জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে, তাপস পালের উত্থান-পতন দুইই জেটগতিতে

Tapas Paul: 'পুরুষালি' হিরোইজমের ছক নয়, হিন্দি সিনেমার প্রবল দাপটের বিপরীতে এক নতুন ছকের জন্ম দিয়েছিলেন তাপস।

১৯৮০ নাগাদ 'টিনের তলোয়ার' সিনেমার পরিকল্পনা থমকে গেল তরুণ মজুমদারের। তার কারণ মহানায়কের আকস্মিক মৃত্যু। সইটই সমস্ত হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে উত্তম যে চলে যাবেন, সেটা কেউ ধারণা করতে পারেননি। কিন্তু ছবির কাজ তো থেমে থাকে না। ইন্ডাস্ট্রির মানুষদের জীবন থমকে‌ যায় না। সবই নিজের আবহে আবর্তিত হয়। শুরু হলো 'দাদার কীর্তি'-র পরিকল্পনা। নতুন মুখ খুঁজছেন গোবেচারা নায়কের জন্য। ঠিক সেই সময়েই খোকার খোঁজ পাওয়া গেল। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার নাটকে গানটান করেছে। অভিনয়ে আসার পরিকল্পনা কোনও দিনই ছিল না। কলেজ শেষ করার পর মনে হলো, এদিকেও একবার চেষ্টা করে দেখি। কেউ চেনাজানা নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখের কাজ পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। ভাগ্যচক্রে সেই সময়েই 'দাদার কীর্তি'-র অডিশন চলছিল। তরুণ মজুমদার, সন্ধ্যা রায়— দু'জন মিলে অডিশন নিতেন তখন। সেই অডিশনেই বাজিমাত। 'দাদার কীর্তি'-র নায়ক চরিত্র পেয়ে গেল খোকা। চন্দননগর থেকে ছেলেটা যাতায়াত করে! সন্ধ্যা রায় বললেন, "আমার বাড়িতেই থেকে যা।" সেই শুরু। তারপর থেকে পরিচালকের পারিবারিক বন্ধু। সমস্যা, বিপদ-আপদ সমস্ত কিছুতে হাজির সে। 'দাদার কীর্তি'-র কেদারের চরিত্রে সেই খোকা ওরফে তাপস পাল বিপুল পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন কেরিয়ারের শুরুতেই।

মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম, যাবতীয় সংশয় এবং পল্লিগ্রামের যৌবনকে যে চোখে তারা দেখতে ভালবাসে, সেই বোকা বোকা অতি সরল একটি ভাবমূর্তি নিয়ে এসেছিলেন তাপস। 'ভালবাসা ভালবাসা', 'সাহেব', 'অনুরাগের ছোঁয়া' থেকে 'গুরুদক্ষিণা'- মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির কাল্ট ছবি হয়ে গিয়েছিল। 'পুরুষালি' হিরোইজমের ছক নয়, হিন্দি সিনেমার প্রবল দাপটের বিপরীতে এক নতুন ছকের জন্ম দিয়েছিলেন তাপস। এক আকাঙ্ক্ষিত সারল্য, ভালোমানুষির টনিক। উত্তম শেষের দিকে যে ধরনের চরিত্র করতে শুরু করেছিলেন, সেই ধারাটা ফের আটকে দিয়ে কুল ছাপিয়ে উঠল এই সারল্যের ফরমুলা। তরুণ মজুমদার বলছেন, "তাপসের চোখ প্রেমের গেরিলা কায়দা জানে।" কথাটা সর্বাংশে সত্যি না। বরং এমন সারল্যমাখা হয়েও মেয়েদের মন জয় করা যায়, এইটেই যেন ছিল মূল প্রতিপাদ্য। লাভের লাভ যা হয়েছিল, পল্লিগ্রামও নিজেকে নাগরিক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। 'চরিত্র', 'পবিত্রতা', 'নিষ্পাপ' ইত্যদি নানা শব্দ ফের একবার জাতীয়তাবাদের সময় ছাড়িয়ে উড়ছিল হাওয়ায়। ভবঘুরে চরিত্রর উদযাপন একরকম থমকে গিয়েছিল। বরং বেশ আঁটোসাঁটো মাখামাখা প্রেমের মধ্যে আদর্শবান নায়ক উদযাপনে ব্যস্ত ছিল বাংলা।

১৯৫৮-র ১৯ সেপ্টেম্বর চন্দননগর ধাড়াপাড়ায় জন্ম। বাবা চন্দননগর হাসপাতালের নামকরা ডাক্তার। কানাইলাল বিদ্যামন্দির থেকে পাশ করে চুঁচুঁড়া মহসিন কলেজ। মোগলাই-প্রেমী এই রোগাপাতলা ছেলেটি রাতারাতি তারকা হয়ে উঠবেন, কেউই ভাবতে পারেননি। মহুয়া তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। যুবকদের বুক তোলপাড় করে ফিরছেন পর্দায়। প্রায় বছরআটেকের সিনিয়র এই লাইনে। তার বিপরীতে কে? না কোথাকার কী তাপস পাল! "ও ছবি চলবে না, অমন বোকা বোকা চাহনির ছেলে দিয়ে মহুয়াকে ট্যাকল করা যায় না!" আটের দশকের এক পরিচালক মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, তরুণ মজুমদার মধ্যবিত্তর মন তাঁর থেকে যথেষ্ট ভালো পড়তে পারেন। সেই ভাবমূর্তিই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল তাপসের। তখন বয়স মাত্র বাইশ। এক নতুন ছকের নায়ককে পেয়ে গিয়েছিল দর্শক। একের পর এক ছবিতে সেই জনপ্রিয়তা বাড়ছিলই ক্রমাগত। কয়েক বছরের মাথায় সেই জনপ্রিয়তার হাওয়ায় মুম্বইয়ের দিকে উড়ে গেলেন তারকা। হীরেন নাগের ছবি 'অবোধ' (১৯৮৪)। বিপরীতে মাধুরী দীক্ষিতের ডেবিউ। কিন্তু সেই সিনেমা একেবারেই চলল না। তরুণ মজুমদার বোঝালেন, বাংলা ছবি নিয়েই লেগে থাকতে হবে। মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করে যেতে হবে। আর কখনও মুম্বইয়ের দিকে হাত বাড়াননি তারকা। ঠিক তার পরের বছরই 'ভালবাসা ভালবাসা'। বিপরীতে দেবশ্রী। সেই হাবাগোবা মধ্যবিত্ত প্রেম। আবার তুমুল হিট। 'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে' নাকি তখন মধ্যবিত্ত প্রেমের থিম সং হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন: অভিনয়ে বাজিমাত করল চিল, উৎপল দত্ত বললেন, ‘অবিশ্বাস্য’

মহুয়া, দেবশ্রী, ইন্দ্রাণী, শতাব্দী, রচনা— বহু জুটিতেই সফল হয়েছেন তাপস। কিন্তু ক্রমে সেই মধ্যবিত্ত দর্শকের পরিধি ভাঙছিল। হিন্দি সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত বৃহত্তর দর্শকের সামনে নায়িকাদের গুণ্ডাদের হাত থেকে উদ্ধার করা হিরোর জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। একটা খোপ ছেড়ে আরেকটা খোপে সরে আসছিলেন অভিনেতা। কাজেই জনৈক সমালোচক যখন মন্তব্য করেন, "শুধু তাঁর প্রেমের প্রকাশে, ভাবনার বিলাসে… রইল সাহেব, কেদার আর লেখাপড়ায় ভাল উড়নচণ্ডী অরূপের বিষণ্ণ প্রেম"— মনে রাখতে হবে এই হা-হুতাশ কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকেরই। বৃহত্তর বাঙালি দর্শক তখনও হল ভরে তাপসের মারপিট দেখেছে। রাতের পর রাত যাত্রা দেখেছে। তারপর টিভির যুগ। রবি ঘোষের সঙ্গে ধারাবাহিক। কিন্তু তাপস পালের জীবনের সেরা কাজ হিসেবে যদি ভাবতে হয়, 'উত্তরা' এবং 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান'-কেই গণ্য করতে হবে। ছক এবং খ্যাতি বিয়োগ না দিলে অভিনয়ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ অসম্ভব।

ঠিক এই সময়েই রাজনীতির জগতে আসা। সিনেমা থেকে রাজনীতির জগতে আসাটা বহুদিনের ব্যাপার। চলতি রাজনীতির জগতে বড় পুঁজি নাম এবং খ্যাতি—দু'টিই যেহেতু অভিনেতাদের প্রচুর। কেউ সফল হন, কেউ হন না। শুরু থেকেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তাপস। ২০০১-এ মমতারই নির্দেশে দাঁড়ালেন আলিপুর থেকে। সিপিএম-এর প্রবল দাপটের মধ্যেও জিতে গেলেন। তৃণমূলের মহাজোট সেবার যাচ্ছেতাইভাবে হারল। কিন্তু তাপস পাল তৃণমূলের অন‍্যতম খুঁটি হয়ে রইলেন। এরপর ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪— রাজনীতিতেও জয় অক্ষুণ্ণ ছিল তাঁর।

কিন্তু এতখানি খ্যাতি সামলানো মুখের কথা নয়। দলের ভেতরেও সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল ক্রমশ। তাঁকে নিয়ে নানা কথাবার্তা। নিজের ক্ষোভও চেপে রাখছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল অশান্তি। ক্রমে মদে ডুবে যাচ্ছিলেন অভিনেতা। বিবাদ হচ্ছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। ২০১৪-তে কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল, টিকিট পাবেন না। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল টিকিট দিলেন নেত্রী। কৃষ্ণনগরের টিকিটে সেবার ফের জয়। কিন্তু ২০১৬-তে দেখা গেল সিনেম‍্যাটিক মুহূর্ত। নির্বাচনী প্রচারের একটি ভিডিও এল সামনে। প্রচারে গিয়ে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বিরোধীদের "ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে" দেওয়ার কথা বললেন অভিনেতা। বললেন, "আমি চন্দননগরের মাল"! তাঁর সম্পর্কে যে খ্যাতির বলয় তৈরি হয়েছিল, তাতে চিড় ধরল। নায়ক একধাক্কায় মার্কামারা ভিলেনে পরিণত হলেন।

মধ্যবিত্ত দীর্ঘদিন কেদারের সঙ্গেই গুলিয়ে এসেছে তাঁকে। তাদের চিন্তাভাবনায় আঘাত লাগল। এমন পিতৃতান্ত্রিক কথা, গোটা মহল্লাকে রেপ থ্রেট দেওয়ার ব্যাপারটা খুব আলগোছে বলে ফেলা ভুল নয়। বরং মানুষ চিনতেই সাহায্য করে। সমালোচনার পর সমালোচনা। আইনি শাস্তি হলো না কোনও। কিন্তু ট্রোলড হলেন প্রচণ্ড। অভ্যেস নেই, ক্রমে ঝাঁজ মরে এল। কীভাবে সামাল দেবেন, বুঝতে পারছিলেন না। ক্ষমা চেয়েও লাভ হলো না। ক্ষমতাবানের মুখ থেকে গণধর্ষণের হুমকি বেরোয় অহরহই। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও এখানে বেশ সুবিধা পেল।

সেই বছরই ৩০ ডিসেম্বর চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে সিবিআই গ্রেফতার করল অভিনেতাকে। মধ্যবিত্ত নস্টালজিক বাঙালি অচ্ছুত করে দিল ব্যক্তি তাপস পালকে। বৃহত্তর দর্শক ততদিনে নতুন নায়ক পেয়ে গিয়েছে। মধ্যবিত্তর সাধের কেদার সিনেমার চরিত্র হয়েই বেঁচে রইল। রক্তমাংসের মানুষটার সঙ্গে আর সম্পর্ক রইল না কারও। তুমুল খ্যাতির শীর্ষে থেকে নানা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকলে মানুষ প্রতারিতও বোধ করে। খ্যাতি দিয়ে তাদের চোখ ঢাকা হয়েছে— এই সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে!

ভুবনেশ্বর জেলে বন্দি থাকলেন। ২০১৯-এ আর টিকিট দিল না দল। ভাবমূর্তি ভেঙে গিয়েছে। খ্যাতি ভেঙে গিয়েছে। পুঁজি শেষ। বন্ধুবান্ধবহীন তাপস ক্রমে আরও নিঃসঙ্গ হলেন। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরেও মনের ক্ষত সারল না। শরীর ভেঙে পড়ল। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, একষট্টি বছর বয়সেই চলে গেলেন। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক নায়ক। এও বাংলা সিনেমার নায়কদের এক ছক। অথবা এভাবেই মনে রাখতে ভালবাসে হয়তো মানুষ। একেবারে খ্যাতির শীর্ষ থেকে নিজের ভুলে, নিজের দোষে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে পতন। অভিঘাত বড্ড বেশি। শেষের দিকে‌ মানুষজন তাঁকে দেখে করুণাই করত, বলত জীবনটাকে যাত্রাপালা ভেবে নিয়েছিল। তাই তাপস পালের এই দশা। এও স্মৃতির ছকে দাগিয়ে দেওয়ার ধরণ বইকি! দোষীকে করুণা করে নিজের ঘায়েও খানিক মলম পড়ে। বাকি বিপুল অভিনয় জীবন। তাতে মধ্যবিত্ত থেকে বৃহত্তর বাঙালি দর্শক, শিক্ষিত সমালোচক- উপাদান রইল প্রায় সবার জন্যই। এটুকুই তাপস পালের থেকে গেল। এর কতটুকু টিকবে, তার হিসেব করবে মহাকাল।

তথ্য ঋণ
আনন্দবাজার পত্রিকা

More Articles