রাজার জেদে রোলস রয়েস হলো ময়লা ফেলার গাড়ি! ক্ষমা চেয়েছিলেন সাহেবরা
Rolls Royce Limousin: শব্দহীন ইঞ্জিন, ঋজু স্বাস্থ্য নিয়ে চলেছে কলকাতার রোলস রয়েস।
সম্প্রতি গত হলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এলিজাবেথের শখ ছিল গাড়ি চালানোর। নানা ধরনের গাড়ি তাঁর ছিল– বেন্টলি, রেঞ্জরোভার, আর অবশ্যই রোলস রয়েস। রানির নিত্যসঙ্গী ছিল ১৯৬১ সালের একটি রোলস। একবার হলো কি, রানি ওই গাড়িটি চালিয়ে উইন্ডসর ক্যাসেল থেকে বাকিংহাম প্যালেসে যাচ্ছেন। হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। ভিজে রাস্তায় যে সার্জেন্ট রানির গাড়ির আগে পাইলটিং করছিলেন, তিনি মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন আর রানির গাড়ি ধাক্কা মারল পুলিশ সার্জেন্টটিকে। তার কলার বোন ভেঙে গেল। তখন ব্রিটিশ পুলিশ নর্টন মোটরসাইকেল ব্যবহার করত। 'দ্য গার্ডিয়ান' কাগজ পরের দিন লিখল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঠিক করেছে, রানির সঙ্গে পাল্লা দিতে আমেরিকা থেকে হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল আমদানি করা হবে।
১৯০৬ সালে ইংল্যান্ডে জন্ম রোলস রয়েসের। সারা পৃথিবীতে এত বড় স্ট্যাটাস সিম্বল আর কোনও গাড়ি তৈরি করতে পারেনি। ১৯৮৭ সালে একটি সার্ভে রিপোর্ট বলছে, কোকোকোলার পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলো রোলস রয়েস।
বলশেভিক বিপ্লবের পর লেনিন যে-গাড়িটি চড়তেন, সেটি রোলস। রোলসকে নিয়ে গল্পের কোনও শেষ নেই। রোলস রয়েস কোম্পানি একটি বিজ্ঞাপন দিত, সেটি এইরকম- বিখ্যাত অভিনেতা রিচার্ড বার্টন তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ টেলরের জন্য একটি রোলস কিনতে গেছেন। একটি গাড়ি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি যখন রোলসের কর্তাদের সঙ্গে আলাপ করছেন, তাঁরা ওঁকে বলেন, এই গাড়ির লাইফটাইম গ্যারান্টি রয়েছে, সারা জীবনেও এই গাড়ি খারাপ হবে না। খুশি হয়ে রিচার্ড গাড়ি নিয়ে শো-রুম থেকে বেরিয়েছেন। কিন্তু ও মা! এ কী হলো! শো-রুম থেকে বেরিয়েই গাড়িটি থেমে গেল একেবারে। নট নড়নচড়ন, নট কিচ্ছু। রিচার্ড রার্টন রেগে আগুন। শো-রুমে এসে তিনি সবাইকে বললেন, মামলা করবেন রোলসের বিরুদ্ধে। চালাকি হচ্ছে! মিথ্যে কথা বলে গাড়ি বিক্রি করা। শো-রুমের কর্তারা অপ্রস্তুত। তাঁরা এক বৃদ্ধ মেকানিককে পাঠালেন, দেখতে, গাড়ির কী হয়েছে। মেকানিকটি গাড়ির বনেটটি খুলে অবাক! গাড়িতে ইঞ্জিন লাগানো নেই। তিনি এসে রিচার্ড রার্টনকে বললেন, স্যর, গাড়িতে ইঞ্জিন লাগানো নেই, তাই আটকে গেছে। আমরা ইঞ্জিন লাগিয়ে দিচ্ছি। রিচার্ড রার্টন অপ্রস্তুত। শো-রুমের মালিককে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ইঞ্জিন নেই। তো গাড়িটা চলল কী করে? বৃদ্ধ মেকানিকটি বললেন, গুডউইল ভিত্তি করে চলে গেছে স্যর। এটাই রোলসের সুনাম। গাড়ি ছাড়াও প্লেন এবং জাহাজের ইঞ্জিনও রোলস বানাত।
আরও পড়ুন: নেতাজির প্রিয় বাহন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ে আশি বছরের ফোর্ড জিপ এখন কলকাতার বাসিন্দা
সালটা ১৯৩০-'৩২, মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের তখন নাম কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ। মাস্টারমশাইরা সবাই ধুতি-পাঞ্জাবি, বা ধুতি-শার্ট পরে ছাত্র পড়াতে আসেন। ট্রপিকাল অসুখ পড়াতেন কালাজ্বরের ওষুধের আবিষ্কর্তা ডা. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। একদিন তিনি পড়াচ্ছেন, ছাত্ররা দেখে তাঁর পাঞ্জাবির হাতাটা ছেঁড়া। তাঁকে সেটি জানাতেই বিরক্ত উপেন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, তোমরা আমার ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা দেখছ, গাছতলাতে যে রোলস রয়েসটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটি দেখলে না। অর্থাৎ, রোলস চড়লে কী পোশাক পরা হলো, তা গৌণ। গাড়িটিই বলে দেবে মালিকের আভিজাত্য।
তুলসীচরণ গোস্বামী, সন্তোষ-এর মহারাজা স্যর মন্মথনাথ রায়চৌধুরি, মার্টিন বার্ন-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যর রাজেন মুখার্জি নিয়মিত রোলস রয়েস চড়তেন কলকাতার রাস্তায়। প্রদ্যুম্ন মল্লিক এবং রাজা হৃষিকেশ লাহা-র অনেকক'টি রোলস ছিল। ভারতে প্রথম রোলস আনেন মহিশূরের মহারাজা ১৯০৮ সালে। হায়দরাবাদের নিজামের রোলস এখনও সালার জং মিউজিয়ামে রাখা আছে। অমিতাভ বচ্চন, সঞ্জয় দত্ত, শাহরুখ খান রোলসের মালিক।
একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন আলোয়ারের রাজা জয় সিংহ প্রভাকর। তিনি লন্ডনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রোলসের শো-রুমে ঢোকেন এবং একটি গাড়ি কিনতে চান। রাজার সাদামাটা পোশাক দেখে ইংরেজ সেলসম্যান তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং প্রায় তাঁকে দোকান থেকে বের করে দেয়। রাজার গোঁ বলে কথা! তিনি হোটেলে ফিরে এসে ওই দোকানে ফোন করেন, এবং নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি সাতটি গাড়ি কিনতে চান। দোকানদার মহা খুশি। রাজা দোকানে যেতেই তাঁকে আদর-খাতির করে বসানো হয়। রাজার পরনে জমকালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি। সেলসম্যানটিও তাঁকে চিনতে পারেনি। রাজা বললেন, গাড়িগুলো যেন আলোয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেলসম্যানটিও যেন সঙ্গে যায়।
দেশে ফিরে রাজা ওই গাড়িগুলোকে মিউনিসিপ্যালিটি-তে দিয়ে দেন এবং সেগুলো ময়লা ফেলার গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। ময়লা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে রোলস- এই ছবি তিনি সর্বত্র পাঠিয়ে দেন। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে রোলসের বিক্রি কমে যায়, কারণ ক্রেতারা মনে করেন, গাড়ির মান কমে গেছে তাই ময়লা ফেলার গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। রোলস কোম্পানি রাজার কাছে ক্ষমা চায় এবং ব্যাপারটি মিটমাট হয়ে যায়।
কলকাতাতে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন, সেটি আছে এবং দক্ষিণ কলকাতাতে শীতকালে প্রায়ই তাঁকে চলতে দেখা যায়। ১৯৩৭ সালের রোলস রয়েস লিমুজিনের বর্তমান মালিক বসন্তকুমার কারনানি। এই গাড়িটি করেই বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রথম রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র তাঁর ছাত্রজীবনে হিন্দু হোস্টেলে থাকতেন। তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন, এত দামি গাড়ি তাঁকে দেওয়ার জন্য; কিন্তু স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি বলে কথা। বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁকে ওই গাড়িটি চড়তে দেখা যেত।
সাতের দশকের গোড়া থেকে কারনানি পরিবারের সদস্য এই রোলস রয়েস। প্রথমে কালো রং থাকলেও বর্তমানে ওঁর রং ক্রিম এবং মেরুন। বয়স ৮৫ হলে কী হবে, সারা দেহে আভিজাত্যের ছাপ এবং অটুট যৌবন। যযাতি অখণ্ড যৌবন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি, ইনি পেয়েছেন। বসন্তবাবু বলছিলেন, কোনও রকমের সমস্যা ওঁর নেই। সপ্তাহে দু'দিন স্টার্ট করা হয়, গ্যারাজেও আগু-পিছু করে ওঁর শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখা হয়।
ভারতের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই রোলস রয়েস। ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী। এখনও দেমাক দেখে কে! রাস্তায় বেরোলেই সবাই চেয়ে দেখে। শব্দহীন ইঞ্জিন, ঋজু স্বাস্থ্য নিয়ে চলেছেন উনি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সোজা, টান টান চলন। যখন দেশময় আজাদি কা অমৃত মহোৎসব চলছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনকে কেন্দ্র করে, তখন কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আছে রোলস রয়েস লিমুজিন।