গ্রামবাংলার আবেগ বারবার জীবন্ত হয়েছে তরুণ মজুমদারের ছবিতে

চাইলেই যাওয়া যায় না মাটির কাছে, কিন্তু যাকে মাটি একবার চায় নিজের কাছে, তাকে আর ফেরানো যায় না। গ্রাম থেকে গ্রামে, লক্ষ মানুষের সেই সোনার ফসলের মতো সোনার আবেগকে তিনি নিয়ে আসেন সেলুলয়েডে। তরুণ মজুমদারের তুখড় চোখ ছুটে...

এলিজি। শোকগাথা। অবিচুয়ারি। শোককে ব্যক্ত করতে কতই না শব্দ রয়েছে, কিন্তু শোকের পাশে বসে, এমন শব্দ অভিধানে এই গরিব চোখ খুঁজে পায়নি। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, 'চুপ করো, শব্দহীন হও... '- আসলে আমরা আজকাল বড্ড বেশি কথা বলি। কিন্তু গভীর কোনও আনন্দ বা বিষাদ কোনওটাই কি গোছানো শব্দ দিয়ে সাজানো যায়? শেষ অবধি কী থাকে আমাদের কাছে? থাকে কেবল শিল্পীর সৃষ্টি। চোখের দেখা আর দেখার চোখ তৈরি হতে কেটে যায় বহু বছর, আবার কেউ কেউ জন্মান সেই চোখ নিয়েই! 'তরুণ মজুমদার'- এই নাম এবং চোখ ঈশ্বরপ্রদত্ত। তাই তাঁর দেখার চোখ অন্যদের থেকে ভিন্নতর, এটা বুঝতে বেশি শব্দ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে না। শিল্প এবং শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তিনি নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই লিখে রাখেন আয়ুকে।

বাংলা ইন্ডাস্ট্রির বটবৃক্ষ তরুণ মজুমদার চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। কিন্তু এই কি চিরবিদায়- শিল্পীর তো শেষ বলে কিছু নেই। যিনি দর্শকের অন্তরকে আতসকাচে দেখতেন, বুঝতেন মননকে; তাঁর কি আদৌ চিরবিদায় সম্ভব?

আজন্ম তিনি সিনেমার সাধনা করেছেন। তাঁর হাতে বারবার বদলেছে সিনেমার বাচনভঙ্গি, আঙ্গিক। বদলেছে চরিত্রায়ণ থেকে রূপসজ্জা- সবকিছুই। আমরা যারা নয়ের দশকে জন্মেছি, বড় হয়েছি, তারা একরকমের বাঁকবদলের মধ্য দিয়েই নিজেদের শৈশবকে কাটিয়েছি। তখন সাদা-কালো টিভি আস্তে আস্তে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে নবীন, রঙিন টেলিভিশনকে। তবুও মধ্যবিত্ত বাঙালির রবিবারের দুপুরে সাদা-কালো টিভিতে 'বালিকা বধূ' কিংবা 'ফুলেশ্বরী' জড়িয়ে ছিল অন্তরঙ্গভাবে। 'প্রাইভেসি' শব্দটা তখনও এত গভীরে ছড়িয়ে যায়নি। তাই যৌথ পরিবারে একটি টিভির সামনে বসেই উদযাপন চলত বাংলা 'বই'-এর। মফসসল বা আরও একটু দূরের গ্রামবাংলায় এখনও ছায়াছবি থেকে গেছে 'বই' হয়েই। সিঙ্গল স্ক্রিনে হপ্তার পর হপ্তা 'হিট' হয়েছে তরুণ মজুমদারের সিনেমা। শুধুমাত্র কলকাতার 'বিজলি-মিনার-ছবিঘর' নয়, পাল্লা দিয়ে ভিড় জমত রানাঘাটের 'সুরেন্দ্র', কৃষ্ণনগরের 'চিত্র মন্দির', 'সঙ্গীত', শান্তিপুরের 'সুশ্রী'-তে। এই লেখা তেমনই এক মফসসলে বেড়ে ওঠা মেয়ের চোখে দেখা সিনেমার মানবকে নিয়ে। যিনি সারাটা জীবন নিজের মনন ও সৃজনের রঙে রাঙিয়েছেন আমাদের ছোটবেলা। এই লেখা বহুদিনের জমে থাকা সেই হলদে আবেগেরই প্রকাশ।

আরও পড়ুন: সংসার, মূল্যবোধ আর সহজ ভালবাসার গল্প বলে গেছেন তরুণ মজুমদার

তরুণবাবু নিজেই ফিরে গেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশের শিকড়ের কাছে। রঙিন সুতোয় বুনে দিয়েছেন বাঙালির আবেগকে। তার বহিঃপ্রকাশ মেলে সাহিত্যিক তরুণ মজুমদারের কলমেও, 'নকশিকাঁথা' কিংবা 'বাতিল চিত্রনাট্য' যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এক সিনেমাওয়ালার চোখ দিয়ে তিনি বীক্ষণ করেছেন দেশভাগকে। বাংলা ভাগের সেই স্মৃতি যেন হৃদয়ে ঘা মারে দর্শকদেরও। সিনেমা যে সমাজেরই আয়না, তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর কাজে। 'বালিকা বধূ' কিংবা 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ'-এ যেন তাকেই ধরেছেন পরিচালক। রবি ঠাকুরের 'ঘরে-বাইরে'-তে যেরকম মাস্টারমশায় চন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছিলাম, ঠিক একই ছাঁচের না হলেও 'বালিকা বধূ'- তে এমনই এক মাস্টারমশায়কে পাই। যে নিরীহ, ভদ্র; চাঁদের আলোয় আপনমনে 'ও আমার সোনার বাংলা' সুর তোলে, সে আবার 'স্বদেশি' করার অপরাধে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। তার বাক্স থেকে পাওয়া যায় হাতে বাঁধা বোমা ও 'গীতা'-র একটি খণ্ড। এর পরিণতি যে করুণ ও ফাঁসির মঞ্চেই যবনিকা পতন হচ্ছে, তা বুঝতে দেরি হয় না। যদিও বিমল করের মূল গল্পে সেই ইঙ্গিত না থাকলেও পরিচালকের চোখে এই সূক্ষ্ম ঘটনাগুলো চিত্রনাট্যে জায়গা করে নিয়েছে অনায়াসে। অন্যদিকে, 'বালিকা বধূ' রজনী-ও তার সাধের বিদেশি কাচের চুড়ি স্বামী অমলের হাতে দিয়ে বলছে, সেগুলো নদীতে ফেলে দিতে। এই ঘটনা বুঝিয়ে দেয় স্বদেশির হাওয়া তাকেও বড় করে দিচ্ছে।

চাইলেই যাওয়া যায় না মাটির কাছে, কিন্তু যাকে মাটি একবার চায় নিজের কাছে, তাকে আর ফেরানো যায় না। গ্রাম থেকে গ্রামে, লক্ষ মানুষের সেই সোনার ফসলের মতো সোনার আবেগকে তিনি নিয়ে আসেন সেলুলয়েডে। তরুণ মজুমদারের তুখড় চোখ ছুটে গেছে গ্রামবাংলার সেই সবুজের কাছে। 'পলাতক' ছবির জন্য তাই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন বীরভূম জেলার পুরন্দরপুর অঞ্চলে। ছবির জন্য খুঁজে এনেছিলেন স্থানীয় শিল্পী, যাতে নিখুঁত বাচনভঙ্গিতে পুরোটা 'পিকচার পারফেক্ট' হয়। আবার 'বালিকা বধূ'-র জন্য সেই বীরভূমই টেনেছিল তাঁকে। বীরভূমের ব্যাতিকারে শুটিং শেষ হয়। রূপনারায়ণের ওপারে বেলকোঠা বলে একটি ছোট্ট গ্রামে শুটিং হয় 'নিমন্ত্রণ'-এর। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় হয় 'গণদেবতা'। এরও প্লটের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলার গ্রাম। তাই লোকেশন নিখুঁত হওয়া দরকার। সেই ভাবেই খুঁজে বার করেন 'খণ্ড গ্রাম' নামের একটি গ্রাম- ইসলামবাজার থেকে দুবরাজপুর যাওয়ার পথে ডানদিকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার। এই সব তথ্যের হদিশ-ই পাওয়া যায় তরুণবাবুর লেখা থেকেই।

১৯৮০-তে মুক্তি পাচ্ছে 'দাদার কীর্তি' এবং ১৯৮৫-তে 'ভালবাসা ভালবাসা'। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই দুটো সিনেমা ভালবাসার, প্রেমের মায়াভাষ্য রচনা করেছে, একথা হলফ করে বলা যায়। পাশাপাশি ভেঙে গেছে প্রচলিত হিরোর মিথ। ধুতি-পাঞ্জাবি, নম্র, শান্ত মুখের তাপস পাল যেন ভালবাসার পালে দোল দিয়েছেন। অন্যদিকে, মহুয়া রায়চৌধুরী ও দেবশ্রী রায়কে বাংলা চিনেছে ঘরের মেয়ে হিসেবে। এছাড়াও এই দু'টি সিনেমার গান যেন স্বর্ণাক্ষরে গেঁথে রয়েছে বাঙালির হৃদয়ে। এরপর ২০০৩-এ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প 'কিন্নর দল'-এর ওপরে তিনি করেন 'আলো'- যেখানে পটভূমি রচনা করে বাংলার পল্লি-মা। মুখ্য চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যেন নতুনভাবে আবার ধরা দিলেন তরুণ মজুমদারের হাত ধরে দর্শকের সামনে। শহর থেকে গ্রামে এসে, সেই গ্রামকে প্রাণের জোয়ারে, রঙের আলোয় রাঙিয়ে তোলার এক অন্য উপাখ্যান উঠে এসেছে এখানে। সেই ঋতুপর্ণাকেই আবার বাঙালি পেল যৌথ পরিবারকে একই সুতোয় বেঁধে রাখার এক অন্য গল্পে। ২০০৭-এ মুক্তি পেল প্রচেত গুপ্তর গল্প নিয়ে 'চাঁদের বাড়ি'। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, কোয়েল মল্লিক, লাবণি সরকার, বাবুল সুপ্রিয় আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপোলি পর্দায় তৈরি হল ম্যাজিক। সেই মায়াতেই আজীবন বাঁধা রইল বাঙালি দর্শক।

তরুণ মজুমদার- নামটাই একটা যুগ, ইতিহাস ও সম্পদ।

 

 

More Articles