পৃথিবীর প্রাচীনতম ফ্লাইওভার এই শহরে, ভবঘুরের ঠিকানা ফ্লোরেন্স
ভাসারির দু'পাশ সারারাত মাতিয়ে রাখে নাম না-জানা মিউজিসিয়ান, কোনও অন্ধ বাদ্যযন্ত্রী আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গানবাজনার দল। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার এই শহরে কিন্তু অসংখ্য ভবঘুরের যাতায়াত।
আভিজাত্যর ধারাপাতে আমার মন ছিল না কখনও। সেই কারণে শহর আমাকে তেমন স্বস্তি দেয়নি। যখনই কোনও দেশ থেকে অন্য দেশে বা শহর থেকে অন্য শহরে গিয়েছি, তখন হাইওয়ে পরিহার করে গ্রাম শহরতলির ঘুরপথে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তার বড় কারণ হলো চোখের শান্তি, মনের আরাম। তবে তার ব্যতিক্রমও আছে। এমন শহরে গিয়েছি, যা গোটাটাই ছবি। বলা যেতে পারে, শিল্প দিয়ে মোড়ানো। আমার দেখা এমন অন্যতম শহর হলো ফ্লোরেন্স। এই বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর। যে শহর ব্যবসা ও মেধার চাঞ্চল্যকর উপস্থিতিতে সমুজ্জ্বল শতকের পর শতক। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, দান্তে থেকে ম্যাকিয়াভেলি, গ্যালিলিও আর মেডিসি পরিবারের শাসক বৃন্দের ধূলিস্বপ্নস্মৃতি-বিজড়িত এই শহর নবজাগরণের শহর। হ্যাঁ, রেনেসাঁর পীঠস্থান ফ্লরেন্স। মধ্যযুগের এই শহরের শরীর ধরে বয়ে চলেছে আরনো নদী। আরনো নদীর ওপর আছে পৃথিবীর প্রাচীনতম ফ্লাইওভার (নাকি ওয়াকওভার!), যার নাম ভাসারি করিডর।
ভাসারির দু'পাশ সারারাত মাতিয়ে রাখে নাম না-জানা মিউজিসিয়ান, কোনও অন্ধ বাদ্যযন্ত্রী আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গানবাজনার দল। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার এই শহরে কিন্তু অসংখ্য ভবঘুরের যাতায়াত। আশ্চর্যের কথা হলো, খাদ্য-খাবার, থাকা-শোয়ার জায়গা এখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এই হোবোরা, ভবঘুরেরা আর ভ্রাম্যমান কম পয়সার পর্যটকরা ঠিক থেকে যাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরের পুরনো আঁকাবাঁকা রোমান গলিপথের খাঁজে, বাইলেনের অন্ধ বিশালাকার তোরণের পিছনে কিংবা আরনো নদীর পার বরাবর নানা আলোআঁধারির চিত্রিত ভাষা। এখানে জানিয়ে রাখি, হোবোরা হলো এক বিশেষ ধরনের ট্র্যাম্প। ট্র্যাম্পরা সাধারণত কর্মবিমুখ হয়। কিন্তু এরা কাজ করে, আবার স্বাধীন জীবনের মুক্ত বিহঙ্গ। হোবোরা মূলত উত্তর আমেরিকার মানুষ। অর্থনৈতিক বিপর্যয় সম্ভবত এদের ভ্রাম্যমান করেছে।
তো এমনই এক হোবো জনাথনের সঙ্গে আলাপ হয় রাতের ফ্লোরেন্সে। একটা ছোটখাটো কম পয়সার কফি ঠেকে। সে এখানে ক'দিন থাকবে। তারপর আবার কোথাও চলে যাবে।
আরও পড়ুন: বইমেলা থেকে নিষিদ্ধপল্লি- সব একাকার ছিল কলেজস্ট্রিটের এই আড্ডায়
ফ্লোরেন্সে সে মাঝেমধ্যেই আসে। তার কথা অনুযায়ী, এই শহরের চিত্রিত শিল্প তাকে বিষণ্ণ পৃথিবী থেকে পরিত্রাণ দেয়। বললাম, এখানে তো অনেক খরচ করে থাকতে হয়। তার বক্তব্য হলো, "খরচের বিষয়টা সম্পূর্ণতই ব্যক্তিগত। তুমি কি চাইছ, তার ওপর খরচ। কিন্তু তুমি যদি তোমার চাওয়াকে একটা পরিমিত স্তরে বেঁধে রাখতে পারো, তবে সবটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।" জনাথন কিঞ্চিৎ দার্শনিক ভাব নিয়ে আরও বলে, "আসলে কাজ করা আর খাওয়া হচ্ছে কঠিনতম দুই কাজ। খাদ্যটা যদি নিজেকে বানাতে হয় তাহলে তো আরো পরিশ্রম।" সত্যি বলতে কি, এরকম কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। কর্মবিমুখ যারা, তারাও কখনও সরাসরি কাজ ফাঁকি দেওয়ার কথা বলে না। তবে খাওয়াদাওয়া করা যে পরিশ্রমের কাজ, তা আমি অনেকদিন ধরে মনে করে আসছি এবং নিজেকে স্বল্পাহারী রেখেছি বহুদিন যাবৎ। সে যাক গে! তবে জনাথন এখানে বাবুদের বাড়ির বাগানের তত্ত্বাবধান করে আর একফালি ঘরে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। তারপর পথই কি গন্তব্য?
সেকথা আর জানা হয়নি। তবে রাতবেরাতে কখনও নদীর পারে নির্জনে, কখনও ভাসারি করিডরের কোলাহলে বা পাশের পাড়ার বাগানবাড়ির মনোরম পরিবেশে ওর সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে বারে বারেই মনে হয়েছে যে, জোনাথনের মতো ভবঘুরেকেও কোথাও যেন কাবু করে দিয়েছেন মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো। অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় সে মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর বিভিন্ন কাজকে ব্যাখা করেছিল সেসময়।
এবার বলি বাগানবাড়ির কথা। কাসা বুনারত্তি হলো মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর বাড়ি, অধুনা মিউজিয়াম। নদীর ধারে একটু উঁচু জায়গায়, একটা হিলকের ওপর, বিস্তীর্ণ জমির মাঝে এই মহান শিল্পীর বাড়ি। আমরা একটা নিভৃত পরিসর খুঁজে আলোছায়ামাখা গাছের তলায় বসতাম। ফ্লোরেন্স আসলে ইতিহাসের ছোঁয়ায় প্রাচীন আবহের শহর এখানে আছে মেডিসিদের প্রাসাদ। সেও দেখার মতো, সে প্রাসাদের বাগান আর মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর কাজ! মেডিসি রাজপরিবার ছিল মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর প্রথম পৃষ্ঠপোষক। এই রাজবংশের অন্যতম অবদান হলো এই পৃথিবীতে প্রথম ব্যাঙ্কিং পরিষেবা চালু করা। আর একটি প্রাসাদ হলো ওফিজি। তার ৪৫টা ঘর নিয়ে আছে একটি গ্যালারি। এ হলো ১৫৯১-এ স্থাপিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মিউজিয়াম।
এক বান্ধবীর প্রায় দেড়হাজার বছরের পুরনো একটি বাড়ি ছিল আমার ঠিকানা। ক্লডিয়ার সঙ্গে কোনও এক পথে-বিপথে, লম্বা ড্রাইভে আলাপ। সে মূলত পড়াশোনা করেছে আর্কিটেকচার নিয়ে। কিন্তু সেই কাজ ছেড়ে যোগ শিখতে শুরু করে। পরবর্তীতে এখন একজন যোগ শিক্ষিকা। অসম্ভব সংযমী জীবন তার। সে শুধু ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। বাড়িটি তার পারিবারিক সম্পত্তি। কোনও মন্ত্রী মোসাহেবের বাড়ি ছিল বলে মনে হয়। অসাধারণ তার স্থাপত্য ও রক্ষণাবেক্ষণ। জানলা দিয়ে নদী দেখা যায় নানা উচ্চতা থেকে।
এই শহরে দিনরাত এক হয়ে যায় নানা শিল্পকর্ম দেখে আর চুটিয়ে আড্ডা মেরে। রেতের বেলা রাস্তায় রাস্তায় গান-নাচ আর খানাপিনা। এই ব্যয়বহুল শহরে পর্যটকদের ভিড় থাকে ভালো। এখানে গহনার দোকানে খুব রমরমা। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এখানে গয়না কিনতে আসে। দেখা পাওয়া যায় বেশ কিছু বাঙালি কারিগরের। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সংখায় বেশি। এই তোস্কানা অঞ্চলে (যে জেলায় ফ্লোরেন্স অবস্থিত) বহুবার গিয়েছি ছবি দেখাতে। অসাধারণ সমস্ত পরিত্যক্ত চার্চ। যেগুলো এখন নানা ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার হয়।
সেই অনুষ্ঠান নিয়ে পরবর্তী কোনও পর্বে আলাদা কোরে লেখার ইচ্ছে আছে। মনে রাখতে হবে, এই বিস্তীর্ণ ভান্ডার শুধুমাত্র ফ্লোরেন্সেই পৌনে চার লক্ষ মানুষ থাকে। তাদের নানা সংস্কৃতির সমাহার। তার কাহিনিও অনেক।