খনি অঞ্চলের ছেলের গল্প হয়ে উঠল ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস, দশ বছরে 'গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর'

‘ভদ্রলোক’-দের বিষনজর ছাড়িয়ে সাধারণের কাছে কাল্ট হয়ে গিয়েছে এই ছবির বেশ কিছু ডায়লগ। আজও চাবি খোঁজার মিম, জিফ, স্টিকার ব্যবহৃত হয়। মনোজ বাজপেয়ীর সর্দার খান এখনও জেগে থাকেন মানুষের মনে।

গোলি নেহি মারেগা সালেকো, কেহকে লেঙ্গে উসকি

ওয়াসিপুরের প্রাচীন প্রবাদ।

ঝাড়খণ্ড এমন এক জায়গা, যার ভূ-রাজনৈতিক বীক্ষণ আর চার-পাঁচটা রাজ্যর থেকে একেবারেই আলাদা। বয়স কম, তাই সে-রাজ্য একটু বেশিই চঞ্চল। তার ওপর প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, খনির রাজনীতি, জঙ্গলের রাজনীতি, আদিবাসী রাজনীতি, দলিত রাজনীতি জড়িয়ে গিয়েছে ঝাড়খণ্ডের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। এককালীন ব্যক্তিগত মালিকানার জমি নিয়ে রক্ত কম ঝরেনি। পরে সরকার খনির মালিকানা নিয়েছে, তখন দেখা গিয়েছে, খনির মালিকরা ওইসব অঞ্চলের সরকারে বসে খনি-সহ গোটা অঞ্চল ‘আইনসম্মত’ভাবে শাসন করছেন। কাজেই খনি ধানবাদ হোক বা রানিগঞ্জে, অধিগ্রহণের বিষয়টা ছিল মূলত অঞ্চল-শাসকদের বেআইনি ক্ষমতাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ামাত্র। কিন্তু এই বিষয়ে সিনেমা করার কথা বলিউডের তাবড় তাবড় পরিচালকরাও ভাবেননি। ভেবেছিল ধানবাদেরই এক অখ্যাত যুবক, সিনেমার সঙ্গে যার তখনও সেই অর্থে তেমন পরিচয় নেই।

জিশান কাদরি তখন মুম্বইয়ের একটি মেসে থাকেন। প্রায় সারারাত আড্ডা চলে। সিনেমা সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতেন না তখনও জিশান। তাঁদের এলাকায় সেই অর্থে সিনেমা হল দু'-একটি, নাটক বা থিয়েটারের মঞ্চ একেবারেই নেই। মুম্বইয়ে এসেছেন কাজ খুঁজতে। সঙ্গে সুযোগ পেলে সিনেমাতেও কাজ করার ইচ্ছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সিনেমার জ্ঞান। একসময় ‘সিটি অফ গড’ দেখে তাঁর মনে হয়, এর থেকে বেশি হিংসাত্মক ঘটনা, দলীয় মারপিট ইত্যাদি তাঁর দেশের বাড়িতেই তো হয়! জবরদস্ত গল্প রয়েছে। সেই গল্প নিয়ে সিনেমা করা যায় না? এমনিতেই আড্ডাবাজ লোক। মনে মনে ছকে ফেললেন পুরো গল্প।

আরও পড়ুন: যে কারণে ‘ভুলভুলাইয়া’ ইতিহাস, সেই কারণেই চূড়ান্ত ব্যর্থ তার সিক্যুয়েল

সিনেমা তখন দেখছেন, কিন্তু পরিচালকদের নাম জানেন না। বন্ধুদের কাছে শুনে প্রথমে গেলেন হনসল মেহতার কাছে। হনসল মেহতার খুবই পছন্দ হয় স্ক্রিপ্ট। তিনি সিনেমাটি করতে রাজি হন। কিন্তু সেবার প্রোডিউসার পাওয়া যায় না। কাজেই হনসল ফিরিয়ে দেন স্ক্রিপ্ট। এরপরে জিশানের এক বন্ধু, তিনি অনুরাগের কথা বলেন। 'অনুরাগ কাশ্যপ? সে আবার কে?' "আরে, ওই যে, যে 'ব্ল‍্যাক ফ্রাইডে' বানিয়েছিল!” 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-র কথায় অনুরাগকে চিনতে পারেন জিশান। কিন্তু তখনও তাঁকে দেখতে কেমন, জানতেন না। প্রায় দিনই তাঁর অফিসে যান। গিয়ে বসে থাকতে হয়, কেউ পাত্তা দেয় না। অনুরাগ সেসময় কিছুদিন অফিসে আসছিলেন না। পৃথ্বী থিয়েটারে শোয়ের কাজে ব্যস্ত। চতুর্থবারেও দেখা না হওয়ায় অনুরাগের অফিসের এক স্টাফের সঙ্গে রাগারাগি করে চলে আসছেন, এমন সময় দরজার ওপরে সেই শোয়ের পোস্টার দেখতে পেন জিশান। ব্যস, পৌঁছলেন পৃথ্বী থিয়েটারে। গুগলে তার আগে ছবিটবি দেখেছেন অনুরাগের। কিন্তু সামনাসামনি তাও চিনতে পারছিলেন না। সন্দেহজনকভাবে একটি লোক তাঁর দিকে চেয়ে আছে দেখে অনুরাগ একদিন এগিয়ে যান জিশানের দিকে, নিজেই।

Gangs of Wasseypur

শেষ অবধি তাঁদের দেখা হয়, এবং গল্প শুনে অনুরাগ পুরো গল্পটা লিখতে বলেন জিশানকে। স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু হয়। পড়ে অত্যন্ত পছন্দ হয় অনুরাগের। এবং সিনেমা করতে রাজি হন অনুরাগ।

কিন্তু সিনেমা করতে রাজি হলেই তো হবে না, মূল বাধা প্রোডিউসার পাওয়া। এই মাপের মহাকাব্যিক ছবি করতে মিনিমাম আশি থেকে একশো কোটির বাজেট প্রয়োজন। কিন্তু অনুরাগ সেই মাপের প্রোডিউসার পেলেন না। মেরে-কেটে আঠেরো কোটি বাজেট। এদিকে ফাইনাল গল্প দাঁড়াল প্রায় চল্লিশ পাতার কাছাকাছি। তা দেখে অনুরাগ বুঝলেন একটা সিনেমায় পুরোটা কভার করা সম্ভব নয়। কাজেই দুটো পার্টে কাজ করতে হবে। দু'টি ছবি মাত্র আঠারো কোটিতে করা মুখের কথা না।

কিন্তু অনুরাগ সবেতেই সিদ্ধহস্ত। ওয়াসিপুর গিয়ে বহুবার হালচাল দেখেও এসেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, অ্যাসিস্ট‍্যান্ট ডিরেক্টররা। তাঁরা জানালেন, চরিত্রগুলি একেবারেই সমসাময়িক। ফলে ওয়াসিপুরে কোনওমতেই শুট করা যাবে না। এদিকে কয়লাখনিকে ভিত্তি করে মাফিয়ারাজের গল্প। তাহলে উপায়? নিজের দেশের বাড়িকে মাথায় রেখেই ছক সাজালেন অনুরাগ। এক বছর আগে থেকেই সংগীত পরিচালনার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। 'এক বগল মে চাঁদ হোগি' থেকে 'হান্টার'— একের পর এক গান। লেখায় বরুণ গ্রোভার, পীযূষ মিশ্ররা, সুরে স্নেহা খানওয়ালকার।

Gangs of Wasseypur shooting

শুটিংয়ে অনুরাগ কাশ্যপ ও মনোজ বাজপেয়ী

বেনারসে কিছু শুটিং হলো। নিজের চেনাজানা জায়গা হওয়ায় অনেক কম বাজেটে কাজ করতে সুবিধা হল। শুটিং হল বিহার এবং চুনরেও। এরই মধ্যে ২০১০ নাগাদ বেনারসে একটি ব্রিজের ওপর জিপ চালিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন অনুরাগের প্রিয় পাত্র এবং সহকারী পরিচালক সোহেল শাহ। গোটা দল কিছুদিনের জন্য থমকে গিয়েছিল এই ঘটনায়।

Gangs of Wasseypur shooting

শুটিংয়ে অনুরাগ কাশ্যপ ও জিশান কাদরি

কিন্তু সময় প্রবহমান। শুটিং এগোয়। সর্দার খান, ফয়জল, নগমা, রামাধীর, ডেফিনিট, পারপেন্ডিকুলার– অনবদ্য চরিত্রায়ণ এবং গল্পের বুনট সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য, যাবতীয় নায়কোচিত চরিত্ররাই সে অর্থে লুম্পেন, আর খলনায়ক বা ভিলেন রামাধীর সিং সবথেকে বেশি পালিশ করা। যেখানে বেশিরভাগ মাফিয়া বলিউড ভক্ত, সেখানে রামাধীর বলিউডকে অপছন্দ করেন। 'যবতক হিন্দুস্তানমে সিনেমা হ্যায়...' সেই বিখ্যাত সংলাপে ধরা পড়ল সেই মনোভাব।

এরকম নানা রাজনৈতিক উপাদানে ভরপুর সিনেমাটি। ঝাড়খণ্ডের জাতপাতের রাজনীতি কীভাবে মুসলমানদের কৌম দ্বন্দ্বের মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছে–তা স্পষ্ট তুলে ধরেন অনুরাগ। রামাধীর ক্ষমতায় থেকে শোষক, সেই আইনি ক্ষমতার বিপ্রতীপেও ফের মাথা চাড়া দেয় বেআইনি ক্ষমতা। সেখানে আইনি সমঝোতাও থাকে, আইনি নিকেশও থাকে। অনুপাতের ফারাক। ফয়জল রাজপুত্রর মর্যাদা পেয়েও এই সিনেমার সবথেকে ট্র্যাজিক চরিত্র। কারণ, এই লড়াইয়ের সবটাই বাধ্য হয়ে লড়তে হয় তাকে। কিছুতেই বেরনোর উপায় থাকে না।

এই ছবির সবটাই তুমুল আঞ্চলিক, গানের সুর, কথা, গলা, ছবির রাজনীতি, হিংসা– সবটাই। একই সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের দায়িত্ব, রক্তের সম্পর্কের ট্যাবু, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ– ইত্যাদি ‘ভারতীয়’ উপাদানের ঘেরাটোপ, যা ছবিতে নিয়তি হয়ে উঠেছে, তাই দিয়ে মানুষের অন্ধকার দিকটির স্বাভাবিক প্রকাশ পৃথিবীজুড়ে এর রিসেপশন তৈরি করেছে। অস্বীকারের উপায় নেই, এর আগে অনুরাগের কোনও সিনেমাই এত রোজগার করেনি। ওয়াসিপুরের এক অখ্যাত, অভিনয় সম্পর্কে অজ্ঞ, সিনেমা বিষয়ে না-জানা ছেলে জিশান কাদরিই কি কখনও ভেবেছিলেন, তিনি 'ডেফিনিট' হয়ে উঠবেন নিজের কাহিনিতে?

অথচ মানুষ গ্রহণ করেছে। দর্শক উদযাপন করেছে ছবিটি। ‘ভদ্রলোক’-দের বিষনজর ছাড়িয়ে সাধারণের কাছে কাল্ট হয়ে গিয়েছে এই ছবির বেশ কিছু ডায়লগ। আজও চাবি খোঁজার মিম, জিফ, স্টিকার ব্যবহৃত হয়। মনোজ বাজপেয়ীর সর্দার খান এখনও জেগে থাকেন মানুষের মনে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেব প্রতিজ্ঞা করে যে শুধু নিজের আখের গুছোয়। জেগে থাকে নওয়াজের ফয়জল খান, জিশানের ডেফিনিট, রিচা-র নগমা বা আদিত্য-র পারপেন্ডিকুলার। আর বাস্তব ডিসটোপিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় জিশানের অভিজ্ঞতা, অনুরাগের বিশ্লেষণ সৃষ্টি করে ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর মতো কাল্ট ছবি, যা বলিউড নামক প্রহসনকে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করে যেতে থাকে ভিলেনের জবানিতে।

 

 

More Articles