সুশান্ত থেকে কে কে- আমাদের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তের প্রতিশোধ
ভক্ত বা ফ্যান বেশ গোলমেলে। সুশান্তের ফ্যান কারা? যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর নিজেদের সুপ্ত হিংসা মিটিয়ে নিলেন নানাবিধ শত্রু খাড়া করে?
পাখিটি মরিল।
খবরটা কিঞ্চিৎ এমন নির্লিপ্তভাবেই ছুড়ে দিচ্ছিল মিডিয়া, প্রথমে। আড়ালের তোতাকাহিনিতে বলিউড ঘাপটি মেরে ছিল। প্রথমে যা শুরু হলো, তা আত্মহননকারী ব্যক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে, সাধারণ একটি তত্ত্ব খাড়া করা। আত্মহত্যার কারণ কী? এককথায় উত্তর, ডিপ্রেশন। অবসাদ। আর এই অবসাদের উৎস সন্ধানে সকলেই ফেসবুকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ গবেষণা চালাচ্ছিল। কিন্তু মিডিয়ার আখ্যান এক সরলরেখায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কেঁচো খুঁড়ে কেউটে সামনে না আনলে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের জনমানসে এই মৃত্যুর কোনও অভিঘাতই তৈরি হয় না। অবসাদ একটা জটিল বিষয়, মানুষ মোটেই এমন জটিল বিষয় বুঝতে বা জানতে চায় না, যে বলিউডকে সে ঘৃণা করবে, সেই বলিউডের ধাঁচেই একটা গল্প বানানো প্রয়োজন।
কোভিড অতিমারীর তুঙ্গে তখন ভারত। প্রথম ঢেউ শানাচ্ছে মৃত্যুর ফলা, লকডাউনের অন্ধকার বাড়ছে ক্রমশ। ঘরে বন্দি ভারতীয় মধ্যবিত্তির ডালগোনা কফি, বেঙ্গালুরুর বুকে ডাইনোসর দেখতে পাওয়ার ইন্দ্রজাল কেটে যাচ্ছে, দেশে শুরু হলো এক নতুন, ঝড় তোলা অধ্যায়, সেই অধ্যায়ের নাম সুশান্ত সিং রাজপুত।
আরও পড়ুন: একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা
কোভিড নাকি ঘুচিয়ে দেবে সব শ্রেণির বিরোধ, ধর্মের বিরোধ, মানবসভ্যতা বিপন্ন, তাই রাজনৈতিক বেড়া ভেঙে পৃথিবী একত্র হবে, ওল্ড নর্মাল ঘুচে গিয়ে আসবে নিউ নর্মালের ঝংকার, হঠাৎ করে নাকি কমে যাচ্ছে পরিবেশ দূষণ, শহরের রাস্তায় বন্যপ্রাণীর চলাচল দেখা যাচ্ছে, মানুষ আস্তে আস্তে ঝেড়ে ফেলছে তার অহং, নৈকট্য বাড়ছে, কমছে হিংসা...
অতিমারীর শুরুতে এমন বহু আশার বাণী শোনা গিয়েছিল, কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের দীর্ঘ পথ হাঁটা, মৃত্যুর অনিবার্য, ভয়াবহ মিছিল এবং তা ঘিরে মানুষের নির্লিপ্তি যদি প্রথম ধাক্কাটা দিয়ে থাকে ভারতীয় মননে, দ্বিতীয় ধাক্কাটা দিয়েছিল এক বলিউড অভিনেতার আত্মহত্যা। পরিযায়ী শ্রমিকদের পিষে যেতে দেখে, তাদের রুটি রেললাইনের ধারে পড়ে থাকতে দেখে যে ভারতীয়দের পায়ের তলার মাটি একচুল টলেনি, সুশান্তের আত্মহত্যা তাদেরই নিঘিন্নে নখদাঁত প্রকট করেছিল, যার আড়ালে নিয়ন্ত্রক ছিল বড় মিডিয়ার মগজধোলাইয়ের কারখানা।
সুশান্ত সিং রাজপুত কি তারকা ছিলেন? উত্তর, খান-রা বা অক্ষয়কুমার যে অর্থে তারকা, তা ছিলেন না। তিনি কি বলিউডের প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনার শিকার নন? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। কিন্তু সমস্যাকূটটা অন্যত্র। ডেনমার্কের রাজসভায় যে কিছু একটা গোলযোগ চলছে, তা মানুষ বুঝেছিল ঠিকই, বোঝেনি কেবল একটিই বিষয়, যে ধোঁয়া দেখে তারা আগুনের ছানভিন করেছে, সেই ধোঁয়ার আসলিয়ত তারা দেখতে পেত নিজেদের ভেতর তাকালেই।
সুশান্ত সিং রাজপুত অনেকেরই প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। হয়তো অল্প দর্শকের, কিন্তু ছিলেন। তাঁর যখন মৃত্যু হলো, সেই মৃত্যু যে পথেই আসুক, তাঁর প্রাপ্য ছিল শোকের নীরবতা। তাঁর প্রাপ্য ছিল তাঁর অভিনয়ের কাটাছেঁড়া, একজন অভিনেতার মৃত্যুর পর যা স্বাভাবিক। তাঁর প্রাপ্য ছিল, তাঁর না দেখা অভিনয় মানুষের দেখা, তাঁর দেখা অভিনয় ফিরে দেখা।
কিন্তু শিল্পীর মৃত্যুর পর তাঁর শিল্পকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে, তাঁর কাজকে ফিরে দেখার জন্য যে মৌলিক শ্রম এবং মনোযোগ প্রয়োজন ছিল, যে সহনশীল সংবেদনের প্রয়োজন ছিল, তা সামগ্রিকভাবে জনপিণ্ডর যে নেই, হাতেনাতে প্রমাণ মিলল তার। এসবের বদলে মৃত্যুর পর সুশান্ত কী পেলেন?
তিনি অবশ্যই অনেকটা সহমর্মিতা পেলেন, সেই সহমর্মিতা তৈরি হলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিল্পীজীবনের গহিন মনে অনধিকার প্রবেশ এবং মনের মাধুরী মিশিয়ে 'সুশান্ত সিং রাজপুত হত্যারহস্য' জাতীয় সস্তার রহস্য গল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সুশান্তকে সকলে ভালবাসলেন, ফের তাঁর অভিনয় দেখে নয়, তাঁর পুঁথিগত পড়াশোনার কতটা জোর, তাঁর ডিগ্রির তালিকা কতটা জোরালো, চাইলেই অভিনেতা না হয়ে আর কী কী তিনি হতে পারতেন- ইত্যাদি অকিঞ্চিৎকর প্রশ্নর ওপর দাঁড়িয়ে। যে রাস্তা তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন, যে শিল্পমাধ্যম তাঁর রুটিরুজি এবং পরিচিতির ভিত্তি ছিল, তার ঊর্ধ্বে উঠে সুশান্তকে চেনার চেষ্টা করা হলো 'মেধা' নামক একটি নিরালম্ব বায়ুভূতের মাপকাঠিতে, ভারতের মতো দেশে যা আদতে বিবিধ সামাজিক পরাকাষ্ঠার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। সুশান্ত চাইলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে পারতেন, এই হয়ে গেল তাঁকে মনে রাখার রাস্তা। অভিনেতা সুশান্ত, যাঁর বিরুদ্ধে বঞ্চনার জন্য আমাদের রাগ-ক্ষোভের শেষ নেই, তাঁকে আমরাও দিব্যি ভুলে গেলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে লাগলাম তাঁর সেইসব ছবি, ভিডিও, যা অভিনেতা সুশান্তকে একটু একটু করে ঠেলে সরিয়ে দেয়, বরং ভারতীয় মানসদুনিয়ায় 'সফল' এবং 'প্রতিভাবান' বলে যে বানিয়ে তোলা মার্কাগুলো আছে, তার সঙ্গে খাপে খাপ করে দেয় তাঁকে।
প্রথমে ধরেই নেওয়া হলো, বিশেষ কোনও অ্যাওয়ার্ড সেরিমনিতে শাহরুখ খান তাঁকে নিয়ে মশকরা করেছেন বলে, করিনা কাপুর কফি উইথ করনে বসে সারা আলি খানকে তাঁর সঙ্গে প্রেম করতে বারণ করেছেন বলে, সোনম কাপুর তাঁকে 'হট' বলেননি বলে সুশান্ত ক্রমে নিজেকে শেষ করার দিকে এগিয়েছেন। একটা গোটা দেশ বেহায়ার মতো একজনের আত্মহননের কারণ মনের সুখে তৈরি করতে লাগল। তিনি মৃত, তাঁর অনুমতি কে নেবে? বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস' নাটকটা এই সূত্রে চট করে অনেকের মনে পড়ে যেতে পারে, শরদিন্দু আর বাসন্তী সেখানে নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে বানাচ্ছিল সীতানাথ আর কণার আত্মহত্যার প্রেক্ষিত। শেষে সীতানাথ শরদিন্দুর মুখোমুখি হয়েছিল, শরদিন্দু তাকে প্রশ্ন করে, সে কেন আত্মহত্যা করেছে? উল্টে সীতানাথ তাকে প্রশ্ন করে, শরদিন্দু কেন আত্মহত্যা করেনি। আসলেই এই প্রশ্নের সীমানা খাদের কিনারে, তা আদিম, এবং দার্শনিকতার এক অসহনীয় উচ্চতায় সরু সুতোর ওপর পা রাখতে তা বাধ্য করে। ভারতীয়রা প্রশ্নের পরোয়াই করল না, একজন আত্মঘাতী মানুষের হয়ে উত্তর দিয়ে গেল তারাই! এতটাই, এতটাই হিংস্রভাবে নির্মম হতে জানে একটা জাতি? জানে যে, সামাজিক মাধ্যমের পাতায় ছত্রে ছত্রে তা প্রমাণ করল দেশের আম আদমি।
এরপর আস্তে আস্তে সুশান্ত ঢাকা পড়তে শুরু করলেন মিডিয়াঘন কালো মেঘে। হঠাৎ বিতর্ক দেখা দিল, তারকাদের ড্রাগ নেওয়া নিয়ে। এই পর্বে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন একজন 'সাংবাদিক'। টিভির পর্দায় 'ড্রাগ দো, ড্রাগ দো' বলে চিৎকার করে তিনি আসলে একটা সমষ্টির স্বরকে তুলে ধরলেন, যে সমষ্টি একটি মুহূর্তও মিডিয়ার সাজিয়ে দেওয়া ঘটনার মাদক ছাড়া বাঁচতে পারে না। সেই মাদক ভাইরাল হয়, ট্রেন্ড তৈরি করে, প্রবৃত্তিকে ওসকায়, পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী প্রবণতার মালা গেঁথে তৈরি হয় চিরস্থায়ী নেশা, যে নেশা চোখে সাঁটা ঠুলির ভেতর ক্রমাগত দৃশ্য না পাল্টালেই ছটফটিয়ে ওঠে। আসলে ওই সাংবাদিকও জানেন, উচ্চকিত অলীক কুনাট্য, নিরন্তর মিথ্যের বেসাতিতে থাকা দর্শকের চোখ ঘোলাটে, এক মুহূর্তের জন্য হুঁশ ফিরলে ধসে পড়বে তার সাজানো বাগান। সে নিজেই তখন গণমানুষের সম্মতি উৎপাদনকারী মিডিয়ার কাছে হাত পাতবে, আর্তনাদ করবে, ড্রাগ দো, ড্রাগ দো।
সুশান্তের প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তী ছিলেন কিস্তিমাতের শেষ চাল। একা নারীকে পেয়ে আরও হিংস্র হয়ে উঠল শয়ে শয়ে ফেসবুক প্রোফাইল। প্রায় মানুষের তৈরি এআই বট-এর মতো ছকে বাঁধা চেনা স্বরে তারা একযোগে আঙুল তুলে 'ডাইনি' বলল রিয়াকে, শাবাশ নিউ নর্মাল! 'কালোজাদু জানা' রিয়া চক্রবর্তীর জীবন-জীবিকা ধ্বংস করতে চাওয়া হয়ে উঠল জাতীয় ন্যায়বিচারের দাবি। তারা আজ নতুন কোনও 'ডাইন' খুঁজে বেড়াচ্ছেন লকলকে জিভে, রিয়ার জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াল তাদের যৌথ আক্রমণের পর, তা নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয় তারা। মুহূর্তের প্রতিশোধ খিদে মিটিয়ে রওনা দিয়েছে নতুন শিকার ধরতে।
এর ফাঁকে সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে জমজমাট যৌন উত্তেজনা আর ষড়যন্ত্রে ঠাসা প্রায় প্রস্তুত চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা তৈরির কপিরাইট নেওয়া হলো। 'জাস্টিস ফর সুশান্ত' নামে কিছু পেজ তৈরি হলো, হঠাৎ একসময় দেখা গেল, সেই পেজগুলো থেকে প্রসাধনী বেচা হচ্ছে, বা চর্চা হচ্ছে সম্মিলিত পর্নোগ্রাফির। বাংলায় একটা গোটা পাল্প উপন্যাস বেরিয়েছে সুশান্তকে নিয়ে। স্বজনপোষণ, করণ জোহর, কঙ্গনা রানাওয়াত- এই সব চরিত্র মজুত করে দিব্য সামাজিক যাত্রাপালা চলল, প্রয়াত সুশান্তকে বিহারের ভোটের জন্য কিছুটা ইস্তেমালও করে নেওয়া গেল। মাঝেমধ্যে সুশান্তের বিচার চেয়ে মিছিল ইত্যাদি হলো। কেউ বললেন, সুশান্ত গেছেন এলিয়েনদের খোঁজে, কেউ ভাবলেন, সুশান্ত গেম বানাতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেছেন চিন জয় করার পথ, তাই তাঁকে আত্মগোপন করতে হয়েছে।
আর অভিনেতা সুশান্তকে দেশ সম্মান জানাল, মৃত্যুর পর মুক্তি পাওয়া তাঁর অভিনীত ছবি 'দিল বেচারা'-কে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ওই একই সময় মুক্তি পেল 'সড়ক ২', ততদিনে মানুষ বিশ্বাস করেছে রিয়া চক্রবর্তীর গোপন প্রেমিক মহেশ ভাট, তাই মহেশ ভাটের ছবিকে চলতে দেব না, কেবল এই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল সুশান্তের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অভিনয়টিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে, হলে যেতে বা টিকিট কাটতে হলো না, ওটিটি-র চারচৌকো খোপেই শিল্পী সুশান্তকে এভাবে সম্মান জানাল দেশবাসী।
যাঁরা সব ভুলে 'দিল বেচারা'-কে জেতাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কতজন মনে রাখেন অভিষেক চৌবের 'সঞ্চিরিয়া' ছবিটির নাম? সুশান্তের অবিশ্বাস্য অভিনয় কত জন দেখেছেন সেই ছবিতে? দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী' যখন হলে ধুঁকছিল, কত জন ছুটে গিয়েছিলেন বলিউডের 'স্বজনপোষণ' ও 'চক্রান্তে' কোণঠাসা হওয়া অভিনেতা সুশান্তকে সম্মান জানাতে?
দু'বছর কেটে গেল সুশান্তের মৃত্যুর। ১৪ জুন চলে গেল নীরবে, কেউ কেউ আরও একবার 'বয়কট বলিউড' বলে চিৎকার করলেন, একবারের জন্যও এক শিল্পীর মৃত্যুতে শোকাতুর হওয়ার অবকাশ পেল না দেশ। সুশান্ত সাময়িক নেশা ছিলেন, সেই নেশা কাটছে। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত কেন ব্যোমকেশ হিসেবে উল্লেখ্য, কেন 'কাই পো চে'-তে বিশেষ করে নজরে পড়ে তাঁকে, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে মানুষ কিঞ্চিৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে এগিয়ে যাবে নতুনতর ইস্যুর দিকে।
ভক্ত বা ফ্যান বেশ গোলমেলে। সুশান্তের ফ্যান কারা? যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর নিজেদের সুপ্ত হিংসা মিটিয়ে নিলেন নানাবিধ শত্রু খাড়া করে?
কে কে, কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ চলে গেলেন ৩১ মে। কে কে-র ক্ষেত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ, গোলকায়ন পরবর্তী প্যান ইন্ডিয়ান প্রজন্ম তাঁর কণ্ঠে নিজেদের সুর পেয়েছিল। একটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে বদলে গেছে সময়, আর বারবার সেই সময়ের শিলালিপিতে গেঁথে গেছে কে কে-র গানের প্রেম, বিরহ, যাপন, বন্ধুত্বের ছেড়ে যাওয়া মাঠ। তাই শোক অনেক বেশি মাত্রায় ঘিরে ধরেছে মানুষকে। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাব্যপংক্তি বলছে, কলম হিংসা কমিয়ে দেয়। পবিত্র শোক-ও আসলে হিংসাকে প্রশমিত করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া দাঁতের ফাঁকে রক্তের স্বাদ এনে দিতে সময় নেয় কয়েক লহমা। রূপঙ্কর কে কে-র মৃত্যুর আগে যখন 'হু ইজ কে কে' বলে ভিডিও করলেন, তাঁকেও তখন পেয়ে বসেছিল এই খোলা হিংসার চণ্ডীমণ্ডপ। আর সেই হিংসা সহস্র গুণ হয়ে ফিরে গেল তাঁর কাছে। রূপঙ্করের অভিশাপে কে কে-র মৃত্যু হয়েছে, কুশিক্ষিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা দাবি করলেন বুক চিতিয়ে। প্রতিহিংসার এতটাই ঝোঁক আমাদের, মৃত্যু হলেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আমাদের মাথায় কিলবিল করে ওঠে। সম্মিলিত ছুরিকাঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হলো রূপঙ্করকে, দিব্য জায়েজ হয়ে গেল তা। রূপঙ্করের বক্তব্যের অনৌচিত্য নিয়ে কথা বলার হাজারটা পরিসর ছিল, কিন্তু মুহূর্তের প্রতিশোধ এতটাই পেয়ে বসল জনগণকে, যে 'পাবলিক ইন্টারেস্ট'-এর খাতিরে মিডিয়া ট্রায়াল বসল, বিবিধ পেশাগত জায়গা থেকে নাম কাটা গেল রূপঙ্করের। এই গণহিংসাকে আমরা মেনে নিই। যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক শোষণ, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার চাষ থেকে শুরু করে মৌলিক অধিকারের আদ্যশ্রাদ্ধ হয়, তখন 'পাবলিক ইন্টারেস্ট' নিয়ে ততটা ইন্টারেস্টেড হয় না প্রতিষ্ঠান। অথচ যেই লেলিয়ে দেওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ, সেখানে পুচ্ছ তুলে সক্রিয় হতে জানে মিডিয়া থেকে মানুষ- সকলেই।
সুশান্তের মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে আমাদের বুক ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলেন ইরফান। ইরফান আমাদের অন্তরের যন্ত্রণা, আমাদের আজীবনের ক্ষতি, অথচ ইরফান তো বেঁচে রইলেন শোকে এবং ভালবাসায়। প্রিয় শিল্পীকে ভালবাসতে আমার শত্রুপক্ষ লাগবে কেন? কেন ইরফানের বা সুশান্তের অভিনয়, কে কে-র গলায় সেসব জাদু-গান আমাদের সমাহিত হতে, হিংসা ভুলতে শেখাবে না? ইরফানের ছবি 'জজবা'-র তথাকথিত ভাইরাল সংলাপটাই বারবার মনে বাজছে এই প্রসঙ্গে, যেখানে ইরফান বলেছিলেন, 'মোহব্বত' ছিল বলেই তো যেতে দিলাম, 'জিদ' হলে বাহুডোরে থাকত। আমরা জেদ ভুলে গিয়ে মোহব্বতে ভেজাই না কেন প্রিয় শিল্পীদের? কেন তাঁদের দিই না ভালবাসার অবসর?