যারা ফিতে কাটছে পারিশ্রমিক নিয়ে, বেশ করছে! শিল্পীদের সময়ের দাম আছে বইকি

Tollywood actor-writer Rahul writes: ফিতে যারা কাটে, তারা বেশ করে।

উদ্বোধন শব্দটার মধ্যে যে সাত্ত্বিকতা আছে, ফিতে কাটার মধ্যে তা নেই। তা অনেক বেশি কেজো ও কর্কশ। তা আমাদের সেলেব কানের পক্ষে পীড়াদায়ক, আবার উদ্বোধনের গায়ে যে গোবিন্দভগ চালের গন্ধ, তাও যে সত্যি নয়, তা আমরা বিলক্ষণ জানি। তাই আমরা ইংরেজির আশ্রয় নিই, ’ওপেনিং’ শব্দটাই আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে চালু শব্দ। আর পুজো-পরবের আগে আপনি যদি কান ওপেন রেখে স্টুডিও দিয়ে হেঁটে যান, বিস্তর দরদাম শুনতে পাবেন।কেউ উচ্চস্বরে দাপটের সঙ্গে, কেউ কোনায় লুকিয়ে ফিসফিস করে। টাকার সঙ্গে আরও অনেক বোঝাপড়া করার থাকে। তেল দেবে না গাড়ি? বডি গার্ড দেবে না নিজেকেই নিজের বডির দায়িত্ব নিতে হবে? কতক্ষণ থাকতে হবে গিয়ে? ক'জনের সঙ্গে সেলফি তুলতে হবে?এইবার কী হয়, সখ্য থাকলে সবসময় অত আড়াল দরকার পড়ে না।

ঠিক এখানেই ভুল হয়েছিল ভোম্বলদার (নাম পরিবর্তিত)। অরুণাদির (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে অনেকদিন ধরেই অভিনয় করছেন ভোম্বলদা। বন্ধুত্ব তো হয়েইছে, অরুণার কনভেন্টে পড়া ইংরেজি। ঝকঝকে স্মার্টনেস, ভণিতাহিন ভুরু, এসবে, যাকে বলে, ভোম্বলদা একটু কুপোকাত হয়েই ছিলেন।দু'জন সাজঘরে গল্প করছে, এমন সময় ভোম্বলদার কাছে ফোন, ওপেনিং করতে হবে। বেশ করতে হবে তো করতে হবে, ভোম্বলদা অকুতোভয়ে নিজের 'রেট' বলে দিলেন। ফোন নামিয়ে দেখেন, অরুণা তার দিকে অভিমানী চোখে তাকিয়ে আছে, চোখ ছাপিয়ে আসছে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। ভোম্বলদার মাথায় বিলি করে দিয়ে অরুণা বলল, "Don’t do this to yourself bhombol, you are such a famous actor, you deserve much more than this, don’t sell yourself so cheaply,” বলে উদগত কান্না আটকাতে না পেরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ভোম্বলদার চোখ খুলে গেল।রাস্তায় দেখলেই যদিও লোকে ভুল সিরিয়ালের নাম বলে, তাও চেনে তো! এত গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন ভোম্বলদা, যে, লাঞ্চ স্টুডিওর মাছের ঝোলে নিজের নকল দাড়ি মেখে খেয়ে নিচ্ছিলেন, সহ-অভিনেতারা দৌড়ে এসে সামাল দেন। লাঞ্চের পর গলা-টলা খাকরে অর্গানাইজারকে ফোন। ধরুন, আগের ফোনে ভোম্বলদা ৫ টাকা চেয়েছিল, এবার ডিরেক্ট ১২ টাকা ল্যান্ড করল, বিনা কারণে। হতবাক অর্গানাইজার মুখের ওপর ফোন দিল কেটে। গায়ে সিংহের বল চলে এসেছে তখন ভোম্বলদার, একা-একাই ঘর কাঁপিয়ে ঠা ঠা করে হাসলেন খানিকক্ষণ। ঘণ্টা গেল, অর্গানাইজার ফোন করল না, দু'ঘণ্টা, তিন, চার, পাঁচ, ফোন আর এলই না।এদিকে অরুণাও কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে, ফোনেই বেশি ব্যস্ত যেন। রাতে বাড়ির খাবার খেয়ে মাথা একটু ঠান্ডা হলো, ভাবলেন অর্গানাইজারের সঙ্গে এত দিনের সম্পর্ক, এবারেরটা নাহয় ৫ টাকাতেই করে দিলেন, পরের বার বাড়ালেই হবে। বারচারেক ফোন করলেন, পামরটা ওঠাল না।

গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হলো না,পরেরদিন ভোম্বলদা দেখলেন অরুণা সাজঘর থেকে হাসতে হাসতে বেরচ্ছে, সঙ্গে ওই অর্গানাইজার, অ্যাডভান্স করতে এসেছে। ভোম্বলদার সেই কান্নার শব্দ আজও প্রতি অমাবস্যায় স্টুডিও-র আনাচকানাচে শুনতে পাওয়া যায়, বড় বেদনাদায়ক। 

আরও পড়ুন: স্টারডমের দুনিয়া ক্ষমাহীন, পল্লবীদের দুঃখ বেড়ে বেড়ে ক্যানসার হয়ে ওঠে সেখানে

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, শিল্পীদের এই ফিতে কাটাকে আমি কী চোখে দেখি। আমি নির্দ্বিধায় এবং সোচ্চারে জানাতে চাই, এতে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমি অনেকদিন করি না, সেটা আমার ইচ্ছে, কিন্তু যে করে, বেশ করে। আমাদের কাজ আজ আছে, কাল নেই, কোভিডের সময় শিল্পীদের অধিকাংশর কী অবস্থা হয়েছিল, তা আমরা ভুক্তভুগীরাই শুধু জানি।আর আপনি একজন শিল্পীকে ডাকছেন, আর সে পঞ্চমীর দিন নিজের পাড়া, বন্ধু ছেড়ে আসছে যখন, তার সময়ের একটা দাম আছে বইকি। আর আপনি সেই শিল্পীকে ডেকেছেন, কারণ, সে আপনাদের মনে একটা জায়গা করতে পেরেছে। কিন্তু এটা তো একদিনে হয়নি, আপনার মঞ্চ পর্যন্ত আসার আগে যে দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস আছে, অপমানের অধ্যায় আছে, না-ঘুমোনো অজস্র রাত আছে, তার খবর কে রাখে?এবং আগামীতে সেই শিল্পী যদি নিজেকে প্রাসঙ্গিক না রাখতে পারেন, তাঁকে ভুলে যেতেও কেউ এক মুহূর্ত নেবে না। কাজেই উষ্ণ সময়কে ব্যবহার করার মধ্যে আমি অন্তত কোনও ভুল দেখি না। যদি অযোগ্য মনে হয়, ডাকবেন না, কিন্তু ডাকলে বিলক্ষণ পয়সা দেওয়াটাই দস্তুর। উপরোধের ঢেঁকি হলে আলাদা কথা।বন্ধুদের অনুরোধে অনেক কিছু করা যায়।

খইরুদ্দিন মসজিদ অমৃতসরের প্রাচীন মসজিদ।দেশভাগের পর অমৃতসরে মুসলিম ছিল না বললেই চলে। খইরুদ্দিন মসজিদও নিশ্চুপ হয়ে গেল সময়ের সঙ্গে, পাড়ার এক-দু'ঘর প্রাচীন হিন্দু পরিবার দীর্ঘশ্বাসে মিশিয়ে বলত, খইরুদ্দিনের সরগরম দিনগুলোর কথা। স্বাধীনতার প্রায় এক দশক পরে ১৯৫৬-তে অমৃতসরের ওই পাড়ার লোকে চমকে ওঠে, মুয়াজ্জিন ফিরে এসেছে, আজান দিচ্ছে, দিকে দিকে হিন্দু পরিবারে উৎসব শুরু হয় ওই অসময়, খইরুদ্দিন জেগে উঠেছে আবার। এটাও তো এক রকমের ফিতে কাটা, এর ওপর রাগ করা যায় বলুন?

More Articles