'তাসের দেশ'-এর রাজপুত্র এখনও যুদ্ধ ঘোষণা করে সব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
যে কোনও বিপ্লবেরই মূল মন্ত্র হলো: বাঁধ ভেঙে দাও/ বাঁধ ভেঙে দাও/ বাঁধ ভেঙে দাও। তাসের দেশের রাজপুত্র যে মন্ত্র জপছে সবসময়...
১৯৩৩-এর অগাস্টে জার্মান ভাষায় অনুদিত ‘তাসের দেশ’ নিষিদ্ধ হলো জার্মানিতে।
১৯৪১-এর অগাস্টে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৪২-এর অগাস্টে মহাত্মা গান্ধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।
১৯৪৫-এর অগাস্টে তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় বিপ্লবী নেতাজির মৃত্যু, যিনি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। ১৯৪৭-এর অগাস্টে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
২০১৩ অগাস্টে কিউ-র পরিচালনায় ‘তাসের দেশ’ সিনেমা মুক্তি পায়। ‘তাসের দেশ’ রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি বিপ্লবী নাটক। বলা যায়, অগাস্ট মাস আমাদের বাঙালি তথা ভারতীয়দের বিপ্লবের মাস। আর এই অগাস্টে আমাদের সঙ্গে থাকেন গান্ধী, সুভাষ ও রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন: অ্যালঅ্যালকোহল, জ্যোতিষ, তন্ত্র: মার্কসবাদী নবারুণ ঘুরেছেন নানা মার্গে
ইংরেজি ১৮৯২ সালে (বাংলা সন ১২৯৯) রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৩১ বছর বয়সে 'সাধনা' পত্রিকায় একটি গল্প লিখেছিলেন, নাম 'একটা আষাঢ়ে গল্প’। সেই গল্পে ছিল যে, এক দুয়োরানি আর তার ছেলে নির্বাসিত, তারা সমুদ্রপারে বাস করে। সেই জীবন রাজপুত্রর একঘেয়ে লাগে। সেই জীবন থেকে মুক্তি পেতে সে তার দুই বন্ধুকে নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। গিয়ে পৌঁছয় এক অদ্ভুত দেশে, যার নাম তাসের দেশ। সে দেশে তাসেরা থাকে। তাদের সমস্ত কাজে চূড়ান্ত শৃঙ্খলা। নিয়মের বাইরে তারা কিছুই করে না। তাদের মুখের ভাবের কোনও বদল নেই। তাদের হাসি নেই, কান্না নেই, সন্দেহ নেই, দ্বিধা নেই। সে এক যান্ত্রিক দেশ। রাজপুত্র আর তার বন্ধু দু'জনে গিয়ে পড়ে সেই তাসের দেশে। তারা সেই দেশের নিয়ম কিছুই মানে না। ধীরে ধীরে এরাই সেই দেশের হাওয়া পালটে দেয়। সেই মুক্ত হাওয়ার সংক্রমণে আক্রান্ত হয় তাসের দেশের তাসেরা। এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের বন্যায় ভেসে যায় সে-দেশের নিয়মকানুন। তাসেরা বিদ্রোহ করে রাজার বিরুদ্ধে। রাজপুত্র আর তার বন্ধুরা এই বিপ্লব ঘটায়। এই গল্পটি লেখার ৪১ বছর পর, জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে ৭২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ১৯৩৩ সালে (বাংলা সন ১৩৪০) এই গল্পটিকে ভিত্তি করে ‘তাসের দেশ’ নাটকটি লেখেন। এটি প্রথম সংস্করণ। ১৯৩৮ সালে (বাংলা সন ১৩৪৫) ৭৭ বছর বয়সে এটির পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেন।
আমি আর কিউ যখন তাসের দেশের চিত্রনাট্য লিখছিলাম, তখন আমরা ঠিক করি ওই আষাঢ়ে গল্পকে আমাদের ‘তাসের দেশে’-র প্রাককথন হিসেবে জুড়ে দেব এবং অবশ্যই সে গল্প বলা হয়েছে আমাদের নিজস্ব ঢঙে। আমরা এই ‘তাসের দেশ’-কে সময়চিহ্নর বাইরে দেখার চেষ্টা করেছি। সেই 'তাসের দেশ' হলো নিযেধের বেড়া। আমরা দেখেছি তখনও এবং এখনও, লেখক, গায়ক, চিত্রপরিচালক, শিল্পী, অভিনেতা যে কেউই হোক না কেন, তাকে একটা নিষেধের গণ্ডির মধ্যে রেখে দিচ্ছে রাষ্ট্র। শিল্পী হিসেবে আমাদের কাজ হলো, সেই নিষেধের বেড়াকে যতদূর ঠেলা যায় নিজের কথা বলার জন্য। এই হলো শিল্পীর ইচ্ছে। রাজপুত্রর কাছ থেকে ইচ্ছে-মন্ত্র নিয়ে ছক্কা-পাঞ্জা গাইছে,
ইচ্ছে
সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে
সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গেলেন, সঙ্গী অমিয় চক্রবর্তী। এর আগে ১৯২১ সালে ও ১৯২৬ সালে জার্মানিতে তিনি এসেছিলেন, এবার এসে দেখলেন সেই জার্মানি আর নেই। উগ্র জাতীয়তাবাদের আগুন ভেতরে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে । যদিও সম্মান তিনি সর্বত্র পেয়েছেন, যেমন আগের দু'বার পেয়েছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী একটি চিঠিতে লিখছেন,
সম্রাটের মতো জার্মানি পরিক্রমা করছি। শ্রেষ্ঠ যা কিছু আপনিই আমাদের পাতে এসে পড়ছে। পৃথিবীতে কোথাও রবীন্দ্রনাথকে এদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে ভাবতে পারি না।
কিন্তু এই ভালবাসা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেন। ২২ মার্চ মিউনিখের কাছে দাচাওতে প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প খোলা হলো। ১ এপ্রিল হিটলার ইহুদিদের বয়কট করার ডাক দিলেন। ২৬ এপ্রিল গেস্টাপোবাহিনী প্রতিষ্ঠা হলো আর ১০ মে বার্লিনের রাস্তায় নাৎসিদের অপছন্দের বই পোড়ানোর উৎসব। নিষিদ্ধ হলো জার্মান ভাষায় অনুদিত যাবতীয় রবীন্দ্র-রচনা। আর এই ১৯৩৩ সালের আগস্ট ৬, নিষিদ্ধ হলো জার্মান ভাষায় 'তাসের দেশ'-এর প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ কি তখনই এই সৈন্যসর্বস্ব জার্মানির কথা ভেবেছিলেন? যা নাকি ‘তাসের দেশে’-র মতো সৈন্যসর্বস্ব? আর ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ ‘তাসের দেশ'-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করলেন, তখন ইউরোপে যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। হিটলার পৃথিবী দখলের পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তাই হয়তো 'তাসের দেশ'-এর গোলাম বলে ওঠে, “বাধ্যতামূলক আইন চাই।" সভ্যতার সংকটে চূড়ান্ত শৃঙ্খলায় গড়ে উঠছে একটা ফ্যাসিস্ট দেশ, তাসের দেশ।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যখন স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকতা আর আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে ফেলে শাসকদের সঙ্গে শুধু আবেদন-নিবেদন চালিয়ে যাচ্ছে, তখন সুভাষচন্দ্র এই নিয়মতান্ত্রিকতায় বিরক্ত। তিনি চাইছেন নিয়ম ভেঙে স্বাধীনতা আন্দোলনের নৌকাটাকে ঝোড়ো হাওয়ার মুখে পাল তুলে দিতে। তিনি যেন বলছেন,
খর বায়ু বয় বেগে
চারিদিক ছায় মেঘে
ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো
তুমি কষে ধরো হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
হাই মারো মারো টান...
তার আহ্বান ছিল,
গণি গণি দিনক্ষণ
চঞ্চল করি মন
বলো না যাই কি নাহি যাই রে
সংশয় পারাবার
অন্তরে হবে পার
উদ্বেগে তাকায়ো না বাইরে...
রবীন্দ্রনাথ সুভাষের এই মনোভাবকে ভালবাসতেন, সম্ভবত ১৯৩৬ সালে তাঁর লেখা 'দেশনায়ক' প্রবন্ধে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন, তা ভবিষ্যৎবাণীর মতোই মিলে গিয়েছে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘তাসের দেশ’ দ্বিতীয় সংস্করণটি উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে। তিনি উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন,
কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।
সুভাষচন্দ্র ভারতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ২০ বছরে (১৯২১-'৪১) ১১ বার জেলে গিয়েছিলেন। তাহলে কি সুভাষচন্দ্র বসুই 'তাসের দেশ'-এর রাজপুত্র? যে নিশ্চিন্তে সুখের জীবন ছেড়ে বার বার জেলে যায় বা দেশের বাইরে বেরিয়ে পড়তে চায়। সুভাষ অবশ্য বেরিয়েছিলেন রাজনৈতিক বাণিজ্যে। ১৯৩৩ সালে সুভাষচন্দ্রকে যখন ব্রিটিশ সরকার ইউরোপে নির্বাসন দেয়, তারপর ৩ বছর মার্চ ১৯৩৩ থেকে মার্চ ১৯৩৬ তিনি ইউরোপে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নৈতিক সাহায্য চান। এমনই তাঁর বেপরোয়া মনোভাব যে, ‘তাসের দেশ’-এর রাজপুত্রের মতো তিনি ভেবেছিলেন,
যাবই আমি যাবই ওগো
বাণিজ্যেতে যাবই
লক্ষ্মীরে হারাবই যদি
অলক্ষ্মীরে পাবই
যাবই আমি যাবই
কারণ সেই বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে হরিপুরা কংপ্রেস অধিবেশনে সুভাষ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। রবীন্দ্রনাথ যেন দেখতেই পাচ্ছিলেন সুভাষের নেতৃত্ব। যদিও তিন বছরের মাথায় ১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র গোপনে দেশত্যাগ করেন।
যে কোনও বিপ্লবেরই মূল মন্ত্র হলো: বাঁধ ভেঙে দাও/ বাঁধ ভেঙে দাও/ বাঁধ ভেঙে দাও। তাসের দেশের রাজপুত্র যে মন্ত্র জপছে সবসময়, সেই রাজপুত্র বিপ্লবী বা বলা যায় প্রত্যেক বিপ্লবী রাজপুত্র, সে প্রাসাদের সুখ ছেড়ে, ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে বলছে,
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক
ভাঙনের জয় গান গাও
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক
যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক
সে বিপ্লবী নানারূপে আমাদের কাছে আসে, সে তিনি অহিংস বিপ্লবী গান্ধী বা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার ডাক দেওয়া রবীন্দ্রনাথ, স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সুভাষ, বিটলস বিপ্লবী লেনন কি ফোক-রক বাউল ডিলান, রেগে সংগীতের দামাল শিশু বব মার্লে অথবা সানফ্রানসিসকোর ঘেটো থেকে উঠে আসা কালো মানুষদের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদী র্যাপ মিউজিক, ফরাসি থিয়েটারের দিব্যোন্মাদ আর্তো, আঁভা গার্দ সিনেমার গোদার বা ইতালির পরিচালক পাসোলিনির উচাটনি সিনেমা নয়তো তীব্র ক্রোধে ক্যামেরায় মদ ঢেলে দেওয়া আমাদের নীলকণ্ঠ ঋত্বিক বা বাংলার লোকজীবনের প্রান্তে দেহদর্শনের গান গেয়ে ওঠা ফকির লালন।