ফিতের ফাঁদে 'বিকাশ'! উদ্বোধনের প্রতিযোগিতায় নাস্তানাবুদ সরকারের দেশ

Development of India: চিতাতেই সব শেষ বলে আক্ষেপ করেন কেউ কেউ, বিচক্ষণরা জানেন, চিতা নয়, আসলে ফিতা। ওই ফিতার বাঁধনে ঝুলতে ঝুলতে বিকাশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

কাঁটা যে কতপ্রকার, তা কবি গাছের, মাছের, খোঁপার এবং সবশেষে পিরিত দিয়ে একেবারে মর্মে গেঁথে দিয়েছেন। প্রচণ্ড জোরে মনে পড়াবার চেষ্টা না করেও, হলদেটে চায়ের দোকানে, অফিস ফেরত স্টেশনের ঝড়তি-পড়তি বাজার, শ্লথ-একঘেয়ে টোটোতে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফেরা বিবিধ অর্থবাহী শব্দটি এভাবেই মনে পড়ে। বাংলাভাষার বুনট এমনই। একই শব্দকে ডাঙায় ফেললে প্রেম, জলে ফেললে হাবুডুবু। স্থান-কাল ভেদে শব্দের মাহাত্ম্য কোথাও ভক্তির ধুনো জ্বালে, কোথাও দাঙ্গার আগুন। আসলে শব্দ তো ব্রহ্ম, সে ব্রহ্মকে ফাঁকি দিয়েই কেউ বাল্মিকী হন, কেউ দেশ চালান। দেশ বলতে মনে আসে বিকাশের কথা। রায় নয়, সবার জন্য ও সবার সঙ্গে যেটা ঘটানোর কথা বলে রাষ্ট্র, সেই বিকাশ। পোশাকি নাম, উন্নয়ন। আর দেশের উন্নয়নের ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ, দুই-ই হল ফিতে।

চিতাতেই সব শেষ বলে আক্ষেপ করেন কেউ কেউ, বিচক্ষণরা জানেন, চিতা নয়, আসলে ফিতা। ওই ফিতার বাঁধনে ঝুলতে ঝুলতে বিকাশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এদেশে প্রকল্প, যোজনা, প্রতিশ্রুতির অধিকাংশ দৌড় ফিতে থেকে ফিতে অবধিই। ফিতে কেটে যে ভিত্তি শুরু হয়, ফাইলের ফিতের গিঁটে সে এমন ফাঁসে যে যুগের পর যুগ বন্ধ কারখানার কঙ্কাল দেখেও আর প্রশ্ন জাগে না। প্রশ্ন জাগে না কেন শিল্প শহর, খনি শহর বলে ভূগোল বইতে পড়া এলাকাগুলিতে কোনও শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, কেন বন্ধ হয়েছে একের পর এক খাদান। কেন ঘটা করে আমপল্লব ঝুলিয়ে, ফিতে কেটে যে কর্মসংস্থানের ‘স্কিম’ সরকার নিয়েছিল, তা আইনি জটে পড়ে, অথবা অলাভজনক দাগিয়ে দিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য শুধুই যে কর্মসংস্থান-শিল্প-ভারী মেশিনপাতি তা নয়। বুনিয়াদি স্কুলের কপালেও ফিতে ঝুলেছে। ফিতের ফাঁদে আটকে রয়েছে আবাসন থেকে শুরু করে হাসপাতাল। ভিত্তিপ্রস্তর বলে যে জিনিসটা স্থাপনের সময় ব্যাপক হাততালি পড়ে, কাঁচির কুচুৎ শব্দে যেখানে প্রতিশ্রুতির চারা প্রোথিত হয়, ফিতেতেই সবটা শেষ হয়। অবশ্য সর্বত্র কাঁচিও লাগে না। পাকিস্তানের কারামন্ত্রী ফৈয়জ উল হাসান চৌহ্বান সম্প্রতি এক ইলেকট্রনিক্সের দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে দাঁতে করেই ফিতে কেটে দেন। আসলে উন্নয়নকে যদি সফর ধরা যায়, তবে তার যাত্রার শুরু ও শেষ ফিতেই নির্ধারণ করে।

এত নেগেটিভ কথাবার্তা রবিবার, পাঁঠাবার, ছুটিবারে কেনই বা পড়বেন মানুষ। বিদ্বজ্জনরা বলেন, আশাতেই চাষা বাঁচে। তাই সব বিকাশের কপালেই যে ফিতের ফাঁদ এমন নয়। যেমন ২০২০ সালের, অগাস্ট। রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, অর্থাৎ বিকাশের ফিতে কেটেছেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী পুজো দিয়েছেন, চেয়েছেন ২০২৪-এর গোড়াতেই যাতে ভারতে বহুকাঙ্খিত (!) রামমন্দিরে এসে মাথা ঠুকতে (ঠেকাতে লিখতে হত সম্ভবত) পারেন ভোটাররা। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের আগেই রামমন্দিরের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে গেরুয়া দল। এবং তা হবেও। আইনি জটে, লাল ফিতের ফাঁদে পড়তে হবে না এই মন্দির নির্মাণকে। অর্থাৎ ২০২৪ ভোটের আগেই ১১০ একর জমিতে ছড়িয়ে থাকা এই মন্দির উপহার পাবে দেশ, যার ফিতেটি কেটেছিলেন স্বয়ং নমো। ৯০০ থেকে ১০০০ কোটি অর্থ ব্যয়ে সবকে লিয়ে ‘বিকাশ’ আনতে চলেছে এনডিএ।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন

ভালো উদাহরণ কখনও কম পড়ে না। এমনই আরেক বিকাশ, যা কোনওভাবেই লাল ফিতের জালে আটকাবে না তা হল, সেন্ট্রাল ভিস্তা। এই প্রকল্পের আওতায় ঢেলে সাজছে রাজধানী দিল্লির বিজয় চক থেকে ইন্ডিয়া গেট। সেন্ট্রাল ভিস্তা অ্যাভিনিউয়ের ফিতে কেটে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজপথ বদলে হয়েছে কর্তব্যপথ। সংসদ চত্বরের ৬৯ টি জামগাছ তুলে এনে বসানো হয়েছে সেন্ট্রাল ভিস্তা অ্যাভিনিউয়ের দু’পাশে। জাম প্রীতি নয়, বরং রামপ্রীতিই এর নেপথ্যে। শ্রীরামচন্দ্রের ‘প্রিয় ফল’ গাছ বাঁচাতে এককণা গাফিলতি চায় না কেন্দ্র সরকার। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে শুরু করে সংসদভবন, মন্ত্রী ও আমলাদের বাড়ি সবটাই নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। যার জন্য খরচ করা হচ্ছে ১৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর নতুন দেশের ‘বিউটি বিকাশের’ লক্ষ্যে সংসদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নরেন্দ্র মোদি।

ফিতে কাটা বিষয়ে কখনই রাজনৈতিক মেদিনীর সূচাগ্রও ছাড়তে চাননি নেতারা। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্ধমানের ঝুলন্ত্র ব্রিজ উদ্বোধন করার কথা ছিল তৎকালীন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের। কিন্তু আগেভাগেই গিয়ে সেতুর ফিতে কেটে দিয়েছিলেন তৎকালীন পঞ্চায়েত মন্ত্রী বর্তমানে প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়। মেদিনীপুরে বসে বর্ধমানের এই চার লেনের ঝুলন্ত ব্রিজের প্রতীকী ফিতে কেটে উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। এখানেই শেষ নয়। কে আগে ফিতে কাটবেন এই ঠান্ডা যুদ্ধ চলেছে বাবুল সুপ্রিয় (তখন বিজেপি ছিলেন) এবং মলয় ঘটকের মধ্যেও। বাবুল সুপ্রিয় এসে উদ্বোধন করার কথা থাকলেও পানাগড় বাইপাসের ফিতে কেটে দেন রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক। মন্ত্রী সাংসদের মধ্যেই থেমে থাকেনি ফিতে কাটা প্রতিযোগিতা। জলপাইগুড়ির সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর থাকলেও আগেভাগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিতে কেটে দেন। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের যৌথ টাকায় হুগলির কামারকুণ্ডুতে তৈরি হয় রেল ওভারব্রিজ। গত জুন এই রেল ব্রিজের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলমন্ত্রী যাতে এই ওভারব্রিজের উদ্বোধনে অংশ নিতে পারেন, সেজন্য হুগলির জেলাশাসককে চিঠি লিখে, উদ্বোধনের দিন পরিবর্তনের আবেদন করেছিল রেল কিন্তু তাতে বদলানো হয়নি অনুষ্ঠান সূচি। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করার এক সপ্তাহ পরই একই ব্রিজের ফের ফিতে কাটে ভারতীয় রেল।

আসলে ফিতে কাটা বিষয়টা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে কে ফিতে কাটবেন তা নিয়ে আজকাল ভোটাভুটিও করতে হচ্ছে। তমলুকের নিমতৌড়ি ভারত সঙ্ঘ ক্লাবের পুজোয় কে ফিতে কাটবেন এই নিয়েই সম্প্রতি ব্যাপক মতানৈক্য তৈরি হয় ক্লাবের অভ্যন্তরে। কোনওভাবেই একমত না হওয়ায় ভোট করার পন্থা নিয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। জানা গিয়েছে, ক্লাবের একটা অংশের ইচ্ছা পুজোর উদ্বোধন করুন প্রাক্তন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। অন্য একটি অংশ স্বাভাবিকভাবেই গেরুয়া ঘেঁষা, তাঁদের আবার দাবি, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী উদ্বোধন করুন পুজোর। ভারত সঙ্ঘের পুজোয় বেশ কয়েকবার ফিতে কেটেছিলেন শুভেন্দু। তখন তিনি তৃণমূলে ছিলেন। এদিকে ক্লাবের সভাপতি শত্রুঘ্ন জানা আবার স্থানীয় তৃণমূলের নেতা। তিনি কোনওভাবেই ‘দলবদলু’ শুভেন্দুর হাতে কাঁচি দেখতে নারাজ। ফলে সংসদ বা বিধানসভা দখলের লড়াইতেই যে শাসক-বিরোধী ভোট অর্জনে মাঠে নামেন এমনটা ভাবা খুবই ব্যাকডেটেড। পুজোয় কে কাঁচি ধরে ফিতে কাটবেন তা নিয়েও তৃণমূল-বিজেপি দুই শিবির বিভক্ত!

আরও পড়ুন- ধূমধাম করে প্রথম সমকামী পুরুষের বিয়ে, কলকাতা সাবালক হল?

কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই ফিতে কাটা বিষয়টি? দুর্মুখরা বলেন, ফিতে কাটা আসলে নিজেকে ‘জাতে ওঠানোর খেলা’। গলির মোড়ের দোকানের ফিটে কাটাতে পারলে একদিন সুযোগ আসতেও পারে পাড়ার পুজোর ফিতে কাটার। আর পুজোর ফিতে কাটায় হাত পাকাতে পাকাতেই একদিন স্কুল কলেজ, রাস্তা, ব্যাংক, স্টেশন, নর্দমা সব উদ্বোধনেই আসন আলো করতে পারার সুযোগ মিলতে পারে। আর একবার ক্ষমতার জাত চেনানো গেলে, ভিত্তিপ্রস্তর গেঁথে ক্ষমতার মেয়াদ চেনানোও সহজ হয়ে যায়। আসলে পুজোর ফিতে কাটা আর শুধুই শারদোৎসবের সূচনা নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের স্থানও। ক্লাবগুলিকে দেশের রাজনৈতিক হাওয়া-মোরগ বললে অত্যুক্তি হবে না। সেখানে কে ফিতে কাটছেন, ফিতে কাটার সময় কে কে হাততালি দিচ্ছেন, কে মুখ ব্যাজার করে সরে যাচ্ছেন- লক্ষ্য রাখলেই ক্ষমতাবদলের আঁচ টের পাওয়া যায়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারার মধ্যে তাই রয়েছে ‘এটা আমার!’ বলে ঝাণ্ডা গাড়ার গন্ধ। ঝাণ্ডা আমার, আমি তাকে গাড়ব, নাকি ফেলে রাখব, নাকি মাটি চাপা দেব তা জনগণ বলার কে? তাই কেন ভিত্তির শুরুয়াদ হওয়ার পরেও ভবিষ্যতের আলো দেখে না সরকারি প্রকল্প সেই প্রশ্ন উঠলেও উত্তর দেওয়ার দায় নেই কারও। লাল ফিতের বাঁধনে ফাইল ঢেকে সেসব এমন শীতঘুমে যায় যেখানে রাইট টু ইনফরমেশনের আলোটুকুও ঢোকে না।

সুতরাং বিকাশের চোখে রইল আঁধার আর ভাগ্যে রইল ফিতে। সত্যিই বাংলা ভাষা জাদুভাষা। এক ফিতেতে সে মনে করাতে পারে স্কুলমুখী বিনুনির কথা, মনে করাতে পারে যত্নে বাঁধা উপহারের গ্রন্থি অথবা পরজীবী অস্তিত্ব। ফিতের বাঁধন কেটে কেউ কেউ আলো দেখে, বাকিদের নামের পাশে ঝুল-কাদা-পরিত্যক্ত। ভিত্তির প্রস্তর আর ভবিষ্যৎ দুইই ঝাপসা হয়। মাঝে সাঝে তাতে ফিতেকাটা নেতার নাম আর ক্ষমতা ঘোলাটে অক্ষরে আধখেঁচড়া উঁকি দেয় মাত্র।

More Articles