বয়স বাড়লেও অবসর নেই, আর কত পিছিয়ে পড়বে ভারতীয় ক্রিকেট?

এ-বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে?

অ্যালাস্টেয়ার কুককে নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আছে। টেস্ট ক্রিকেটে বারো হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারকে এমনিতেই কোনও ক্রিকেটপ্রেমী ভোলেন না। তার ওপর কুক জীবনের প্রথম এবং শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই, আর দুটোতেই তিন অঙ্কের রান করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে ভারতের অভিশপ্ত ইংল্যান্ড সফরের সময়ে এজবাস্টন টেস্টে ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোরেও (২৯৪) পৌঁছন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলা কুক এখনও দাপটে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। এই মরশুমে এসেক্সের এই ওপেনারের গড় এখন ৬০। পাঁচটা ম্যাচেই তিনটে শতরান করে ফেলেছেন এবং দুই দশকব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কেরিয়ারে আগে কখনও যা পারেননি, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন গত ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছেন।

 

এদিকে কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। জো রুটের কাছে ইংল্যান্ডের কর্মকর্তা, ক্রিকেটপ্রেমী– সকলেরই বিরাট আশা ছিল। কিন্তু ব্যাটার হিসাবে যথেষ্ট সফল হলেও অধিনায়ক হিসেবে রুট একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। গত আঠারোটা টেস্টের মধ্যে মাত্র একটা জিতেছে ইংল্যান্ড। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যে কারণে ইংল্যান্ডের এমন হাঁড়ির হাল, তার অন্যতম হল ওপেনারদের ব্যর্থতা। কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে অনেককে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। কুক ইতিমধ্যে স্যর অ্যালাস্টেয়ার কুক হয়ে গেছেন। মানে, ক্রিকেট মাঠে তাঁর কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রানি এলিজাবেথ। জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি খোলনলচে বদলে ফেলেছে। নতুন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কি, নতুন টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস আর টেস্ট দলের কোচের দায়িত্বে এসেছেন ব্র‍্যান্ডন ম্যাককালাম। দেশটার নাম ভারত হলে এতদিনে হাউস অফ কমনসে সব দলের সাংসদরা মিলে রেজোলিউশন পাস করাতেন, নতুন অধিনায়ক আর কোচকে কুককে অবসর ভেঙে ফিরে আসতে বলতেই হবে। কুক নিজেও শতমুখে সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াতেন, তিনি এখনও দারুণ ফিট এবং জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন।

 

কিন্তু দেশটার নাম ইংল্যান্ড। কয়েকদিন আগে কুককে এক সাক্ষাৎকারে রব কি-র নিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ভালোই তো। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের এখন একেবারে নতুন করে শুরু করা উচিত। নিজের সম্পর্কে কোনও কথাই বলেননি। বরং বলেই দিলেন যে, পুরনো সবকিছু ভুলে এগোনো উচিত।

 

আরও পড়ুন: ক্রিকেটের লুপ্তপ্রায় সৌন্দর্যের নাম উমরান

 

স্নেহময় জ্যাঠামশাইরা পরীক্ষায় ফেল করা ভাইপোদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য এরকম বলতেন। তা কুকজেঠুর বয়স কত? সাঁয়ত্রিশ বছর চার মাস। চলতি আইপিএলে গত ম্যাচটা (তা-ও বিপক্ষের দ্রুততম বোলার লোকি ফার্গুসন কোনও অজ্ঞাত কারণে বল করতে এলেন বিরাট আর ফ্যাফ দু প্লেসি সেট হয়ে যাওয়ার পর এবং মাত্র দু'-ওভার বল করলেন) বাদ দিলে চূড়ান্ত ব্যর্থ (তিনটে ম্যাচে প্রথম বলে আউট; ১৪ ম্যাচে ৩০৯ রান, গড় ২৩.৭৬) বিরাট কোহলির বয়স কত? সাড়ে তেত্রিশ। অর্থাৎ, কুক বিরাটের বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর এখনকার ফর্ম দেখে মনে করা অমূলক নয় যে, অবসর না নিলে তিনি এতদিনে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট ক্রিকেটে মোট রানের রেকর্ড (১৫,৯২১) আর সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড (২০০)– দুটোরই কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। অথচ এখন কনিষ্ঠরা পারছে না দেখেও ফিরে আসার নাম করছেন না। বোর্ডও এখনও পর্যন্ত তাঁর নাম করেনি। ভক্তরা কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় কুকের নাম ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছেন না। এদিকে বিরাটকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক– অনেকেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি নাকি একটানা অনেকদিন খেলে ফেলেছেন, ক'দিন বিশ্রাম নিলেই হইহই করে রানে ফিরবেন। বিরাটও গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের আগে আইপিএল-এর সরাসরি সম্প্রচারকারী সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বললেন তাঁর ওপর দিয়ে সত্যিই অনেক ধকল গেছে, তাই বিশ্রাম নিলে ভালোই হয়। মজার কথা, বিশ্রাম নেওয়া যে প্রয়োজন, সেটা তাঁর আইপিএল-এর শেষ লগ্নে এসে খেয়াল হল। বিরাট মনে করেন, আমাদের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট রবি শাস্ত্রীর চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর নেই। তিনি শুধু বিরাটকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেননি, বলেছেন বিশ্রামের পর বিরাট আরও ছ'-বছর খেলতে পারে। অর্থাৎ, কুক যে বয়সে ফর্মে থেকেও জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকা উপভোগ করছেন, বিরাট সেই বয়সেও খেলে যাবেন। অথচ বিরাটের ফর্ম কিন্তু এবারের আইপিএল-এ হঠাৎ উধাও হয়েছে এমন নয়। কোনও ধরনের ক্রিকেটেই তিনি তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না অনেকগুলো বছর হয়ে গেল।

 

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে শুরু করার কাজটা আগেই করেছে, কারণ আইসিসি টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। শাস্ত্রীর জায়গায় এসেছেন রাহুল দ্রাবিড় আর সাদা বলের অধিনায়ক করা হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। বিরাট টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়া অন্যগুলোর লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, বোর্ড সে গুড়ে বালি দিয়ে পরে টেস্ট ক্রিকেটেও রোহিতকেই নেতা করে দিয়েছে। তা রোহিতের বয়স কত? পঁয়ত্রিশ। টেস্ট ক্রিকেট কোনওদিনই রোহিতের সেরা মঞ্চ ছিল না। ন'-বছর আগে টেস্টে অভিষেক হলেও এতদিনে মোটে পঁয়তাল্লিশটা টেস্ট খেলেছেন, শতরান মাত্র আটটা। বিদেশে প্রথম শতরান পেলেন গত ইংল্যান্ড সফরে। তিনি আসলে সাদা বলের যম। অথচ গত ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে বিরাটের পাশাপাশি তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার আইপিএলেও মোটেই রানের মধ্যে নেই (১৩ ম্যাচে ২৪৮ রান; গড় ২০.৪৬)। একাধিকবার আইপিএল খেতাবজয়ী মুম্বই ইন্ডিয়ানস যে এবার পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলায় পড়ে আছে, তার অন্যতম কারণ রোহিতের খারাপ ফর্ম।

 

এ-বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে? উপরন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাটকে দীর্ঘদিন ধরে টি-টোয়েন্টির উপযোগী দেখাচ্ছে না। তিনি ইদানীং এত সাবধানে ব্যাট করছেন (বৃহস্পতিবার গুজরাত টাইটানস-এর বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৭৩ রান করার আগে অব্দি স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৩.৪৬), যে তিনি বড় রান করলে দলের মোট রান ভালো জায়গায় পৌঁছনো শক্ত। অথচ এই দুই তারকা থাকতে ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, রাহুল ত্রিপাঠী, রাহুল টেওটিয়াদের মতো বড় শট নিতে পারা ব্যাটারদের দলে জায়গা হবে না।

 

তবে ভারতীয় ক্রিকেট যে ভারত দেশটার মতোই পিছন দিকে এগোতে চাইছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই দু'জন নন। সাঁয়ত্রিশ বছরের কুক যদি জেঠু হন, আগামী ৭ জুলাই একচল্লিশে পা দিতে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনি নিঃসন্দেহে পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর যে ইচ্ছামৃত্যু, তা সেই ২০১১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। দল পরপর আটটা টেস্ট হারার পরেও ধোনির অধিনায়কত্ব যায়নি, বরং সেই প্রস্তাব নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে তোলার পরে মহিন্দর অমরনাথের নির্বাচকের চাকরি গিয়েছিল। ভারতের একদিনের ক্রিকেটের দলও ধোনিকে বয়ে বেড়িয়েছে বছর চারেক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, আর বড় শট নিতে পারেন না, অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সে কাজটা করলে তিনি বড়জোর এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে পারেন, যা অনেক সময় জেতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবু তাঁকে অবসর নিয়ে প্রশ্ন করলে বেজায় রেগে যেতেন। ২০১৬ ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি থেকে ভারতের বিদায়ের পর তো নির্লজ্জতার শিখরে উঠেছিলেন। এক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক এই প্রশ্ন করায় তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধোনির অবসর দেখতে চান কি না। তিনি তো আর ভারতীয় নন, যে কোনও আত্মীয়পরিজন থাকবে যে ধোনির জায়গায় খেলতে পারে।

 

এন. শ্রীনিবাসনের থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন বলেই ধোনি একদিনের ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ অব্দি। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে চার, ছয় মারার ক্ষমতা তো বটেই, গড়ও কমে গিয়েছিল। কেরিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে পঞ্চাশ, সেখানে এই চার বছরের গড় নেমে এসেছিল চুয়াল্লিশে। চারে নেমে খেলতে না পারলে টিভি স্টুডিওতে বসে বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলতেন, ধোনিকে পাঁচে খেলানো উচিত। পাঁচে না পারলে বলতেন ছয়ে। অর্থাৎ দল তাঁকে বয়ে বেড়াত। কালেভদ্রে একটা ম্যাচে উইনিং স্ট্রোক নিলেই ফের সবাই মনে করিয়ে দিত, ধোনি সর্বকালের সেরা ফিনিশার। আর ধোনিকে এসব জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বারবার বলতেন, আগের মতো অত ছয় মারেন না তো কী হয়েছে? তিনি তো ফিট আছেন। যেন খেলাটা ক্রিকেট নয়, জিমন্যাস্টিক্স।

 

আসলে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। তাই ধোনি নির্বিঘ্নেই খেলে ফেলেন আরও একটা বিশ্বকাপ। কিছু বিশেষজ্ঞ আর অন্ধ ভক্ত আজও বলেন “যদি গাপ্টিলের থ্রো-টা উইকেটে না লাগত…।" ভুলে যান যে, ধোনি সেদিন পঞ্চাশে পৌঁছতে লাগিয়েছিলেন বাহাত্তরটা বল, মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মেরেছিলেন। রবীন্দ্র জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ রান করেছিলেন বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান আরও বড় হয়নি- এটুকুই সান্ত্বনা। নইলে শেষ ওভারে ধোনির ভেলকি দেখানোর সম্ভাবনা আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। রাজনীতিতে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু খেলার মাঠে পরিণাম বদলানো যায় না।

 

এতদিন পরে হৃদয় খুঁড়ে আবার এসব বেদনা জাগাতে হচ্ছে, কারণ এবারের আইপিএলে ধোনি ওই জাদেজাকেই হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছেন। এমনিতে চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের অন্যতম ডিরেক্টর ধোনি। সুপার কিংস দলটা সেই অর্থে তাঁর নিজের সম্পত্তি। যার ব্যাট, যার উইকেট তাকেই খেলতে নেব না– এ জিনিস পাড়া ক্রিকেটেই চলে না, আইপিএলে কী করে চলবে? ফলে ধোনির উইকেটরক্ষায় যতই শিথিলতা আসুক, ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা যতই কমে যাক, এই দলে তিনি যতদিন খেলতে চাইবেন ততদিনই খেলবেন। সমস্যা হল, তিনি কেবল খেলছেন না, খেলতে গিয়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন। আইপিএল শুরু হওয়ার মুখে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতামহ অধিনায়কের সিংহাসনটি স্নেহভাজন জাদেজার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন– সবকিছুতেই ধোনির কথাই শেষ কথা। জাদেজা নেহাতই রাবার স্ট্যাম্প। অবশ্য তাতেও সুপার কিংস দলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়া আটকায়নি। কিন্তু ব্যাটে-বলে ব্যর্থ জাদেজা ন'টা খেলার মধ্যে ছ'টা হারার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন। ধোনি মুকুট ফিরিয়েও নিলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋতুরাজের মতো তরুণতর কাউকে দায়িত্ব দিলেন না। তাহলে মরশুমের শুরুতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিল? জাদেজাও তো তেত্রিশ পেরিয়েছেন, কচি খোকাটি নন। তাঁর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের আশা ছিল? জাদেজা এই মুহূর্তে চোট-আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে। এই টানাপোড়েনে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল কি না, তিনি মাঠে না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। যদি ধরে থাকে, তাহলে সুপার কিংসের চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের।

 

আসলে বাকি পৃথিবী সামনের দিকে তাকাতে চায়, আর আমরা চাই অতীতের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকতে। এই আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অতি বড় ক্রিকেটারেরও ক্ষমতা কমে আসে, আজ না কমে থাকলেও পরের বড় টুর্নামেন্টটা আসতে আসতে যে কমে যেতে পারে– এসব কথা না তাঁরা নিজেরা মানেন, না তাঁদের ভক্তকুল মানে। তারকারা আয়নায় মুখ দেখতে পান না, কারণ মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। ফলে ব্যাটে-বলে হচ্ছে না, পা বলের লাইনে যাচ্ছে না, রিফ্লেক্স কমে গেছে, বহু বছর ধরে অতিমাত্রায় জিম করার ফলে টানা দু'-ঘণ্টা ব্যাট করলেই পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে– এসব যখন ক্রিকেটার নিজে বুঝতে শুরু করেন, তখনও সবাই মিলে কানের কাছে বলতে থাকে “ও কিছু নয়। ক'দিন ব্রেক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” এমনটাই এনডোর্সমেন্টের যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে হয়ে আসছে। যেনতেনপ্রকারেণ চল্লিশ অবধি খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শচীন। ধোনি ভাবলেন তিনিই বা কম কীসে? হয়তো পঁয়তাল্লিশকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছেন। বিরাট ভাবছেন, তিনি তো কোনও অংশে ধোনির চেয়ে কম যান না। রোহিত সবে অধিনায়ক হলেন, পঞ্চাশ ওভার আর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তাঁরও ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। তিনিই বা চল্লিশ অবধি খেলার কথা ভাববেন না কেন? “ক্রিকেটের ঈশ্বর” তো শচীন, কুক তো নন। ফলে টেওয়াটিয়া, ত্রিপাঠীদের বেলা মেঘে মেঘেই বাড়বে।

 

ঋদ্ধিমান সাহার বেলায় দ্রাবিড় ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এই ছেলেখেলা তিনি চলতে দেবেন না। এই ২০২২ সালেও ঊনবিংশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের গন্ধে মাতাল বাঙালি তা নিয়ে বিস্তর গোল করেছিল। এবারের আইপিএলে গুজরাত টাইটান্সের ওপেনার হিসেবে ঋদ্ধিমানের সাফল্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির দল নির্বাচনের সময়ে যদি তরুণদের সুযোগ দেওয়ার নীতি ভুলে গিয়ে তারকাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে, পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট পরিমাণ এনডোর্সমেন্ট থাকলে ঋদ্ধিমানের বয়সও ঢেকে যেত।

 

*সব পরিসংখ্যান ১৯ মে, বৃহস্পতিবারের গুজরাত টাইটান্স বনাম রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ পর্যন্ত

গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার

More Articles