সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হওয়া বিপ্লবী সঞ্জয় ঘোষ আজও নায়ক অসমে

১২ বছর কেটে যায়। সঞ্জয়ের খোঁজ নেই। ২০০৯ ফেব্রুয়ারিতে ‘ডেকান হেরাল্ড’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়, যে, স্থানীয় আলফা ক্যাডাররা ‘গ্রেপ্তার'-এর পর ওপরতলার নেতার হুকুম আসার আগেই সঞ্জয়কে হত্যা করে দেহ ব্রহ্মপুত...

মাজুলি

এই দ্বীপটি উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যের  ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অবস্থিত। দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদী ও উত্তরে শোবনশিরি নদীর মিলনে এই দ্বীপের সৃষ্টি।  বিশ শতকের শুরুর দিকে এর আয়তন ছিল প্রায় ৮৮০ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তাল জলস্রোতের ফলে এই দ্বীপের ব্যাপক ভূমিক্ষয় হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৩৮০ বর্গ কিলোমিটার। এই ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরেও মাজুলি দ্বীপ, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই দ্বীপটি ভারতের সর্বপ্রথম দ্বীপ, যেটি ২০১৬ সালে একটি জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

মাজুলি দ্বীপকে বৈষ্ণব সংস্কৃতির মুখ্য কেন্দ্র এবং অসমের সাংস্কৃতিক রাজধানীও বলা যায়। এখানকার মানুষরা মূলত বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের, মাজুলির তাঁত শিল্পও বিখ্যাত। এছাড়াও এই দ্বীপ মন্দিরনগরী নামেও খ্যাত। বর্তমানে এখানে ২২টি সত্র বা মন্দির রয়েছে। জোড়হাট শহর থেকে জলপথে মাজুলিতে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে, সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট।  রাজধানী গুয়াহাটি থেকে দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। দ্বীপটি এখন অসম রাজ্যের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট।

কী ঘটেছিল ২৫ বছর আগে

সঞ্জয় ঘোষ, মুম্বইয়ের এক যুবক, অ্যাসোসিয়েশন অফ ভলান্টারি এজেন্সিজ ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যোগ দিয়ে মাজুলিতে গ্রামোন্নয়নের কাজ করতেন। ৪ জুলাই, ১৯৯৭ সঞ্জয়কে অপহরণ করে আলফা নামে ওই রাজ্যের সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাদের দাবি মুক্ত ও স্বতন্ত্র অসম।  আলফার দাবি ছিল, সঞ্জয় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট, এসেছে আলফার খবর ‘র’-এর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, তাই তারা সঞ্জয়কে ‘গ্রেপ্তার’ করেছে। ‘গ্রেপ্তার’-এর কিছুদিন আগে থেকে সঞ্জয় ‘র’- এর এজেন্ট- এই মর্মে পোস্টার দেওয়া শুরু করে আলফা। মাজুলির পুলিশ সঞ্জয়কে নিরাপত্তারক্ষী নিতে বলায়, সঞ্জয় সেই প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল ‘স্থানীয় মানুষই একমাত্র আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারে।'

আরও পড়ুন: উত্তমকুমারের পায়রা ওড়ানো ও কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি 

কে এই সঞ্জয় ঘোষ?

সঞ্জয়ের পরিবারটি হাই প্রোফাইল হলেও সঞ্জয় নিজে খুবই মাটির কাছাকাছি ছিলেন। নয়ের দশকে সঞ্জয়ের কাকা ভাস্কর ঘোষ ছিলেন কেন্দ্রীয় দূরদর্শনের ডিরেক্টর জেনারেল। পিসি অরুন্ধতী ঘোষ নয়ের দশকে রাষ্ট্রসংঘে ভারতের কূটনৈতিক প্রতিনিধি। কাকিমা রুমা পাল সেই সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। মুম্বইবাসী সঞ্জয় এলফিনস্টোন কলেজ থেকে গ্রামোন্নোয়ন আর আইনে স্নাতক হয়ে অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যানি কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৮৬ সালে চলে যান রাজস্থানের বিকানির জেলার লুনকরানসার গ্রামে ‘উরমুল’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। কাজ করতে করতে বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত আমেরিকান জন হপকিন্স কলেজে স্কলারশিপ পেয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়তে যান।  ফিরে এসে লুনকরানসারে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এতটাই সুখ্যাতি অর্জন করেন যে, অচিরেই ‘উরমুল’ একটি বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সেসময় সঞ্জয় একটি সংবাদপত্রে ‘ভিলেজ ভয়েস’ শিরোনামে একটি কলম লিখতেন, যা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে সঞ্জয় যোগ্য উত্তরসূরির হাতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে দিল্লি চলে যান। সাধারণত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমৃত্যু সেই পদে থেকে যান, সেদিক থেকে সঞ্জয়ের সিদ্ধান্ত বৈপ্লবিক।  দিল্লিতে সঞ্জয় ‘চরকা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন, যে কাগজের কাজ ছিল গ্রাম ভারতের কণ্ঠস্বর মূল স্রোতের জাতীয় গণমাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া। এহেন সঞ্জয় ১৯৯৬ সালে ৭ সহকর্মীর সঙ্গে (এঁদের মধ্যে স্ত্রী সুমিতাও ছিলেন) আলফা-অধ্যুষিত মাজুলি দ্বীপে গ্রামোন্নোয়নের কাজে যোগ দেন। সেখানে গিয়ে দেখেন গত ২০ বছরে মাজুলির ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। সঞ্জয়রা স্থানীয় মানুষদের স্বেচ্ছাশ্রমে দ্বীপটির ১.৭ কিলোমিটার পাড় পরিবেশসম্মতভাবে বাঁধিয়ে ফেলেন। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ, হস্তশিল্প ও তাঁতশিল্পকে চাঙা করে সেটিকে স্থানীয়দের রোজগার প্রকল্প হিসেবে চালু করা, লাইব্রেরি গড়ে তোলা আর স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা– সব মিলিয়ে মাত্র ১ বছরে সঞ্জয়রা একটা ছোটখাটো বিপ্লবই করে ফেলেছিলেন সেখানে। পাড় বাঁধিয়ে ফেলায় আলফা স্পনসরড ঠিকাদারদের বছরওয়াড়ি বোল্ডার ফেলে টাকা কামানোর রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। আলফা ক্রুদ্ধ হয়। এছাড়া আলফা সেখানে জনপ্রিয়তা হারচ্ছিল।  গ্রেপ্তারের ১৮ দিন পর ২২ জুলাই আলফা জানায় যে, ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকোডুবি হয়ে সঞ্জয়ের মৃত্যু হয়েছে।                        

মানবাধিকারের প্রশ্ন

আলফার এই অপহরণ তথা গ্রেপ্তারকে সেই সময় দেশজুড়ে মানবাধিকার কর্মীরা নিন্দা করেছিলেন।  ভারতের প্রথম সারির মানবাধিকার সংগঠক ও আইনজীবী কে.জি. কান্নাভিরন জানিয়েছিলেন যে, সঞ্জয় ঘোষ কিছুতেই 'র'-এর এজেন্ট হতে পারেন না। সঞ্জয়ের মুক্তির জন্য বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী কুলদীপ নায়ার সরকার পক্ষের হয়ে আলফার সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে রাজি হয়েছিলেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সঞ্জয়ের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে বলে যে, আলফা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। সিটিজেন ফর ডেমোক্রেসি-র উপদেষ্টা এস স্বামীনাথন ও চেয়ারম্যান এস সুব্রহ্মনিয়ম-সহ ভারতের ২০টি মানবাধিকার সংগঠন আলফার কাছে সঞ্জয়ের মুক্তির আবেদন রেখেছিল। ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-ও আলফার কাছে সঞ্জয়ের মুক্তি প্রার্থনা করে। বিহারের গণজাগরণ কেন্দ্র, কলকাতার সংলাপ ও এই রাজ্যের ৬১ জন বুদ্ধিজীবী সঞ্জয়ের মুক্তির জন্য আবেদন করে। দলাই লামাও এই আবেদনে শামিল হন। মাজুলির মানুষ সঞ্জয়কে এতই ভালবাসতেন যে, ৪ যুবক আলফার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন, তাদের 'গ্রেপ্তার' করে সঞ্জয়কে মুক্তি দেওয়া হোক।যদিও আমাদের বাংলার অগ্রণী মানবাধিকার সংগঠনটি (এপিডিআর)  সঞ্জয়ের অপহরণের বিষয়ে হিরণ্ময় নীরবতা পালন করেছিল, প্রসঙ্গত, সংগঠনটি এবছর ৫০ বছর পূর্তি পালন করছে।        

এক যুগ পরে

১২ বছর কেটে যায়। সঞ্জয়ের খোঁজ নেই। ২০০৯ ফেব্রুয়ারিতে ‘ডেকান হেরাল্ড’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়, যে, স্থানীয় আলফা ক্যাডাররা ‘গ্রেপ্তার'-এর পর ওপরতলার নেতার হুকুম আসার আগেই সঞ্জয়কে হত্যা করে দেহ ব্রহ্মপুত্রে ফেলে দেয়। ওই বছরই নভেম্বরে আলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া ঢাকায় প্রেপ্তার হন। ২০১১-র জানুয়ারিতে জামিনে ছাড়া পেয়ে অরবিন্দ প্রকাশ্যে সঞ্জয়ের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।

রাষ্ট্রীয় হিংসা

আলফার ‘স্বাধীন অসম’-এর স্বপ্নটির মৃত্যু হয়েছে।  আলফার প্রতিষ্ঠাতা পরেশ বড়ুয়াকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ গগৈ জামিনে মুক্ত আছেন ভারতে আর সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ভারত রাষ্ট্রের হেফাজতে বন্দি আছেন। আলফার হাতে 'গ্রেপ্তার' হওয়া অবস্থায় সঞ্জয়ের মৃত্যুকে আমি হবু রাষ্ট্রের হেফাজতে মৃত্যুই বলব, অতিবিপ্লবী আলফা স্বপ্ন দেখেছিল একদিন স্বাধীন অসম রাষ্ট্রটির তারা মালিক হবে। সেই হবু রাষ্ট্রটির অতিবিপ্লবী অধিকারীরা এক বিপ্লবীকে নিজেদের হেফাজতে খুন করে রাষ্ট্রচরিত্র গঠনের দিকে এক পা এগিয়ে গিয়েছিল।   

বই আর সিনেমা

১৯৯৮ সালে সঞ্জয়ের মাজুলি দ্বীপের অভিজ্ঞতা নিয়ে 'সঞ্জয়'জ আসাম ডায়ারিজ' প্রকাশ করে পেঙ্গুইন।৩৭ বছরে শেষ হয়ে যাওয়া সঞ্জয়ের জীবন ও কাজ নিয়ে একটি দ্বিভাষিক (অসমিয়া ও হিন্দি) কাহিনিচিত্রও তৈরি হয়েছে, নাম 'অ্যাজ দ্য রিভার ফ্লোজ', পরিচালক বিদ্যুৎ কাকতি।  ফিল্মটি ওয়াশিংটনে সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দু'টি পুরস্কারও পেয়েছে।

শোনা কথা

২০১৭ সালে একটি কাজে মাসখানেকের জন্য গোয়া যেতে হয়েছিল। সেখানে প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়, যে কর্মসূত্রে গোয়ায় থাকলেও, যার বাড়ি অসমের জোড়হাটে, তার পরিবারটিরও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। নিয়মিত আড্ডায় একদিন সঞ্জয় ঘোষের কথা ওঠে। যুবকটি জানায় যে, সে শুনেছে আলফার যে দু'জন ক্যাডার সঞ্জয়কে অপহরণ করেছিল, তারা মাদকাসক্ত ছিল। দু'দিন ধরে সঞ্জয়কে পাহারা দেওয়ায় তাদের স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। তারা অধৈর্য হয়ে ওপরতলার নির্দেশ আসার আগেই সঞ্জয়কে হত্যা করে। জোড়হাটের যুবকটি আরও জানায়, মাজুলির তাঁতশিল্পীরা এখন ভারতের বিখ্যাত একটি এথনিক ব্র্যান্ডের কোম্পানিকে বস্ত্র সরবরাহ করে।  মাজুলির ছন্নছাড়া অর্থনীতি এখন অনেকটাই গোছানো। সঞ্জয়ের প্রতিষ্ঠিত ‘উরমুল’ ও ‘চরকা’ এখন বৃহৎ পরিসরে কাজ করে। তাঁর স্মৃতিতে একটি ওয়েবসাইটও তৈরি হয়েছে। ‘চরকা’ প্রতি বছর ‘সঞ্জয় ঘোষ রুরাল রিপোটিং অ্যাওয়ার্ড দেয় একজন গ্রামীণ সাংবাদিককে।   

More Articles