অ্যালকোহল, জ্যোতিষ, তন্ত্র: মার্কসবাদী নবারুণ ঘুরেছেন নানা মার্গে

বাংলা গল্প-উপন্যাসে যে খোকা গদ্যভাষার কলকাকলি চলে, নবারুণের অঙ্গুঠাছাপ দেওয়া ভাষাটি তার ওপর আরডিএক্স-এর মতো ফেটে পড়ে।

 


এমন নয়, যে, নবারুণ ভট্টাচার্য কে, আমি জানতাম না। ১৯৮২ সাল থেকে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউজে যাতায়াত। যেহেতু কলেজ থেকেই আমার বিভিন্ন ধরনের নেশা ও নকশালদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, তো সেই সময় প্রাক্তন ও নব্য নকশালদের হাতে হাতে একটা কবিতার বই ঘুরতে দেখি, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’, কবির নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। যেহেতু নকশালরা পড়ছে, তাই আমিও বইটা কিনে পড়ে ফেললাম। জানলাম, উনি ‘নবান্ন’ নাটকখ্যাত বিজন ভট্টাচার্য ও ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস-খ্যাত মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান। পরে জেনেছি, সুপারহিট হিন্দি সিনেমা প্রদীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত 'নাগিন' সিনেমার গল্পটিও বিজন ভট্টাচার্যর লেখা।

তার কিছুদিন পরে কফিহাউজের দরজার পাশে দেখেছি একটা নাটকের বিজ্ঞাপনের স্ট্যান্ডি। নাটকের দলের নাম ‘নবান্ন’। পরিচালক, নবারুণ ভট্টাচার্য। না, তখন ‘নবান্ন’ নামটি এখনকার মতো প্রশাসনিক ভারী হয়ে ওঠেনি। নাটকটা যতদূর মনে পড়ছে, বিজন ভট্টাচার্যর লেখা ‘হাঁসখালির হাঁস’। সেই নাটকটা হবে ‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা’ নামে একটা হলে, যেখানে ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের মিটিং হয়। আমি ঢুকে পড়লাম নাটক দেখতে। বলা বাহুল্য, নবারুণকেও দেখলাম।

এর কয়েক মাস পর এক বিকেলে খালাসিটোলায় বন্ধুর সঙ্গে বসে আছি, দেখি দুটো টেবিল পরেই নবারুণ ভট্টাচার্য, সঙ্গে আরও দুই জন। আমার তখনও পর্যন্ত ধারণা ছিল, বামপন্থীরা এবং নকশালরা প্রকাশ্যে মদ খান না, এ-ব্যাপারে তাঁরা শরিয়তিদের মতোই পর্দা প্রথার অনুসারী। আমি বন্ধুকে বললাম, “মনে হচ্ছে উনি নবারুণ ভট্টাচার্য, আমি ওর নাটক দেখেছি, কবিতার বইটাও বেশ ভালো লেগেছে।" বন্ধু বলল, “যা গিয়ে কথা বল।” কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন এল, যে, উনি কি সত্যিই নবারুণ ভট্টাচার্য? না কি ওঁরই মতো দেখতে আর কেউ। সেদিন আর কথা হলো না।

আরও পড়ুন: বাংলার প্রথম দলিত বিদ্রোহ ও এক ভুলে যাওয়া সংগ্রামী লেখক

এর বছরখানেক পর এক সন্ধেয় ভবানীপুরের তৃপ্তি বারে ঢুকেছি এক বন্ধুর সঙ্গে, বারের ভেতরটা এমনিতেই একটু অন্ধকার-মতো, ওখানে আছে এক বিরাট আয়না। সেই আয়নার সামনের টেবিলে দেখি নবারুণদা বসে আছেন, একা। এবারও আমার মনে একই প্রশ্ন, উনি কি নবারুণ ভট্টাচার্য? না, এবারও ওঁর সঙ্গে কথা হলো না।

সেটা ১৯৯০ সাল, গরমকাল। প্রচণ্ড রোদ। দুপুরবেলা কলকাতায় 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকার অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি নবারুণ ভট্টাচার্যর হাতে একটা হ্যান্ডমাইক, কাঁধের স্ট্র্যাপে ব্যাটারি ঝোলানো। ততদিনে আমি নিশ্চিত যে, উনিই নবারুণ ভট্টাচার্ধ। ওর সঙ্গে দু'জন আছেন। উনি বক্তব্য রাখছেন 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। উনি 'সোভিয়েত দেশ' পত্রিকায় চাকরি করতেন। কর্তৃপক্ষ ওঁদের ২/৩ জনকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করেছেন। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙছে, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ইত্যাদি ৬টা রিপাবলিক ভেঙে বেরিয়ে গেছে। আমরা বুঝতে পারছি, সমাজতন্ত্রের এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর থাকবে না। নবারুণদা বক্তব্য রাখছেন, কিন্তু কোনও শ্রোতা নেই। উলটোদিকের ফুটপাতে দাড়িয়ে আমি ওঁর বক্তব্য শুনছি।

Nabarun Bhattacharya

তাঁর অঙ্গুঠাছাপে ভাষার মধ্যে ফাটত আরডিএক্স

ফুটপাতে একটা ছোট স্পেসের মধ্যে উনি একবার ডান দিক থেকে বাঁদিকে যাচ্ছেন আর বাঁদিক থেকে ডানদিকে যাচ্ছেন। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, মানুষ যাচ্ছে, আর তার মাঝে নবারুণদার ওই হাঁটা আর বক্তব্য রাখাকে আমার মনে হচ্ছে একটা পারফরম্যান্স। সেবারও আমি নবারুণদার সঙ্গে আলাপ করে উঠতে পারিনি।

২০১২-র জুন মাস সেটা। ২৯ বছর পর নবারুণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে আলাপ হলো। যখন কিউ আর আমি ওঁকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারির কথা ভাবলাম। আজ ভাবলে অবাক লাগে আমার প্রিয় কবি ও গদ্যকারকে ২৯ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় দেখার পর অবশেষে তার সঙ্গে আলাপ হলো।

নবারুণ নিজেকে কম্যুনিস্ট বলে মনে করতেন, আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “কমিউনিস্টরা আপনাকে অ্যাকসেপ্ট করে?” আমার এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন “করে না তো।" বললাম, “আমি তো আপনাকে একজন অ্যানার্কিস্ট লেখক বলেই মনে করি।” উনি বললেন, “আমি অবশ্য তা মনে করি না।” কথা এগিয়েছিল প্রুধোঁ, বাকুনিন, ট্রটস্কি নিয়ে, তবে তর্ক আর এগোয়নি।

Q Nabarun Scene

কিউ-র 'নবারুণ' ছবির একটি দৃশ্য

তর্ক যাই-ই হোক না কেন, মানতেই হবে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে কতিপয় লেখক তাদের লেখায় ভাষা-সন্ত্রাস ছড়িয়েছেন, ভাষা-সন্ত্রাসে বাংলা সাহিত্যের সাজানো ড্রয়িংরুমটি তছনছ করেছেন, নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম। সাধারণত, বাংলা গল্প-উপন্যাসে যে খোকা গদ্যভাষার কলকাকলি চলে, নবারুণের অঙ্গুঠাছাপ দেওয়া ভাষাটি তার ওপর আরডিএক্স-এর মতো ফেটে পড়ে। এই চেষ্টা যে গদ্যলেখকরা আগে করেছেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, মলয় রায়চৌধুরী, সুবিমল মিশ্র বা কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের কথা, আরও অনেকে আছেন, কিন্তু তাঁরা নবারুণের মতো জনপ্রিয়তা পাননি।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি আর অ্যানথ্রোপসেন্ট্রিক নই।" শুধু মানুষই সব, আর বাকি যা আছে, সেগুলো কিছু নয়, মানে প্রাণী বা ঈশ্বর- এই একবগ্গা মার্কসবাদী তত্ত্ব থেকে সরে এসেছিলেন নবারুণ। তাই তাঁর ‘লুব্ধক' উপন্যাসে শহর শাসন করে কুকুররা। ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাসে উড়ে আসে দণ্ডবায়স বা দাঁড়কাক। ছোটগল্পের শিরোনাম হয়ে ওঠে ‘অন্ধবেড়াল’। ‘বেবি কে’ উপন্যাসে পাঁচিলের ওপর বসে থাকে বিরাট কালো রাজহাঁস। বন্ধু পীযুষ ভট্টাচার্যর উপন্যাসের প্রয়োজনে উট সম্পর্কে যাবতীয় গবেষণা নিজ দায়িত্বে করেন। তাঁর লেখায় এমন মানুষ আসে, যে উড়তে পারে বা এমন মেয়েমানুষ, যে পেট্রোল খেয়ে বেঁচে থাকে।

জীবনের নানা অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, গোপন পগারপাঁচিল টপকে এগোতে গিয়ে নবারুণ ফাঁদে পড়েছিলেন অ্যালকোহলিজমের, নিজেই ফাঁদ কেটে বেরিয়েছেন, আঙুলে মুনস্টোন, গ্রহরত্ন ধারণ করেছেন, আবার খুলেও ফেলেছেন। ২০১৪-র জুলাইয়ের প্রথমে বিশ্বকাপ ফুটবলের মরশুমে ওর গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম হাতের কবজিতে বাঁধা বিপত্তারিণীর লাল সুতো। তন্ত্র সম্পর্কে খুব আগ্রহ। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তন্ত্র পরিচয়' বইটি অনেকদিন পর ছাপা হওয়ায় কিনেছি জানাতে, আমার কাছে পড়তে চাইলেন। ওই বছরই ফেব্রুয়ারিতে ওঁর ফ্ল্যাটের মেঝেতে মার্বেল বসানো হচ্ছে দেখে মুচকি হেসে বললাম, “কী হচ্ছে এসব?” নবারুণ হো হো করে হেসে বললেন, “আই থিংক লেফট আ্যান্ড লিভ রাইট।”

কমিউনিস্ট নবারুণকে চট করে মেপে ফেলা যাবে না বঙ্গীয় মার্কসবাদের মলিন ও শতচ্ছিন্ন দর্জি-ফিতে দিয়ে, উনি এই মাপকাঠির বাইরে বাঁচেন। ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথার মাঝে অবধারিত খিস্তি, ওঁর মতে ওটাও মানুষের তৈরি ভাষা, ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মান্য বাংলা ভাষা নিয়ে রাগ ছিল তাঁর। নবারুণ বলেন, ভাষাকে রক্তহীন, অযৌন, প্লাস্টিকগন্ধী ও ঢ্যামনা করে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছেই। আমাদের কাজ হল এই সব সচেষ্টদের বাংলা মতে ক্যালানো। আগে তেরপল চাপা, তার পর খেটো বাঁশ।

ঋত্বিক ঘটকের ওপর নবারুণের তীব্র অভিমান। কারণ উনি ‘যুক্তি তকো গপ্পো’-র শুটিং চলাকালীন নবারুণকে বলেছিলেন, “দ্যাখো বাবা, আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না, আর মাত্র তিনটি ছবি করে যাব।” ঋত্বিকের পক্ষে এই কথা রাখা সম্ভব হয়নি, কিন্ত নবারুণ মনে করেন যে, ঋত্বিক ইচ্ছে করে কথা রাখেননি।

বেশ কয়েক বছর আগের এক বিকেলে ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার বা লোকমুখে জগুবাবুর বাজারের দোতলায় ৭৯ বছরের পুরনো পানশালা 'তৃপ্তি বার'-এর ভেতর বিরাট আয়নার সামনের টেবিলে আমরা বসেছিলাম। একথা-সেকথার পর হঠাৎ আয়নাটা দেখিয়ে নবারুণ বলেছিলেন, “এই যে আয়নাটা দেখছিস, এই আয়নাটা কাকে কাকে দেখেছে জানিস? শোন তা হলে, ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, হরিসাধন দাশগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এঁরা সব এই আয়নাটার ভেতর ঢুকে গেছেন, একদিন আমিও ঢুকে যাব।"

আমি মনে করি, নবারুণ ছিলেন ভাবনায়, ব্যবহারে, জীবনযাপনে একজন অ্যানার্কিস্ট লেখক, কিন্তু উনি নিজেকে একজন কমিউনিস্ট মনে করতেন। আমাদের এই তর্ক অমীমাংসিত থেকে গেল।

More Articles