'আমার একটা হাত ওঁকে খুন করতে চায়', পরিচালককে নিয়ে একথা কেন বলেছিলেন উৎপল দত্ত

Rajen Tarafder-Utpal Dutt: রাজেনবাবু জীবনে খুব বেশি সিনেমা বানাতে পারেননি। তার কারণই ছিল ভদ্রলোক বেজায় খেয়ালি।

ছবির জগৎ ছায়ার জগৎ। পর্দায় নড়াচড়ার বাইরে যে কতরকম রসায়ন, তা বলে শেষ করা যাবে না। একটা সমান্তরাল সমাজ এই ক্ষেত্রটি। তাতে হাসি-কান্না, দোস্তির পাশাপাশি মন কষাকষি, মায় মামলা পর্যন্ত সব মজুত। তার মধ্যে পরিচালকদের দায়িত্ব আরও বেশি। চোদ্দোরকম মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। তাদের সামলানো, ম্যানেজ করা। যিনি লিখবেন, তিনিও খেয়ালি, যিনি অভিনয় করবেন, তিনিও। কাজেই পরিচালক চৌখস না হলেই কেলেঙ্কারি।

'পালঙ্ক' সিনেমাটির কথা মোটামুটি সবাই জানেন। বাংলাদেশে শুটিং হয়েছিল। তার পরিচালক ছিলেন রাজেন তরফদার। এই রাজেনবাবু জীবনে খুব বেশি সিনেমা বানাতে পারেননি। তার কারণই ছিল ভদ্রলোক বেজায় খেয়ালি। প্রযোজকেরা তাই রাজেন তরফদারের নাম শুনলেই উল্টোদিকে দৌড়োত। লেখক, অভিনেতার সঙ্গে খেয়ালি পরিচালক যোগ হলে কী বিষম বস্তু দাঁড়ায়, একটু বলি।

একটা টিনের চালের ওপর উৎপল দত্ত আর সন্ধ্যা রায়কে তুলে মই সরিয়ে নিয়েছেন রাজেনবাবু। ওখানেই শ্যুট হবে। এদিকে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। টিন গরম তাওয়া হয়ে আছে। উৎপলবাবু তো উঠেই চেঁচাতে শুরু করেছে— "ও রাজেনবাবু! এখানে দাঁড়াব কেমন করে? পুরো চালটা ফার্নেস হয়ে আছে গরমে। এক্ষুনি পায়ে ফোসকা পড়ে যাবে যে!"

আরও পড়ুন: স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের

—জাস্ট দুটো মনিটর। দুটো মনিটর সেরেই শট নিয়ে আপনাদের নামিয়ে আনছি।

রাজেনবাবুর আশ্বাস। চিঁড়ে ভিজল না সেই শুকনো আশ্বাসে। বেজায় গরম সেই তাওয়ার ওপর লাফাতে লাফাতে কোনও মতে রিহার্সাল দিয়েই দু'জনে বলে উঠলেন— "এবারে টেক তো?" আর টেক! এক দুই তিন চার— রাজেনবাবু রিহার্সাল করিয়েই চলেছেন। উৎপলবাবু কেবল তাগাদা দেন, পা দুটো গেল! মেক আপ গলেটলে একাকার! "সরি সরি। রুমাল দিয়ে ঘামটা একটু শুষে নিন। রেডি? সবাই রেডি?— স্টার্ট সাউন্ড।" রাজেনবাবু হাঁক পাড়লেন। ক্যামেরা নিচ থেকে ওপরে উঠবে। ক্ল্যাপস্টিক নিয়ে অরবিন্দ রেডি। রাজেনবাবু 'ক্যামেরা' বললেই ক্ল্যাপ সেরে দিয়ে বেরিয়ে আসবে। এমন সময় একটুকরো মেঘে সূর্য ঢেকে ফেলল। ব্যাস। রাজেনবাবু আর 'ক্যামেরা' বলেন না। ক্যামেরাম্যান সামলানোর চেষ্টায় ওদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, "বেশি নয়। হাওয়া দিচ্ছে, এক্ষুনি মেঘ সরে যাবে।" কাতর উৎপল দত্ত বললেন, "তাহলে একবার নিচে নামি? মেঘ সরলে আবার উঠে পড়ব।" 'উরে সব্বোনাশ!' রাজেনবাবু আঁতকে উঠলেন! উৎপলবাবু অবাক— 'কেন?' না। নামা যাবে না। কিছুতেই নামতে দেবেন না রাজেনবাবু। মনিটর, ক্রেনের সঙ্গে রিহার্সাল— সমস্ত কম্পোজিশন গড়বড় হয়ে যাবে। সন্ধ্যাও বোঝাচ্ছেন উৎপল দত্তকে। মেঘ সরে গেলেই শট হবে। কিন্তু হতচ্ছাড়া মেঘ আর সরে না। রাজেনবাবু নিচু গলায় অরবিন্দকে বললেন, "একটু চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছি, বুঝলে? আমায় দেখলেই ওই 'ধলা কত্তা' বারবার তাগাদা দিতে থাকবেন।" দাঁতে দাঁত চেপে উৎপল এবং সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছেন। রাজেনবাবু হাওয়া। দশ মিনিটের মাথায় ফের খর রোদ। কিন্তু পরিচালক বেপাত্তা। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষে দেখা গেল, খানিক দূরে নদীর ধারে ছোটখাটো একটা হাটে ভদ্রলোক বেশ ওজনদার একটা গুড়ের পাটালি কিনছেন।

—রাজেনবাবু! রাজেনবাবু! এ কী করছেন আপনি?
—কেন? কী হয়েছে?
—সান্ তো উঠে গেছে। উৎপলদা রেগে ফায়ার…
—ও! চলো চলো চলো…

গুড়ের পাটালিসমেত ফিরলেন পরিচালক।

'পালঙ্ক' ছবির একটি দৃশ্যে উৎপল দত্ত

'পালঙ্ক' ছবির একটি দৃশ্যে উৎপল দত্ত

সেইদিন রাতে নাকি উৎপল দত্ত বলেছিলেন, "আমার একটা হাত রাজেনবাবুকে খুন করতে চায়। আবার, একই সঙ্গে, অন্য হাতটা চায় ওকে স্যালুট করতে। কী ফ্যান্টাসটিক ডেডিকেশন লোকটার!"

এমন গুচ্ছের কীর্তি রয়েছে রাজেন তরফদারের। অথচ লোকটা সত্যিই জিনিয়াস। 'গঙ্গা'-র শুটিং শেষ হওয়ার পর দেখা গেল রিলের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ হাজার ফিট। মানে প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টার সিনেমা। কোনও সিনই কাটতে দেবেন না। শেষে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় যত্রতত্র কাঁচি চালিয়ে প্রযোজকদের উদ্ধার করেন।

Ganga

'গঙ্গা' ছবির একটি দৃশ্য

যা হোক, এসব দিক থেকে তরুণ মজুমদার ছিলেন অত্যন্ত হিসেবি। কাকে দিয়ে কীভাবে কাজ বের করে আনতে হবে উনি বিলক্ষণ জানতেন। এমনকী, একবার লেখককে মিথ্যে কথা বলে গল্পের স্বত্ব পর্যন্ত কিনে এনেছিলেন। আজ সেই ঘটনাই বলব।

তরুণ মজুমদারের প্রযোজক-ভাগ্য বরাবরই অতি উত্তম। খোদ উত্তম-সুচিত্রা থেকে ভি শান্তারাম, রাম গুপ্তা, বীরেন্দ্র তেওয়ারি, পূর্ণচন্দ্র রাও— সব নামকরা লোক প্রযোজনা করেছেন পরিচালকের বহু ছবি। তেমন আকস্মিকভাবেই একদিন কেএল মালহোত্রা এলেন তাঁর কাছে। খুব ইচ্ছে, পরিচালককে দিয়ে একটা ছবি করাবেন। এর আগে উত্তম-সুমিত্রা অভিনীত 'বিকেলে ভোরের ফুল' করেছেন। এইবার একটু অন্য রকমের ছবি করতে চাইছেন। কথা বলতে বলতেই পরিচালকের মনে পড়ে গেল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সেই গল্পের কথা। রসিক এবং পান্নালাল মুখুজ্জের সেই রসায়ন থেকেই 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এর মতো ছবি তৈরি হবে। আধঘণ্টার মধ্যে সব ফাইনাল। প্রযোজকের গল্প খুব পছন্দ হলো। তবে পছন্দ হলেই তো হলো না, স্বত্ব কেনা প্রয়োজন লেখকের কাছ থেকে। সেই উদ্দেশ্যে একটা চুক্তিপত্র লেখা হলো। সম্মানদক্ষিণার জায়গাটা ফাঁকা রেখে প্রোডাকশন ম্যানেজার নিখিলবাবুকে বিহার পাঠনো হল। বিভূতিবাবু তখন কখনও দ্বারভাঙায় থাকেন তো কখনও সমস্তিপুরে। নিখিলবাবুকে বলে দেওয়া হয়েছিল, সম্মাণদক্ষিণার ব্যাপারটা উনি যা বলবেন, তাইই, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবেন। দিন যায়, নিখিলবাবু বেপাত্তা। তিনি আর ফেরেন না। ব্যাপার কী? সবাই দুশ্চিন্তায়। বিদেশ-বিভূঁইয়ে কোনও বিপদটিপদ হলো নাকি!

চারদিনের দিন নিখিলবাবু ফিরলেন বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। ওঁর মুখ-চোখ দেখে পরিচালক আঁতকে উঠলেন। "কী হলো? এমন চেহারা হয়েছে কেন?"

—মরতে মরতে বেঁচে গেছি।

—মানে? এগ্রিমেন্ট সই হয়নি?

—সে তো এককথায়! উল্টে টাকার অঙ্কটা কিছুতেই লিখতে রাজি হলেন না। বললেন, তোমরাই সুবিধেমতো বসিয়ে নিও‌।

—তাহলে?

জানা গেল, সেসব কিছু নয়। খাইয়ে খাইয়েই তাঁকে একেবারে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন বিভূতিবাবু। চারবেলা লুচি, পরোটা, ঘি-ভাত থেকে আরম্ভ করে সাত রকমের ভাজাভুজি, চোদ্দো রকমের পদ, মাছ-মাংস-দই-পায়েস-ফল, ছ'-সাত রকম মিষ্টি! যত হাতজোড় করে বলেন এত খাবার অভ্যেস নেই, বিভূতিবাবু ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়েন, 'তাহলে রাতের ট্রেনেই ফিরে যাও। গল্প আমি দেব না।' তবে শেষ অবধি লড়ে গিয়েছেন নিখিলবাবু। হাল ছাড়েননি। এগ্রিমেন্ট এনেছেন। পরিচালকের জন্যেও নাকি দু'ঝুড়ি লিচু পাঠিয়েছেন লেখক।

এহেন অভিজ্ঞতার পর যেবার 'ফুলেশ্বরী'-র স্বত্ব আনার কথাটা উঠল, নিখিলবাবু শুরুতেই আঁতকে উঠে কাটিয়ে দিলেন, "সর্বনাশ! বলছেন কী! প্রাণ থাকতে আমি দ্বারভাঙা যাব না।" কিছুতেই তাকে রাজি করানো গেল না। এর মধ্যেই একদিন খবর এল লেখক খোদ কলকাতায় কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে আসছেন। ঠিকানা জোগাড় করে বেরিয়ে পড়লেন পরিচালক। মুখটা শুকিয়ে আমসি। দেখেই বিভূতিবাবু বলে উঠলেন, "ও কী? তোমায় অমন দেখাচ্ছে কেন?" তেতো গলায় পরিচালক জবাব দিলেন, "কিছুদিন ধরে বড্ড পেটের গোলমাল চলছে। ডাক্তার প্রায় সব খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু শুক্তো আর হালকা চারাপোনার ঝোল।" ডাহা মিথ্যে। কিন্তু বাজিমাত! গল্পের স্বত্ব কিনে বুক ফুলিয়ে ফিরে এলেন তরুণ মজুমদার।

Movie Poster

'ফুলেশ্বরী' ছবির পোস্টার

হিসেব এবং বেহিসেবের সীমারেখাটা বেশ গোলমেলে। সময়বিশেষে বাজেটের একটা ব্যাপার সমস্ত পরিচালককেই মাথায় রাখতে হয় বটে। কিন্তু মাথায় রাখা দরকার এই রাজেন তরফদারকে ফিল্ম লাইনের বেশিরভাগ মানুষই শ্রদ্ধা করে চলতেন। উৎপল দত্ত থেকে তরুণ মজুমদার— কেউই তার ব্যত্যয় নন। যে ক'টি সিনেমা তিনি বানিয়েছেন, তাতেই মোটামুটি জাত চিনিয়ে দিয়েছেন বলা যায়। সময়ের থেকে খানিক এগিয়েই থাকেন এইসব মানুষেরা। আজকের ওটিটি প্ল‍্যাটফর্ম থাকলে হয়তো 'গঙ্গা'-য় সেই বিস্তীর্ণ কাঁচি চালানোর প্রয়োজনও পড়ত না। সিরিজ হিসেবেই মুক্তি পেত সেই কাজ। আসলে এক-একটি যুগের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। সেই সীমাবদ্ধতার নিরিখেই ব্যক্তি মানুষের হিসেব-বেহিসেবের পরিমাপ। জীবনের ব্যাপারে ঋত্বিক ঘটককে কেউই হিসেবি বলার দুঃসাহস করেন কি? অথচ সেই লোক, পরিচালনার সময় ছবি বিশ্বাসের টেক বাতিল করছেন বারবার। বলছেন, "হচ্ছে না ছবিদা, উকিল হয়ে যাচ্ছে, ব্যারিস্টার নয়।" হতভম্ব ছবি বিশ্বাস তাঁকেই অভিনয় করে দেখাতে বললে, তৎক্ষণাৎ ব্যারিস্টারের অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছেন ঋত্বিক। সেই ছবি 'কত অজানারে', মুক্তি পায়নি কোনও দিন। বিস্মিত ছবি বিশ্বাস নাকি তাই দেখে বলেছিলেন, "এ ঢ্যাঙাও (আরেক ঢ্যাঙা সত্যজিৎ) অনেকদূর যাবে।" কালের দোর আটকে বসে থাকা সমালোচক একে কী বলবেন? হিসেব? না বেহিসেব? উত্তর এক মহাকাল ছাড়া বোধ করি কেউই জানে না।

More Articles