একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা

ফাহাদ, আবদুল, যশরাজ, আসিফ হিমশৈলর চূড়ামাত্র। গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত এভাবেই সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের খাঁড়া নেমে এসেছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকে।

লহু লহু লহু ওয়ক্ত কা খুন হুয়া রে
লহু লহু লহু বেহতা অঙ্গারা, লহু বেহতা আঙ্গারা...
জেহ্‌লাম জেহ্‌লাম ঢুঁডে কিনারা

প্রতিটি লাশের হিসেব রয়েছে নদীর কাছে। বুকে করে নিজেই না জানি কত বয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সময়ের লাশের ভার বইতে পারা সহজ নয়। নুড়ি-পাথর ঝাপটেও মেলে না হিসেব। পরে গিয়ে হিসেব দিতে হবে জানা থাকলে ভাল হতো যদিও। লিখে রাখা যেত, জুতসই কোনও উত্তর। কিন্তু খবরের পেশায় হাত গুনতে জানাটাও জরুরি বলে মনে হয়নি কখনও। তাই পুরাঘটিত ভবিষ্যতের কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে কুলকিনারা করতে পারছেন না যশরাজ শর্মা।

আদতে রাজস্থান-নিবাসী, ২৩ বছরের যশরাজ তরুণ সাংবাদিক। ২০১৮ সালে কাশ্মীরের অনলাইন পত্রিকা ‘দ্য কাশ্মীরওয়ালা’-য় ছোটখাটো একটি চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন। বয়স কম হলেও কাজ উতরে দিতে পারতেন সময়ে। তাই ‘দেশবিরোধী’ লেখা ছাপার দায়ে পত্রিকার সম্পাদক ফাহাদ শাহ ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেফতার হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সম্পাদক হিসেবে কাজ সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে যশরাজের হাতে।

কিন্তু চার মাসের মাথায়, ২ জুন যশরাজকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পাঠায় উপত্যকার পুলিশ। অভিযোগ সেই একই, ‘দেশবিরোধী’ লেখা ছাপা। আর এখানেই রয়েছে চমক। গত চার মাসে যশরাজের হাত দিয়ে কোথাও ‘দেশবিরোধী’ লেখা বেরিয়েছে বলে নয়, ২০১১ সালে তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেশবিরোধী’, ‘অত্যন্ত উসকানিমূলক’ প্রতিবেদন নিয়ে জবাবদিহির জন্যই ডেকে পাঠানো হয় যশরাজকে, যে-সময় সাংবাদিকতার পেশায় তিনি প্রবেশই করেননি, যে-সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২।

আরও পড়ুন: ভূস্বর্গের ভয়াবহতাকে লেন্সে ধ‍রেছেন বারবার, চেনেন এই কাশ্মীরি নারীকে?

‘দ্য শ্যাকলস অফ স্লেভারি উইল ব্রেক’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনকে ঘিরেই এই মামলা, বাংলায় যার তর্জমা করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে পড়বেই’। ২০১১ সালে ‘দ্য কাশ্মীরওয়ালা’-য় ওই প্রতিবেদনটি লেখেন আবদুল আলা ফজিলি। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীরে গবেষণারত পিএইচডি পড়ুয়া। উপত্যকায় অস্থিরতা তৈরি করতে, সন্ত্রাসী কাজকর্মকে গৌরবান্বিত করে দেখাতে এবং যুবসমাজকে নাশকতামূলক কাজকর্মের দিকে ঠেলে দিতেই ওই প্রতিবেদনটি লেখা হয় বলে অভিযোগ পুলিশের। এ-বছর ১৭ এপ্রিল গ্রেফতার হন আবদুল। তাঁর বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (UAPA) ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে।

Haider Movie

'হায়দার' ছবির একটি দৃশ্যে শাহিদ কাপুর

প্রতিবেদনটি লেখার দায়ে এবং সেটি প্রকাশের দায়ে জম্মু-কাশ্মীরের স্টেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (SIA) হেফাজতে রয়েছেন ফাহাদ এবং আবদুল। যশরাজকেও SIA-র তরফেই শমন পাঠানো হয়েছে। ‘দ্য কাশ্মীরওয়ালা’ এবং আবদুলের বিরুদ্ধে UAPA-র পাশাপাশি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা তথা যুদ্ধে ইন্ধন জোগানো, দেশদ্রোহ, দেশের অখণ্ডতা ভঙ্গের চেষ্টার মতো অপরাধের ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। দু’-দু’বার আদালতে জামিন মঞ্জুর হলেও, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফের গ্রেফতার করা হয় ফাহাদকে। ২০২০-র মে মাসে একটি এনকাউন্টার নিয়ে লেখা প্রতিবেদনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ণ করার চেষ্টা হয় বলে নতুন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদে উসকানি জুগিয়েছেন বলেও অভিযোগ পুলিশের।

‘কাশ্মীর ন্যারেটর’-এ রাজনীতি এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত খবরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আসিফ সুলতান ২০১৮-র অগাস্ট মাস থেকে জেলবন্দি। হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর ‘দ্য রাইজ অফ বুরহান ওয়ানি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন লেখেন আসিফ। তাতে বুরহানের জঙ্গি হয়ে ওঠার বিবরণ ছিল। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একবার বিনা কারণে বুরহান, তার দাদা খালিদ এবং কয়েক জন বন্ধুর ওপর মারধর, অত্যাচার চালায় পুলিশ। তারপর পুলিশের গোলাগুলির মাঝে পড়ে বেঘোরে প্রাণ যায় খালিদের। তাতে ৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েই হাত তুলে নেয় সরকার। তারপরই মেধাবী ছাত্র বুরহান পড়াশোনা ছেড়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। ওই প্রতিবেদন লেখার দায়েই আসিফকে গ্রেফতার করা হয়। UAPA ধারায় মামলা দায়ের হয় তাঁর বিরুদ্ধেও। দীর্ঘ দিন বিনা বিচারে বন্দি রাখা হয় আসিফকে। ২০১৯-এর জুন মাসে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলার শুননি শুরু হয়। এ-বছর এপ্রিল মাসে জামিনও পেয়ে যান আসিফ। কিন্তু তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বরং জন নিরাপত্তা আইনে (Public Safety Act) ফের গ্রেফতার করা হয়। আসিফ আমেরিকার ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের থেকে প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন।

Press Freedom in Kashmir

কাশ্মীরে রুদ্ধ সাংবাদিকের কলম

তবে ফাহাদ, আবদুল, যশরাজ, আসিফ হিমশৈলর চূড়ামাত্র। গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত এভাবেই সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের খাঁড়া নেমে এসেছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকে। প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া-র (Press Council of India) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির একটি রিপোর্ট বলছে, সরকার বেঁধে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে থাকলে ভাল, তার বাইরে পা পড়লেই খাঁড়া নেমে আসছে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের ওপর। প্রথমে বরাদ্দ আবাসন থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। সমালোচনাধর্মী কোনও লেখা প্রকাশিত হলে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সরকারি বিজ্ঞাপন। তারপর সেনা এবং পুলিশকে দিয়ে শুরু হচ্ছে প্রাত্যহিক হেনস্থা।

সাংবাদিক হেনস্থা নিয়ে গতবছর অভিযোগ দায়ের করেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (PDP) নেত্রী মেহবুবা মুফতি। তারপর গত বছর প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার তরফে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেন সংস্থার চেয়ারম্যান বিচারপতি সিকে প্রসাদ। উপত্যকায় কর্মরত সাংবাদিক, বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, সমাজকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তিন সদস্যের ওই কমিটি। মেহবুবা, জম্মু-কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা, পুলিশের আইজি বিজয় কুমার-সহ উপত্যকার আধিকারিকদের সঙ্গেও কথা বলে ওই কমিটি। শ্রীনগর থেকে তথ্য সংগ্রহ নিয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়, "শ্রীনগরে আমাদের দু’বারের সফরের সময় শত্রুতা এবং সংঘাতের পরিবেশ অত্যন্ত প্রকট ছিল।"

গত বছর অক্টোবরে শ্রীনগরের আলোচি বাগ এলাকায় স্থানীয় একটি স্কুলের অধ্যক্ষ সতীন্দর কউর এবং শিক্ষক দীপক চাঁদ খুন হন। জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবার শাখা সংগঠন ‘রেসিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট’-এর জঙ্গিরা তাঁদের খুন করেছে বলে তদন্তে উঠে এসেছিল সেই সময়। তার কয়েক দিন আগে, এলাকার পরিচিত ফার্মাসিস্ট মাখনলাল বিন্দ্রু খুন হন। হায়দরপোরা এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় দন্ত চিকিৎসক মুদাসির গুল এবং ব্যবসায়ী আলতাফ আহমেদ ভাটের। পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ রয়েছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে, ভারত সরকার এবং জঙ্গিদের মধ্যেকার সংঘাত এবং বিরোধের জেরে বন্দুক এবং গোলাগুলি সেখানকার সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষকেই এর চরম মূল্য চোকাতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে, বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে কাশ্মীরে সাংবাদিকদের ওপর দু’তরফ থেকেই চাপ আসছে বলেও দাবি করা হয় ওই রিপোর্টে। তাতে বলা হয়েছে, উপত্যকার মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ। জম্মুতে মুদ্রিত প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা ২৫৯টি। কাশ্মীরে নথিভুক্ত সংস্থা ১৬৬টি। এ ছাড়াও আঞ্চলিক টিভি চ্যানেল এবং ডিজিটাল চ্যানেল রয়েছে কিছু। কিন্তু ওই সমস্ত সংস্থায় কর্মরত সাংবাদিকরা ন্যূনতম বেতন পান, যা দিয়ে মাথার ওপর আশ্রয় জোগাড়ও হয় না। তাই সরকার-বরাদ্দ আবাসনই ভরসা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সরকারি আবাসন থেকে উচ্ছেদের নোটিস পাওয়া ৪০ জনের মধ্যে ২০ জনই পেশায় সাংবাদিক বলে ওই কমিটিকে জানিয়েছেন এডিটর্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আসলাম ভাট। ‘কাশ্মীর নিউজ সার্ভিস’-এর সম্পাদক আসলাম জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া সত্ত্বেও, ২০২০-র ১৫ অক্টোবর কোনওরকম নোটিস ছাড়া তাঁর দফতর সিল করে দেওয়া হয়। তারপর এক বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও, সিল খোলা হয়নি, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জিনিসপত্র বের করতে দেওয়া হয়নি তাঁদের।

কী কারণে এমন পদক্ষেপ, তা আজও জানতে পারেননি আসলাম। তবে তাঁর দাবি, কোনও পক্ষ না নিয়ে, নিরপেক্ষ প্রতিবেদনই প্রকাশ করেন তাঁরা। তাতে বিরোধী শিবিরের নেতাদের নিয়েও খবর থাকে। তাতেই হয়তো তাঁদের নিশানা করা হচ্ছে বলে সন্দেহ তাঁর। একই সুর শোনা যায় ইউসুফ জামিল নামের উপত্যকার আরও এক পরিচিত সাংবাদিকের গলায়। তিনি জানান, সর্বান্তকরণে সরকারকে সমর্থন না করে, আবার বিরোধীদেরও সমর্থন না করে, ভারসাম্য বজায় রেখে যে-সমস্ত সংবাদমাধ্যম কাজ করছে, তাঁদেরকেও নিশানা করা হচ্ছে। বিনা নোটিসে চালানো হচ্ছে উচ্ছেদ অভিযান। এই নিয়ে এ-বছর জানুয়ারি মাসে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে কারণও জানতে চাওয়া হয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তরফে। কিন্তু জবাব মেলেনি।

সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। বলা হয়েছে, মুদ্রিত সংবাদপত্র এবং পত্রিকাগুলিকে বিজ্ঞাপনের জুজু দেখিয়ে রাখা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের দোহাই দিয়েই তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। যারা সরকারের সামনে মাথা নত করছে না, সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে তাদের। উপত্যকার সংবাদমাধ্যমগুলি সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু নতুন নীতিতে সরকার বিজ্ঞাপনের ৪০ শতাংশই মুদ্রিত সংবাদমাধ্যম থেকে তুলে নিয়েছে বলে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। শর্তসাপেক্ষে যারা বিজ্ঞাপন পাচ্ছে, তাদের সাফ বলে দেওয়া হচ্ছে, বিরোধীদের মন্তব্য ছাপা যাবে না। উপত্যকার তথ্য বিভাগের কাছ থেকে ওই কমিটি জানতে পেরেছে যে, নানা অজুহাত দেখিয়ে জম্মুতে ২৫৯টি প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে ২৬টি এবং কাশ্মীরে ১৬৬টি সংস্থার মধ্যে ১৭টির মুদ্রণ লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এই সমস্ত সংস্থার মধ্যে রয়েছে ‘গ্রেটার কাশ্মীর’, ‘কাশ্মীর রিডার’, ‘কাশ্মীর উজমা’- যাদের সরকার-বিরোধী অবস্থান সর্বজনবিদিত।

Asif Sultan

কাশ্মীরের গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিক আসিফ সুলতান

সাংবাদিকদের হেনস্থা নিয়ে আইজি বিজয় কুমারের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে ওই রিপোর্টে। তাতে দেখা গিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২১-এর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দায়ের হয়। আট জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে UAPA ধারায় মামলা দায়ের হয়, ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় অপরাধমূলকভাবে ভীতি সঞ্চারের। ২৪ জন সাংবাদিককে তোলাবাজি এবং অন্য অপরাধের দায়ে গ্রেফতার করা হয়। একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক জুলফিকার মজিদ জানিয়েছেন, ২০২০-র জুন মাসে আচমকাই তাঁকে ডেকে পাঠায় সিআইডি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, উপত্যকার সাংবাদিকদের ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’-সংক্রান্ত নথি রাখা হচ্ছে সরকারের ঘরে মজুত রাখার জন্য। সেখানে সাধারণ ট‍্যুইট নিয়েও প্রশ্ন করা হয় তাঁকে। বারবার ডেকে পাঠিয়ে অপদস্থ করা হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে ওঠে তাঁর পরিবারের। বাধ্য হয়ে ট‍্যুইটারে কিছু লেখাই বন্ধ করে দেন তিনি। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কর্মরত মজিদ হায়দরি সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘কাশ্মীরে শয়তান এবং গভীর খাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। জঙ্গিরাও আমাদের হুমকি দেয়, আবার পুলিশও।’’

যদিও আইজি কুমার এই নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সংবাদমাধ্যমের কর্মী এবং সাংবাদিকরা পরিচয়ের অপব্যবহার করেন। এমন কাজ করেন, যাতে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা যায়। তাতে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়।’’ সাংবাদিক পরিচয়কে সামনে রেখে ভিতরে ভিতরে কিছু সাংবাদিক জঙ্গিদের হয়ে সমাজকর্মীর ভূমিকা পালন করছেন এবং দেশবিরোধী কাজে অংশ নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

অতি সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ‘দ্য ক্যারাভান’ পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক শাহিদ তান্ত্রে। কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের রোজনামচায় সেনার হস্তক্ষেপ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। তারপর থেকেই তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শাহিদের। তিনি জানিয়েছেন, নিত্যদিন তাঁর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁকেও হুমকি দিচ্ছে পুলিশ। শাহিদ জানিয়েছেন, সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি বন্ধ না করলে, চরম মূল্য চোকাতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁদের। ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি বেশি দূরে নেই বলেও তাঁকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, এমনটাই দাবি শাহিদের।

শাহিদ বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ার পর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া (Press Club of India)। পুলিশের ভূমিকায় তদন্তের দাবি তুলেছে তারা। জম্মু-কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর এব‌ং কেন্দ্রীয় সরকারকে উপত্যকায় বাকস্বাধীনতার অধিকার কায়েম রাখতেও আর্জি জানিয়েছে তারা। সাংবাদিকদের হেনস্থা, তাঁদের তাড়া করে বেড়ানো বন্ধের আর্জিও জানানো হয়েছে। যদিও পুলিশের দাবি, শাহিদ কিছু প্রভাবশালী মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন বলে তাদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ছিল। কিন্তু সরকারের সমালোচনা করাতেই শাহিদ এবং তাঁর পরিবারকে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে মত প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার। তাই অবিলম্বে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে তারা।

More Articles