রান্নার তেলেই বিষ মিশছে প্রতিদিন, নিজের অজান্তেই ডেকে আনছেন মৃত্যু
কী বিপদ ডেকে আনছে পোড়া তেল?
ছাঁকা তেলে রান্নার পর খানিক তেল বেঁচে গেলে পরের দিন অনেকেই আবার সেই তেল দিয়ে রান্না করে ফেলেন। কিংবা ধরুন রাস্তার পাশের কোনও চপের দোকান থেকে চপ কিনলেন। কড়াইয়ের যে তেলে চপ ভাজা হলো, তা শেষ কবে বদলানো হয়েছে, দোকানদার নিজেও মনে করতে পারবে না। শুধু রাস্তার ধারের দোকান কেন, বড় বড় কত রেস্তোরাঁই ছাঁকা তেল দিয়ে অন্য রান্না সেরে ফেলেন। কিন্তু এই পোড়া তেলে রান্না করা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? এই প্রশ্নের উত্তর মনে মনে বহুকাল ধরেই আমরা জানি। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট কার্যত সেই কথাতেই সিলমোহর দিল।
ছাঁকা তেল কী?
ছাঁকা তেল বা ইউজড কুকিং অয়েল (ইউসিও) হলো কোনও খাবার তেলে ভাজার পর যে পরিমাণ তেল কড়াইয়ে পড়ে থাকে। চিকিৎসাশাস্ত্র এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা উভয় ক্ষেত্রেই দাবি করা হয়, ছাঁকা তেলের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ক্যানসার, হৃদরোগ বা শরীরের কোনও অঙ্গ নষ্ট হওয়ার মতো রোগ বাসা বাঁধে মানবদেহে। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, ফুড সেফটি রেগুলেশন থাকা সত্ত্বেও ভারতের বাজারে উৎপন্ন ছাঁকা তেলের ৬০ শতাংশই পুনরায় রান্নার কাজে লাগানো হয়।
নতুন গবেষণা রিপোর্ট কী বলছে?
ভারতের শীর্ষস্থানীয় সংস্থা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তরফে দেশের বাজারে ব্যবহৃত রান্নার তেলের পুনরায় ব্যবহার ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব মূল্যায়নের জন্য একটি গবেষণা চালানো হয়। এক্ষেত্রে কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি এবং চেন্নাইয়ের মোট ৫০৫টি দোকান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে ফলাফল শুনে মাথায় হাত ওঠার জোগাড়। চলতি মাসের ২৩ তারিখে ওই গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত হারে ছাঁকা তেল ব্যবহার করে রান্না করা হয়। বিশেষত দিল্লি, কলকাতা, মুম্বইয়ের ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা গেছে যে, তাঁরা ছাঁকা তেলের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বড় রেস্তোরাঁর এই প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে গবেষণার জন্য যে চার শহর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তার মধ্যে চেন্নাইয়ের ছবি একবারেই আলাদা। ওই রাজ্যের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁই ফুড সেফটি রেগুলেশন সর্বসম্মতভাবে মাথায় রেখে একাধিক পদক্ষেপও করেছে। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় শাসন বিভাগ এবং প্রাইভেট সংস্থাগুলির মধ্যে সহযোগিতা এবং উৎপাদিত বর্জ্যর সঞ্চয় এবং নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তোলা।
আরও পড়ুন: ইলিশের নামে আসলে কি বিষ খাচ্ছেন? কীভাবে বুঝবেন…
নেস্টের এশিয়া পেসিফিক অঞ্চলের প্রধান স্টিভেন বার্থেলোমিউজের মতে, "এই গবেষণা রিপোর্ট থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, বাজারে ব্যবহৃত রান্নার তেল নিয়ন্ত্রণ করার পথে আজও বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকার, সুশীল সমাজ এবং প্রাইভেট সংস্থাগুলির উচিত একজোট হয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। নেস্ট সবসময়েই তৈরি ভারতের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। এক্ষেত্রে ছাঁকা তেলের ব্যবহার কমিয়ে ভারত জনস্বাস্থ্যের ওপর বিপদ হ্রাস করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গেও লড়াই করতে পারবে।আমাদের সংস্থা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই ছাঁকা তেলকে কম দূষণকারী পুনর্নবীকরণযোগ্য ডিজেল এবং বিমানের জ্বালানি তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে।"
ছাঁকা তেলে স্বাস্থ্যহানি
রান্না করা তেল বা ছাঁকা তেল পুনরায় গরম করলে তাতে পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন এবং অ্যালডিহাইডের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ বেড়ে যায়, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এই ধরনের তেল ব্যবহার করে রান্না করলে অ্যাসিডিটি, বুক জ্বালা ও পেটে ব্যথার মতো সমস্যা দেখা যায়। এছাড়া শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়তে থাকে; ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কতবার তেল পুনর্ব্যবহার নিরাপদ?
স্বাস্থ্যরক্ষার পাশাপাশি জিনিসের অপচয় এবং খরচ কমানোও জরুরি। তাই ডুবো তেলে কোনও জিনিস ভাজার পর কড়াইয়ে পরে থাকা তেল ব্যবহার না করাই ভালো। তবে তেলের রং, গন্ধ, ধরন এবং কতক্ষণ ধরে রান্না করা হয়েছে, এসবের ওপর ভিত্তি করে পুনরায় সেই তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে কথাগুলি খেয়াল রাখা প্রয়োজন,
• রান্নার পর অবশিষ্ট তেল সম্পূর্ণ ঠান্ডা করে এয়ারটাইট পাত্রে ভরে রেখে দিন। তবে ঠান্ডা করা তেল পাত্রে ঢেলে রাখার আগে তা ছেঁকে নিতে হবে, এর ফলে তেল ভালো থাকবে।
• ছাঁকা তেলে ব্যবহারের আগে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে নিন। তেলের রং গাঢ় হয়ে গেলে, স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ঘন হয়ে এলে এবং আঠালো হয়ে গেলে তখনই ফেলে দিন সেই তেল।
• যদি তেল গরম করাকালীন স্বাভাবিকের তুলনায় আগেই ধোঁয়াটে হয়ে যায়, তবে ফেলে দিতে হবে সেই তেল। এই তেলে বিষাক্ত রাসায়নিক জমতে থাকে, যা শরীরের নানা রোগ সৃষ্টি করে।