একানব্বই বছর বয়সে গ্রামবাংলা নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন তরুণ মজুমদার
যখন কলকাতার অধিকাংশ প্ৰেক্ষাগৃহের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক মাল্টিপ্লেক্স, সেই অধুনা ওটিটি, ওয়েব সিরিজের জমানায় তরুন মজুমদার ঠিক করেছিলেন, ফের ছবি তৈরি করবেন। না, শহুরে মধ্যবিত্তর ফ্ল্যাটরুমের গল্প নয়, লোকেশন হবে বা...
সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। সময়টা আটের দশক। প্রথম ক্লাসের শেষে কয়েকজন বন্ধু জুটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজস্ট্রিট থেকে সোজা হেঁটে হাতিবাগান চত্ত্বর। প্রথমে গদার কচুরি, তারপর মিনার সিনেমার বাইরে টিকিটের লম্বা লাইন। দেওয়ালজোড়া 'দাদার কীর্তি' সিনেমার পোস্টারে জ্বলজ্বল করছে তাপস পাল, দেবশ্রী রায়, অনুপকুমার, মহুয়া রায়চৌধুরীর ছবি। শো হাউজফুল। ঠোঙা-ভর্তি চিনেবাদাম। সিনেমার দু'ঘণ্টা চোদ্দো মিনিট পেরোতেই হল-ভর্তি মানুষের কান্না। বাঙালি নতুন নায়ক পেল, তাপস পাল। হল থেকে বেরিয়ে সবাই 'দাদার কীর্তি'-র কেদার হতে চেয়েছিলাম সেদিনের সেই লাগামহীন জীবনে।
আসলে গল্পটা এমনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি।
বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা, কলকাতার ট্রামে বাদুড়ঝোলা ভিড়, চিলেকোঠার প্রেম, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লাইভ শো, হাউজফুল 'দাদার কীর্তি', কিছুই দেখা হয়নি। আমি যখন কলেজপড়ুয়া, ততদিনে বাঙালি ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করতে শিখে গেছে। সিনেমা-শেষে আজ আর কেউ ডিমের ডেভিল, ফাউল কাটলেট খায় না। হাতিবাগান চত্বরে বেশিরভাগ সিনেমা হলগুলো এখন শপিং ডেস্টিনেশন। তাই 'পলাতক' দেখে বোহেমিয়ান হতে চাওয়া, 'দাদার কীর্তি' দেখে কেদার হতে চাওয়া, 'ভালবাসার অনেক নাম' দেখে গ্রামবাংলার প্রতি প্রেম, আমার অন্তত ইন্টারনেটের হাত ধরেই। কিন্তু যে মানুষটা এই ভালবাসার সঙ্গে তুলনা টানলেন শরতের মেঘের, রাধালতার ফুল জড়িয়ে গেল যাঁর ক্যামেরার ট্রাইপডে, তিনি তরুণ মজুমদার। বাঙালির হল অফ ফেমে ঢুকে পড়া 'ইন্ডাস্ট্রির তনুদা' একানব্বই বছর বয়সেও সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতেন, ক্লান্ত হতেন না। বিশ্বাস করতেন, "এখনও পৃথিবীটা সুন্দর। এখনও জীবনটা বেঁচে থাকার যোগ্য।"
আরও পড়ুন: গ্রামবাংলার আবেগ বারবার জীবন্ত হয়েছে তরুণ মজুমদারের ছবিতে
মূলত একটি তথ্যচিত্রে কাজ করার সূত্রেই আলাপ নবতিপর তরুণের সঙ্গে আমার। নিয়ম করে ভদ্রলোক 'গণশক্তি'-র লাইব্রেরিতে আসতেন পড়াশুনো করতে। আট থেকে আশি সকলকেই আপনি সম্বোধন করতেন। লিকার চা আর বাকরখানির সঙ্গে ভাগ করে নিতেন তাঁর কলেজজীবন। গণসংগীত। সলিল চৌধুরী। বঙ্গরাজনীতির উত্তাল সাতের দশক।
সহকারী পরিচালক হিসেবেই কাজ শুরু করেছিলেন সিনেমাপাড়ায়। পরিচালক হতে সাহস জোগালেন উত্তমকুমার। ১৯৫৯ সালে বাঙালির চিরকালীন জুটি উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে তরুণ মজুমদার বানালেন জীবনের প্রথম ছবি 'চাওয়া পাওয়া ', অথচ তারপর আর কোনও ছবিতে জায়গা পেল না উত্তম-সুচিত্রার কালজয়ী জুটি। বরং বারবার তাঁর ছবিতে উঠে এল এমন কতগুলো মুখ, যাঁদের মূলত আমরা নায়ক হিসেবে ছবিতে দেখতে অভ্যস্ত নই। 'আংটি চাটুজ্জের ভাই' গল্প অবলম্বনে 'পলাতক' ছবিটির জন্য প্রযোজক পেতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তরুণবাবুকে। কারণ মূল চরিত্রে বেশিরভাগ প্রযোজকেরই প্রথম পছন্দ ছিল উত্তমকুমার। কিন্তু পরিচালক গোঁ ধরেছিলেন, এই চরিত্রে তিনি অনুপকুমারকেই কাস্ট করবেন। অবশেষে মুম্বই থেকে ভি শান্তারাম এগিয়ে এলেন। লেখা হলো, 'জীবনপুরের পথিক রে ভাই, কোনও দেশে সাকিন নাই।' সুর দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শেষটা ইতিহাস। রবীন্দ্রসংগীতের এক অমোঘ ব্যবহার বাঙালি দেখল সম্ভবত প্রথমবার, তরুণ-হেমন্ত জুটির হাত ধরেই।
'গণদেবতা', 'দাদার কীর্তি', 'বালিকা বধূ', 'সংসার সীমান্তে', 'পথ ও প্রাসাদ', 'নিমন্ত্রণ', 'আলো'; এমন অনেকগুলো নাম। যে নামগুলো দিনের পর দিন হলমুখো করেছে বাঙালিকে। কারণ পরিচালক তরুণ মজুমদার পুরস্কারের তুলনায় দর্শককে প্রাধান্য দিয়েছেন বারবার। ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে একাত্ম হয়েছেন গ্রামবাংলার মানুষের সঙ্গে। মানুষও তাঁকে আপন ভেবেছেন।
'আলো' সিনেমার শুটিংয়ে গিয়েছিলেন বীরভূমের পাড়ুই গ্রামে। শুটিং চলে প্রায় দু'সপ্তাহ। তারপর থেকে সেই গ্রামের ছেলে হয়ে গিয়েছেন তরুণবাবু। প্রয়াণের আগেও প্রতিমাসে ফোন করে খবর নিতেন গ্রামের মানুষের। তারাও 'দাদাবাবু' বলতে অজ্ঞান। কলকাতায় এলে দেখা করে যেত। কালীঘাটে পুজো দিত তাঁর নামে, বনকাঠি-পাড়ুই-এর বাসিন্দারা। এমনকী, সেই গ্রামেই জীবনের বাকি সময়টা থেকে যাওয়ার পরিকল্পনাও ছিল 'দাদার কীর্তি'-র স্রষ্টার। কিন্তু শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি। বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, শিমুলতলা, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, লালমাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যামেরা কাঁধে ছুটে বেড়িয়েছেন। শেষ অবধি কেন্দুপাতা চিনে নিতে অসুবিধে হতো না তাঁর, জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে বলে দিতে পারতেন হাতির পথ। আমরা যাকে 'এসেনশিয়াল' মনে করেছি, তিনি করেননি। আর যাদের 'ফাউ' ভেবেছি, তাদের গল্পই বারবার ফিরে এসেছে 'গণদেবতা'-য়, 'নিমন্ত্রণ'-এ, 'পথ ও প্রাসাদ'-এ।
কাট টু দু'হাজার বাইশ।
যখন বাম জমানা শেষ হয়েছে, যখন কলকাতার অধিকাংশ প্ৰেক্ষাগৃহের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক মাল্টিপ্লেক্স, সেই অধুনা ওটিটি, ওয়েব সিরিজের জমানায় তরুন মজুমদার ঠিক করেছিলেন, ফের ছবি তৈরি করবেন। না, শহুরে মধ্যবিত্তর ফ্ল্যাটরুমের গল্প নয়, লোকেশন হবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি। যেখানে পলাশ-মহুয়ার উদযাপন হয়। যেখানকার মানুষের ঘামের সঙ্গে তিনি মিশে গিয়েছেন আজীবন, সেখানেই। কলকাতা থেকে গাড়ি ছুটল।খেমাশুলি, লোধাশুলি, বাঁশতলা, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি। সেই যেভাবে শুটিংয়ে যেতেন। প্রথমে ওঁর গাড়ি, পিছনে বাকিদের, সেভাবে। শিরা-উপশিরা বেরিয়ে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতে এঁকে বুঝিয়ে দিলেন, শুটিং লোকেশন দেখতে যাওয়ার ম্যাপ।
২০১১-পূর্ববর্তী বাংলার সংবাদমাধ্যমে যে জায়গাগুলোর নাম আমরা প্রায়শই শুনতাম মাওবাদী আন্দোলনের হাত ধরে, সেই সমস্ত জায়গায় ছুটে বেড়ালাম। সবজে শালের জঙ্গল পেরচ্ছে গাড়ি, মাঝেমধ্যে লাল চায়ে গলা ভিজিয়ে আজীবন বামপন্থী মানুষটা চেনাচ্ছেন কেন্দুপাতার বন, মহুয়ার গ্রাম। বয়সজনিত সমস্যা রয়েছে শরীরে, তা স্পষ্ট। তবু ওই মে মাসের গরমেও ক্লান্ত হচ্ছেন না একেবারেই। সূর্য মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে কখনও নেমে পড়ছেন। ক্যামেরাম্যানকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে শট নেওয়া যেতে পারে। আমি লোকেশন স্টিল ফোটোগ্রাফারের কাজটা করেছি, তাই একটু বাড়তি দায়িত্ব ছিল। তবে পেশাদারিত্বের বাইরে যে এই কাজটা পৌঁছবে, তা আগেই জানতাম। শেষমেশ আবেগের চৌহদ্দি পেরলো। সন্ধেবেলায় হোটেল ফিরেও স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনালেন। সকালে আমাদের অনেক আগেই পৌঁছলেন খাবার টেবিলে। কখনও একগাল হাসলেন, কখনও গম্ভীর মুখে আমায় প্রশ্ন করলেন, "আপনি ছবিটা ঠিকমতো নিয়েছেন তো?"
সেই ছবি আর হলো না, চলে গেলেন তরুণ মজুমদার।
বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়খণ্ডের দিকে গাড়ি তখন ছুটছে। তরুণবাবু গুনগুন করে গাইলেন, 'মন চলে আগে আগে, আমি পড়ে রই'। জানতে ইচ্ছে করে, আংটি চাটুজ্জের ভাই কি শেষমেশ ঘরে ফিরেছিল?