পাপের পথ থেকে সরিয়ে এনে নৈতিকতার খোঁজ! যে কারণে আবিষ্কার হয়েছিল নাগরদোলা

Roller Coasters: জুয়ো, মদ-নেশার মতো নৈতিক দুর্বলতা ছেঁকে ধরছিল তখনকার মানুষকে। আর সেই সব কিছু থেকে মানুষের মন সরিয়ে আনার জন্য়ই নাকি তৈরি হয়েছিল রোলার কোস্টার।

জীবন ঘূর্নিপাক। তাতে রং বদলায়, রূপ বদলায়। তবু জীবনকে ওই বার্ডস ভিউ থেকে দেখতে মন্দ লাগে না। আম-জীবনে আদতে এক নস্টালজিয়ার নাম নাগরদোলা। ছোটবেলার মেলার মাঠে কাঠের ছোটো নাগরদোলায় চড়া ছিল এক অনাবিল আনন্দের নাম। তার পরে একটু বড় হয়ে ইলেকট্রিক নাগরদোলা। সেখান থেকে বিনোদন পার্কের রোলার কোস্টার। সলিল চৌধুরি দেখেছিলেন, ঘুরন্ত নাগরদোলার দুরন্ত ঘূর্ণি কীভাবে কখনও কাঁদায়, কখনও ভোলায়। আরও পরে আধুনিক গায়ক শিলাজিৎ গাইলেন, 'নাগরদোলা দিচ্ছে পাক, পাকের তালে ঘুরতে থাক...' ঘুরতে ঘুরতে পোড়ার কথা বললেন গায়ক। আসলেই কি নাগরদোলা পোড়ায়? শূন্যে তুলে মুহূর্তে দিকভুল, ঠিকভুলকে চিনিয়ে দেওয়াই যার স্বভাব, সে-ও কি পোড়ায়। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা। নাগরদোলা, যা এখন নাকি শুধুমাত্র বিনোদনপার্কের অতি পরিচিত 'রাইড' বা মেলার আকর্ষণ হিসেবেই পরিচিত, সেই নাগরদোলা এককালে মানুষের জীবনকে নতুন দিশা দেখাত। যা 'জ্বলন্ত রৌরব'-র শাস্তি থেকে এককালে বাঁচিয়ে এনেছে অসংখ্য মার্কিনকে।

আরও পড়ুন: অটূট সম্পর্কের টানে গাছে পরানো হয় তালা, যে কারণে বিখ্যাত রাশিয়ার প্যাডলক ট্রি পার্ক

প্রায় সমস্ত সংস্কৃতিতেই পাপের ধারণা যেমন ছিল, পাপস্খলনের রাস্তাও ছিল। যাকে বলে প্রায়ঃশ্চিত্য। উনিশ শতক পরবর্তী সময়ে নাকি এই রোলারকোস্টার ছিল পাপবোধ থেকে নিস্তার পাওয়ার একটি নতুন মাধ্যম। উনিশ শতকের শেষের দিকটা ছিস সার্বিক ভাবে বদলের সময়। আমেরিকার সভ্যতা, সংস্কৃতি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল সে সময়। সভ্যতার সঙ্গে ডাল-পালা বিস্তার করছিল মানবিক অবক্ষয়। জুয়ো, মদ-নেশার মতো নৈতিক দুর্বলতা ছেঁকে ধরছিল তখনকার মানুষকে। আর সেই সব কিছু থেকে মানুষের মন সরিয়ে আনার জন্য়ই নাকি তৈরি হয়েছিল রোলার কোস্টার।

লামার্কাস অ্যাডনা থম্পসন। রোলার কোস্টারের ভাবনার নেপথ্যে ছিলেন মার্কিন এই ব্যবসায়ী। নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী নানা ধরনের বিনোদনের হাত থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে নতুন এক ধরনের বিনোদনের হদিস দিলেন থম্পসন। ১৮৮৪ সালে প্রথমবার বিশ্বের সামনে রোলারকোস্টার এনে হাজির করলেন তিনি। নিউ ইয়র্কের কোনি আইল্যান্ডে বসল সেই রোলার কোস্টার, নাম হল সুইচব্যাক রেইলওয়ে। শুধু ব্যবসা করাই নয়, নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজে এক ধরনের স্থায়ী প্রভাব ফেলার ইচ্ছা ছিল থম্পসনের। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই রোলারকোস্টারের মতো বিনোদন তৈরি করলেন তিনি। যা মদ-জুয়ো-নেশার মতো সামাজিক কুপথ থেকে মানুষকে সরিয়ে এনে দেবে এক অন্যতর আনন্দের খোঁজ।

আসলে থম্পসন বড় হয়েছিলেন এক ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান পরিবারে। ফলে ভিতরে ভিতরে কোথাও সেই ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা শিকড়ে বসেছিল থম্পসনের। সেই ধর্মবোধেরও কোনও অংশে কমতি ছিল না তার ভিতরে। এদিকে শিল্পোন্নয়ন এ নগরায়নের ছোঁয়ায় খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল সমাজটা। বদলে যাচ্ছিল তার নীতিবোধ, আদর্শ। যার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না থম্পসনের পক্ষে। আশপাশে তখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্যালোঁ, বিভিন্ন জুয়ো খেলার আসর। অর্থাৎ কিনা সব মিলিয়ে ঘুন ধরে গিয়েছে নৈতিক সমাজের কাঠামোয়। কিন্তু খ্রিস্টান বিশ্বাস থম্পসনকে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে এর থেকে উত্থানের রাস্তা আছে। আর সেই রাস্তাটাই খোঁজা শুরু করেন থম্পসন।

কী হতে পারত এই সব নৈতিক অবক্ষয় থেকে উত্থানের রাস্তা? যা মানুষের নৈতিক বোধ, পরিবারের সঙ্গে একাত্মবোধের মতো জায়গাগুলোকে ফিরিয়ে আনবে। মানুষকে আনন্দ দেবে। সেখান থেকেই এল বিনোদনপার্কের ভাবনা, যেখানে মানুষ বসে নির্ভেজাল আনন্দ পেতে পারে পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী চোখ এর ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির অঙ্কটাও ভালোই বুঝতে পারছিল বেশ। যেভাবে ক্রমশ সুইচব্যাক রেলওয়ে বিনোদন পার্কের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল মার্কিনদের মধ্যে, তাতে বেশ আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন থম্পসন। অবশেষে ওই রোলারকোস্টার ডিজাইনের পেটেন্ট পান থম্পসন এবং এল এ থম্পসন সিনিক রেলওয়ে কোম্পানি বলে একটি সংস্থা তৈরি করেন। ক্রমশ দেশ জুড়ে বাড়তে থাকে বিনোদন পার্কের চাহিদা।

প্রাথমিক ভাবে রোলারকোস্টার বা নাগরদোলা তৈরি হয়েছিল কাঠ দিয়ে। যত দিন গেল উন্নত হতে লাগল তার কাঠামো। কাঠের জায়গায় এল স্টিল, আরও নানা প্রযুক্তিগত বদল শরীরে আয়ত্ত করতে লাগল নাগরদোলা। আরও বিনোদন, আরও আনন্দের খোঁজে ক্রমশ এগোতে লাগল সেদিনের রোলারকোস্টার। এমনকী ঘূর্ণনের গতি, দিক- সব ব্যাপারেই ব্যাপক ভাবে বদল আসতে লাগল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। শুধু বিনোদন পার্কই নয়, জন্ম হল থিম পার্কের। আর নতুন নতুন দিশায় এগোতে লাগল আধুনিক নাগরদোলা।

কিন্তু সমাজ কি বদলালো! তার উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ। কিছুটা হলেও সেসময় বদল আনতে পেরেছিল এই নাগরদোলা। মদ-জুয়োর মতো সর্বনাশা নেশার থেকে বেরিয়ে অন্য আনন্দের খোঁজে বারবার এইসব বিনোদন পার্কে ঢুঁ মারতে লাগলেন মানুষ। বাড়ল পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের টান। আসলে এই অদ্ভুত রাইডে চড়ে শিশুর মতোই নির্মল আনন্দ পাচ্ছিলেন মানুষ। হয়তো অন্তরের যে নিষ্পাপ শিশুমন তাকেই পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল এই রোলার কোস্টার, যা অবক্ষয়ী সমাজের মুখে অ্যান্টিডোটের মতো।

আরও পড়ুন: জানেন, এত ঢ্যাঙা গলা নিয়ে কীভাবে ঘুমোয় জিরাফরা?

এককালে যা ছিল পাপ থেকে বাঁচার পথ, তা ক্রমশ নির্ভেজাল আনন্দের রূপ নিল। সেই নৈতিক দায়িত্বের গুরুভার আর তার কাঁধে রইল না। বরং শুধু এবং শুধুমাত্র আনন্দ, উত্তেজনা আর হুল্লোড়ের চাবিকাঠি হয়ে রইল নাগরদোলা। আর আমাদের মতো অনেকে, যাঁরা ক্রমশ শহরের দাপটে মফস্বলের বৈশাখী-পৌষ মেলাকে পিছনে ফেলে এসেছেন অনেকটাই, তাঁদের কাছে আজও শুধুমাত্র নস্টালজিয়ার অন্য নাম এই নাগরদোলা।

More Articles