিশিরবাবুর মতো কড়া পরিচালক অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, "কানাই, আই ও ইউ অ্যান অ্যাপ্রিশিয়েশন!" অভিনয়ের এই গল্প যতটা সহজে বলা যায়, যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা জানেন, এই জিনিস মঞ্চস্থ করা ঠিক ততটাই কঠিন। অথচ সাবলীলভাবে করে গিয়েছেন কানুবাবু, দিনের পর দিন। 'দেশবন্ধু' নাটকে আরেক বিপত্তি। কানুর বিপরীতে শিশিরবাবু। কানুর সংলাপ শেষেই উনি ধরবেন। কিন্তু কার্যত কানুর সংলাপ শেষে দেখা গেল শিশির ভাদুড়ী কিছু বলছেন না। চুপ করে তাকিয়ে আছেন কানুর দিকে। তাই দেখে অভিনেতা আস্তে বললেন, 'বড়দা, এবার আপনি।' চটকা ভেঙে সামলে নিলেন শিশিরকুমার, এক মুহূর্তে। সেদিন স্টেজ থেকে নেমে কানুকে বলেছিলেন, "তোমার অভিনয় দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম।" জীবনে এত বড় স্বীকৃতি বোধহয় আর একবারই পেয়েছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো-বা এর থেকে সেবার পাওনা জুটেছিল খানিক বেশিই।
শিশিরকুমারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের খাতির ছিল ভালোই। স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। সেবার স্টার থেকে ঠিক হলো, 'যোগাযোগ' মঞ্চস্থ করা হবে। শিশিরকুমারের জন্য উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নবীনকৃষ্ণর ভূমিকায় কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামার ভূমিকায় রাণীবালা। রাণীবালা আরেক অবিস্মরণীয় নটী। তাঁকে নিয়েও আড্ডা হবে কখনও। তা নাটকের প্রথমদিন অভিনয় দেখতে এলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত-পা ঠান্ডা। শরীর কাঁপছে। গুরুদেবের সামনে তাঁরই সৃষ্ট চরিত্রে অভিনয়! যদি পছন্দ না হয়! মঞ্চে উঠে আর এসবকিছুই খেয়াল থাকল না। চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথ, হাজার হাজার দর্শক মিলিয়ে গেল। যেন কেউ কোত্থাও নেই। মহাকালের সঙ্গে দ্বৈরথে শিল্পী একা। সংলাপ, প্রতিসংলাপ। বাস্তব সমস্ত যোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তখন বাস্তব কেবলই চরিত্র। ঘোরের মধ্যে অভিনয় করে গেলেন সারাটা সময়। ঘোর ভাঙল সাজঘরে এসে। শুনলেন, গুরুদেব এদিকেই আসছেন। প্রাণ হাতে নিয়ে সে কী দৌড়! কোনওরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু তাতেও কি রক্ষে আছে? ফিরতে হলো সেই গ্রিনরুমেই। প্রবোধ সান্যাল খবর দিলেন, শমন এসেছে। একবার বাড়ি গিয়ে দেখা করতে বলে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। যাওয়ার ইচ্ছে খুব একটা ছিল না। শিশিরবাবু বগলদাবা করেই একরকম নিয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোয়। রবীন্দ্রনাথের সামনে যথারীতি কানু তটস্থ। এই বুঝি তিরস্কার করেন! অথচ অবাক কাণ্ড। গুরুদেবকে প্রণাম করতেই বলে উঠলেন, "তোমার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, তোমার স্ত্রীর অভিনয় দেখে উপভোগ করেছিলাম।" এর থেকে বড় স্বীকৃতি আর কীই-বা হতে পারে!
'দুর্গেশনন্দিনী' প্রথম সিনেমা। তখন নির্বাক যুগ। কাটা সৈনিকের বা ওরকমই কিছু এক এক্সট্রার রোলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মেক আপ ম্যান সুবোধ বসু। ১৯৩৪-এ প্রথম সবাক ছবি 'শুভ ত্রহ্যস্পর্শ'। স্বপনবুড়োর গল্প নিয়ে সেই ছবি করেছিলেন খোদ মন্মথ রায়। সেই থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত অভিনয় করেছেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। মোট ছবির সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১১২, আবার কেউ বলেছেন, তিনশোরও বেশি। এক 'হরিহর' ছাড়া আর কোনওটিই মনে রাখেনি বাঙালি দর্শক। সেই চরিত্রে আসার জন্য কুড়ি বছর ও ছিয়াশিটি ছবি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। আমির আলি অ্যাভিনিউতে 'মেস নাম্বার ফর্টিনাইন'-এর একটি আমন্ত্রিত অভিনয়ের সময় সত্যজিৎ নিজে দেখা করে অভিনেতাকে হরিহর চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। বলেছিলেন, "অনেক দেখেই আপনাকে ভালো লেগেছে, আপনাকে দিয়েই রোলটা হবে।" সেই সত্যজিৎ-ই বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন ওঁর ওপর, শুটিংয়ের সময়।
হয়েছিল কী, শুটিং করার আগের দিন নাপিতের কাছে ভালো করে চুল ছেঁটে গিয়েছেন কানুবাবু। পরের দিন সেটে যখন এলেন, সত্যজিৎ গম্ভীর। গ্রামের কবিপ্রাণ কথকের এ হেন পরিপাটি করে ছাঁটা চুল! 'পথের পাঁচালী' কীভাবে প্রযোজিত, তা আজ অনেকেই জানেন। তারই মধ্যে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে শুটিং বন্ধ করে দেন রায়সাহেব। বলেন, কানুবাবুর চুল আগের মতো বাড়ুক, তারপর শুটিং হবে। এতটুকু ক্ষুব্ধ হননি অভিনেতা, বরং জনে জনে বলে বেড়িয়েছিলেন, এই প্রথম এমন একজন পরিচালক দেখলেন, যিনি বাস্তব চরিত্র তৈরির তাগিদে চরিত্রের চুল কতটা কী থাকবে না থাকবে- সেদিকেও নজর রাখেন। পরের ছবি 'ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' চলেনি। কিন্তু মেক আপ দেখতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ওঁর নাকি খুব পছন্দও হয়েছিল। চরিত্র নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করে অভিনয়ে নেমেছিলেন। বলেছিলেন, "রামকৃষ্ণের ইন্টালেক্টটাকে ধরতে চেয়েছিলাম।" কিন্তু 'ন্যালা-খ্যাপা সাধক' হিসেবে রামকৃষ্ণের ভাবমূর্তি যে দর্শকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তারা সে-জিনিস দেখবে কেন! সত্যজিৎ-ও আর কোনও ছবিতে কাস্ট করেননি কানু বাবুকে। অভিমান ছিল, রবি বসুকে বলেছিলেন, "সত্যজিৎবাবু তো তাঁর ওই দুটো ছবিতে কানু বাঁড়ুজ্যেকে কাস্ট করেননি, করেছিলেন নিশ্চিন্দিপুরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ হরিহর রায়কে। তা কাশীতে তার দেহ রাখার সঙ্গে সঙ্গে হরিহরের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। ব্যস, খেল খতম।" বলতে বলতে গলা ধরে আসে। পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছবি 'প্রিয়তমা'। মোটর মেকানিকের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করলেন। চিত্ত বসু্র 'পূরবী'-তেও মিস্ত্রি। তিনি যে কী মাপের অভিনেতা, তা বোঝা যায় একের পর এক করে যাওয়া কাজের মান দেখে। অজয় করের 'জিঘাংসা'-য় তাঁর অভিনয় অবিস্মরণীয়। অথচ সেই শিল্পীকে কাজ পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করতে হচ্ছে। রোজগার নেই বলে আক্ষেপ করতে হচ্ছে। একবুক অভিমান। কিন্তু স্মৃতিচারণে সত্যজিতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার লেশমাত্র থাকতে দিচ্ছেন না—
ছবি ঠিক কীরকম হওয়া উচিত, ছবির আসল ভাষা কী, তার একটা বাস্তব আর প্রত্যক্ষ চেহারা সত্যজিৎই প্রথম আমাদের দেখান। ক্যামেরাকে কতভাবে ব্যবহার করা যায় তা উনিই প্রথম চিন্তা করেন। ছবি দেখা হয়, ক্যামেরার চোখ দিয়ে— এইখানেই তো থিয়েটার আর ফিল্মের তফাৎ। একথা কিন্তু সত্যজিতের আগে কেউ তেমন করে ভাবেনি। আর কী ভীষণ ডিটেলের কাজ ওঁর ছবিতে—সেইজন্যই বোধ হয় ওঁর ছবির চরিত্রগুলো এত চেনা আর বাস্তব বলে মনে হয়। আগের যুগের ছবিতে মোটামুটি গল্পটা বলে যাওয়া হত শুধু, সবকিছুকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার জন্য প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে এত বেশি নজর থাকত না। শুধু চরিত্র নয়, সব কিছুরই যতটা সম্ভব বাস্তব চেহারা। বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম 'পথের পাঁচালী' আর 'অপরাজিত' এই দুটি ছবির কাজ পেয়ে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এদেশে এই মাপের একজন অভিনেতা আনন্দদায়ক চরিত্র হিসেবে আর একটিরও নাম করতে পারেন না। যোগেশ চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ি, তুলসী চক্রবর্তী, প্রভাদেবী, রাজলক্ষ্মীদেবী, মলিনা দেবী-র সঙ্গে এক সারিতে যাঁর নাম নেওয়া হয়, তিনি কানু বন্দ্যোপাধায়। বাংলা ছবির অন্যতম প্রধান এক চরিত্রাভিনেতা। সাবিত্রী থেকে ভানু, উত্তম, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়দের মধ্যে যাঁর অভিনয়ের প্রভাব রয়ে গিয়েছে। যিনি ১৯৪৭-এ পোস্ট অফিসের আরামের চাকরি অবহেলায় ছেড়ে দিয়েছিলেন অভিনয় করবেন বলে। দেবনারায়ণ গুপ্ত সেসময় গিয়েছিলেন, তাঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিরস্ত করতে। "এ কী করতে যাচ্ছেন? সম্পূর্ণ থিয়েটারের উপর নির্ভর করে পাকা সরকারি চাকরি কি ছাড়া উচিত?" শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন কানুবাবু। তারপর বললেন,
আমাদের আত্মীয়-বন্ধুরা অনেকেই ঐ একই কথা বলছেন। আপনাদের কথা খুবই যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু কেন জানি না মন আমার বলছে, কেরানিগিরির সঙ্গে অভিনয়-শিল্পকলা সাধনা একসঙ্গে চলতে পারে না। জানেন, পোস্ট অফিসের কাজে অনেক দায়দায়িত্ব আছে। এখানে কলম ধরে কাজ করি, আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ছায়াছবি আর নাটকের পার্ট। অসাবধাতায় যদি ভুলচুক করে ফেঁসে যাই? তাছাড়া কেরানিগিরির থেকে অভিনয় করাকেই আমি পছন্দ করি বেশি।
কী দায়িত্ববোধ! কী ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ে 'অভিনয় ভালবাসি' বলেছিলেন সেদিন। 'ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ'- র জন্য পারিশ্রমিক চাননি কিছু। বলেছিলেন, আপনাদের যা ইচ্ছে, তাই দেবেন। সেই কানু বন্দ্যোপাধ্যায় মুছে গিয়েছেন বাঙালি দর্শকের যৌথমানস থেকে। তাঁকে সত্যজিৎ ছাড়া আর ব্যবহারই বা করলেন ক'জন? এক সুশীল মজুমদার ছাড়া। শম্ভু মিত্রের এই আশঙ্কা ছিল। লিখেছিলেন, "কিন্তু কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অপূর্ব অভিনয় হয়েছে এ ছবিতে (পথের পাঁচালী) তা কি আদর পাবে?" ঠিকই লিখেছিলেন। নটসূর্য বা রসশ্রেষ্ঠ বা রাজকুমার— রঙিন জগতের কোনও বর্ণময় উপাধিই তাঁর জোটেনি। অভিমান-অবজ্ঞার ভার বহন করতে করতেই তলিয়ে গিয়েছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অশ্রুতি, বিস্মৃতির গহিন অন্ধকারে… নায়ক নন, মহানায়ক নন, বর্ণময় নন— কেবল সাদা-কালো। তিনি কেবল 'অভিনেতা'।