বাঘের মৃতদেহকে মানুষের স্যালুট, ভালবাসার ফুল, এক অন্য মানবিকতার গল্প
আগস্ট মাসের ২৩ তারিখ রাজার জন্মদিন পালনের পরিকল্পনা ছিল বন দফতরের। কিন্তু তার আগেই মারা গেল রাজা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে 'কলারওয়ালি'-র কথা। এই বছরই জানুয়ারি মাসে মারা গিয়েছিল 'কলারওয়ালি'।
২০২২-এর জুলাই মাসে এশিয়ার বয়স্কতম বাঘটিকে হারালাম আমরা। দক্ষিণ খয়েরবাড়ি ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রের সবথেকে বয়স্ক বাঘটি মারা গিয়েছিল বয়সজনিত কারণেই। সেই বাঘের মৃত্যুকে ঘিরে শোকের ছায়া নেমেছিল জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বনকর্মীদের মধ্যে। বাঘের প্রতি মানুষের এই স্নেহ-মমত্ব সত্যিই বিরল। গত ১১ জুলাই মৃত্যু হয় তার।
আদিমকাল থেকেই বাঘে-মানুষে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষত, সুন্দরবনের মতো অঞ্চলে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয় মানুষকে। এতে কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না। খাদ্য-খাদক শৃঙ্খলে বাঘ মানুষের ওপরে অবস্থান করে। অর্থাৎ, তারা অ্যাপেক্স প্রিডেটর। খাদ্য সংগ্রহের জন্য বাঘ শিকার সাধারণত করে না কোনও প্রাণী। অপরদিকে মানুষ বাঘের সম্ভাব্য খাদ্যতালিকার অংশ। প্রকৃতির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আবার দ্বন্দ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাঘে-মানুষে সহাবস্থানও রয়েছে। পরে অবশ্য প্রযুক্তির সাহায্যে কোনও কারণ ছাড়াই বাঘ মারায় একচেটিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। তবে আপামর নয়, এই খেলায় একসময় অংশ নিতেন মূলত উচ্চবিত্তরা। সাধারণ মানুষ জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নিয়েই লড়াই করে বেঁচেছে। জনসংখ্যা বাড়ায়, সভ্যতার দোহাই দিয়ে জঙ্গলের পর জঙ্গল সাফ হয়েছে। নির্বিচারে প্রাণীহত্যায় বাঘেরাও সংখ্যায় কমে গিয়েছে। বিশেষত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ। চোরাশিকারি থেকে সরকারি কর্মচারী, সকলের মিলিত চক্রে সেও প্রায় অমিল। সুখের বিষয়, পরিবেশ চর্চার পথে কিছু অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। তাতে খানিকটা আশ্রয় পায় বন্য জন্তুরা। তবে বাঘের সঙ্গে মানুষের এমন আবেগের সম্পর্কের নজির খুব কম।
যে বাঘটি মারা গিয়েছে, তার নাম রাজা। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে প্রচণ্ড আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। কুমিরের সঙ্গে এলাকা দখলের লড়াইয়েই আহত হয় সে। এগারো বছর বয়সি রাজাকে যখন খয়েরবাড়ি রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে আসা হয়, তখন তার সারা গায়ে দশটিরও বেশি ক্ষত। পশু চিকিৎসক প্রলয় মন্ডল, বন্যপ্রাণরক্ষী পার্থসারথি সিনহা-সহ রেসকিউ সেন্টারের কর্মীদের নিরলস চেষ্টায় সে-যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় বাঘটি। তবে পিছনের বাঁ পা-টি খোয়ায় রাজা। ফলে তাকে জঙ্গলের স্বাভাবিক জীবনে আর ছেড়ে দেওয়া যায়নি। খয়েরবাড়িতেই থেকে যায় সে। ধীরে ধীরে রেসকিউ সেন্টারে সকলেরই প্রিয় হয়ে ওঠে রাজা। আরও দীর্ঘ পনেরো বছর বেঁচে ছিল সে। মারা যাওয়ার সময় তার বয়স হয়েছিল ২৫ বছর ১০ মাস। গোটা বিশ্বে কোনও পালিত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এতদিন বাঁচেনি। বয়সজনিত কারণেই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছিল সে। অবশেষে মাল্টি-অর্গ্যান ফেলিওর হয়ে ১১ জুলাই ভোর তিনটেয় নিজের কুঠুরিতেই মারা যায় সে।
আরও পড়ুন: চৌরঙ্গিতে শোনা যেত গর্জন! কলকাতাতেও মানুষ কাঁপত বাঘের ভয়ে
এরপরে যা হয়েছে, তা অভাবনীয়। রাজাকে শেষ বিদায় জানাতে জেলা সদর থেকে জাতীয় উদ্যানে ছুটে গিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক সুরেন্দ্রকুমার মিনা। ফুল দিয়ে সমারোহ করে চোখের জলে শেষ বিদায় জানানো হয় রাজাকে। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বহু বনকর্মীরই চোখে সেদিন জল। গার্ল্যান্ডিং-এর পর রাজার দেহ সৎকার করেন তাঁরা। ১৪০ কেজি ওজনের শরীর পুড়তে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। জাতীয় উদ্যানের ডিএফও দীপক এম বলেন, "গানস্যালুট দেওয়া যায়নি। কিন্তু আমরা স্যালুট দিয়েছি রাজাকে। রাজার স্মৃতিতে দক্ষিণ খয়েরবাড়িতে স্মৃতিসৌধ তৈরি করব আমরা। রাজা ছাড়া দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রেসকিউ সেন্টার ভাবাই যায় না। আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছি।"
আগস্ট মাসের ২৩ তারিখ রাজার জন্মদিন পালনের পরিকল্পনা ছিল বন দফতরের। কিন্তু তার আগেই মারা গেল রাজা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে 'কলারওয়ালি'-র কথা। এই বছরই জানুয়ারি মাসে মারা গিয়েছিল 'কলারওয়ালি'। মূলত বার্ধক্যজনিত কারণেই। মারা যাওয়ার সময় তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর।
জীবদ্দশায় ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮— এই দশ বছরের মধ্যে ২৯টি শাবকের জন্ম দিয়েছিল সে। সেই কারণেই 'সুপার মম' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাকে। 'টি১৫' নামেও পরিচিত ছিল কলারওয়ালি। বনবিদদের একটি দল এক সপ্তাহ ধরেই নজর রাখছিল তার স্বাস্থ্যের ওপর। ১৪ জানুয়ারি পেঞ্চ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রের পর্যটকরা তাকে শেষবারের মতো দেখতে পায়। বাঘিনীটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল, তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছিল স্থানীয় মানুষদের মধ্যে। কেউ মালা দিয়ে, কেউ হাত জোড় করে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানও একটি ট্যুইটে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। "মধ্যপ্রদেশের গর্ব এবং ২৯টি শাবকের মা কলারওয়ালিকে শ্রদ্ধা জানাই। মধ্যপ্রদেশকে বাঘ রাজ্যের মর্যাদা অর্জনে সে প্রভূত সাহায্য করেছিল। পেঞ্চ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রে সর্বদাই তার শাবকদের গর্জন মুখরিত হবে।"
আইএফএস অফিসার পারভীন কাসওয়ান ট্যুইট করে জানান, "কলারওয়ালিকে পেঞ্চের মা বলা হয়। ভারতে বাঘের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।" ২০০৮ সালের মার্চ মাসে বাঘটির গলায় একটি ট্রান্সমিটারযুক্ত রেডিও-কলার পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই তার নাম হয় কলারওয়ালি। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাঁর 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে কলারওয়ালির কথা স্মরণ করে শোকজ্ঞাপন করেন।
আনুষ্ঠানিক পদে যাঁরা রয়েছেন, ধরে নেওয়া যায়, তাঁদের শোকজ্ঞাপনও আনুষ্ঠানিক, কিন্তু দু'টি ক্ষেত্রেই বাঘের আশপাশে যেসব মানুষ থাকতেন, তাঁদের শোকজ্ঞাপন আন্তরিক। ফুলের মালা দিয়ে, মানুষের মতো সম্মানে, স্যালুট দিয়ে বাঘের সৎকার বাঘ এবং মানুষের সম্পর্কের ইতিহাসে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বাঘের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদছেন, এমনকী, গান স্যালুট দিতে না পারায় আক্ষেপ করছেন— এই আবেগই প্রমাণ করে, মানুষ সচেতন হলে বাঘে-মানুষে সহাবস্থান সম্ভব। প্রয়োজন এই সচেতনতা এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো ছড়িয়ে দেওয়া। যাতে এই যুগেও জীবিকার সন্ধানে বাঘের সঙ্গে যুঝতে না হয় মানুষকে। যাতে নিজ নিজ এলাকায় পরস্পরকে বিরক্ত না করে সহাবস্থান করতে পারে দু'জনেই। সচেতনতার যেমন দরকার আছে, তেমনই দরকার রয়েছে উপযুক্ত পরিকাঠামোর— একটি ছাড়া অপরটির প্রচার প্রহসন ছাড়া কিছু না।