খাস কলকাতায় বাগানে ঘুরত জোড়া রয়্যাল বেঙ্গল, রইল 'বাঘবাড়ি'-র গল্প
কলকাতায় সৌরীশচন্দ্রর বাড়ির বাগানে ঘুরে বেড়াত জোড়া বাঘ।
গল্পটা সৌরীশচন্দ্র রায়ের। নদিয়ার মানুষদের কাছে তিনি খ্যাত ছিলেন 'রাজাসাহেব' নামে। ১৯২৮ সালে পিতা ক্ষৌণীশচন্দ্র রায়বাহাদুরের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তিনি। তাঁর প্রতিপত্তি দেখে তাঁকেও অচিরেই 'রায়বাহাদুর' উপাধি দেন ইংরেজরা। সৌরীশচন্দ্রের তখন প্রবল প্রতাপ। কলকাতার প্রাসাদতুল্য 'নদিয়া হাউজ'-এ থাকেন তিনি। তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য টেক্কা দেয় শহরের তাবড় তাবড় ধনকুবেরদের। এমন সময় বন্ধুদের অবাক করে দিয়ে তিনি এক কাণ্ড করে বসলেন। মধ্যপ্রদেশে শিকারে গিয়ে সেখান থেকে ফিরলেন এক জোড়া বাঘ দত্তক নিয়ে। তাঁর পরিচিতরা স্তম্ভিত, রাজাসাহেব করেছেন কী? কলকাতায় একসময় বাঘের আনাগোনা ছিল বলে শোনা যায়। মাঝেমধ্যেই সুন্দরবন থেকে শহরতলির দিকে ছিটকে আসত নেকড়ে বা বাঘরোল। সৃষ্টি হত ত্রাস। এ নিয়ে সেসময় সংবাদপত্রে লেখালিখিও হয়েছে। কিন্তু বাঘ দত্তক নেওয়ার মতো ঘটনা সেভাবে ঘটেনি। পরবর্তীতে সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের মূল কান্ডারি সরোজ রায়চৌধুরি 'খৈরি' নামে একটি বাঘ পুষেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ যে জোড়া বাঘের গপ্পো।
আসলে কলেজজীবন থেকেই সৌরীশচন্দ্র ছিলেন দুর্ধর্ষ শিকারি। ইতিহাস আর শিকার, এই নিয়েই চলত তাঁর দিনযাপন। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করলেন তিনি। পাশাপাশি চলতে লাগল শিকারচর্চা। সালটা ছিল ১৯৫৮। দুরন্ত শিকারি হিসেবে সৌরীশচন্দ্রের নাম তখন প্রায় সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, এমতাবস্থায় মধ্যপ্রদেশ থেকে সরকারি তলব এল তাঁর। এক নরখাদক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আবির্ভাবের ফলে এলাকার মানুষজন নাকি খুবই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হল, তিনি যেন অবিলম্বে মধ্য ভারতে পৌঁছে এর একটা প্রতিকার করেন। সৌরীশচন্দ্র বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়লেন।
মধ্যপ্রদেশের ঘন জঙ্গল-পরিবেষ্টিত গ্রাম। সেখান থেকে বাঘ খুঁজে বের করা এক কঠিন ব্যাপার। প্রায় দিনপনেরো বাঘের সন্ধান করতে করতে কালঘাম ছুটে গেল সৌরীশচন্দ্রের। গ্রামবাসীদের মুখে বর্ণনা শুনে এগিয়ে গেলেন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। কিন্তু বাঘের দেখা নেই। সৌরীশচন্দ্র ভাবলেন, আর নয়, অনেক হয়েছে, এবার ফেরা যাক। সেই মতো বাড়ি ফেরার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করলেন তিনি। এমন সময় জানা গেল, তার সন্ধান পাওয়া গেছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট-সহ আরও কিছু অফিসারকে নিয়ে বাঘ খুঁজতে রওনা দিলেন তিনি। অবশেষে পাকা হাতের নিশানায় তাকে শিকার করলেন, কিন্তু তার পরেই বুঝলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। না জেনে তিনি যাকে হত্যা করেছেন সে ম্যানইটার তো নয়ই, উপরন্তু, দুই সন্তানের জননী। গ্রামবাসীরা ভুল খবর দিয়েছিল তাঁকে। কোনও বাঘিনীকে হত্যা করা ছিল সৌরীশচন্দ্রের নীতিবিরুদ্ধ। অনুশোচনায় ভরে গেল তাঁর মন। বাচ্চাগুলোর কী হবে এবার? হঠাৎ সৌরীশচন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিই দত্তক নেবেন তাদের। প্রসঙ্গত, এই কাহিনি যেন মনে করায় জিম করবেটকে।
আরও পড়ুন: বারবার হার মেনেছে ব্রিটিশরা || কেন ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল বাংলার এই রাজবংশের নাম?
ফের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় মানুষজন খবর দিলেন, এবার সত্যিই নরখাদকের দেখা পাওয়া গেছে। আটজনকে হত্যা করে সে কেড়ে নিয়েছে তার নবমতম শিকারের প্রাণ। সৌরীশচন্দ্র আবার ছুটলেন তার পিছনে। এবার অবশ্য কোনও ভুল হল না। অব্যর্থ লক্ষভেদে নরখাদককেই হত্যা করলেন তিনি। তারপর তাঁর নবলব্ধ ব্যাঘ্রসন্তানদের নিয়ে ফিরে এলেন কলকাতা।
বাঘের বাচ্চাদু'টির মধ্যে একটি ছিল মেয়ে, অন্যজন ছেলে। সৌরীশচন্দ্র ছেলেটির নাম রাখলেন 'স্যামসন', মেয়েটির নাম দেওয়া হল 'ডেলিলা'। তাঁর 'নদিয়া হাউজ'-এর বাগানেই বেড়ে উঠতে লাগল তারা। তাদের ডাকে পাড়ার লোকদের ঘুম ছুটে যেত বলে সাক্ষী দেয় ইতিহাস। বাঘের ভয়ে বাইরের মানুষজন বাড়ির ধারেপাশেও ঘেঁষেন না। কালে কালে স্থানীয়দের কাছে 'নদিয়া হাউজ' হয়ে উঠল 'বাঘবাড়ি'। সৌরীশচন্দ্রর প্রাসাদকে এই নামেই ডাকতে লাগলেন তাঁরা। 'স্যামসন' আর 'ডেলিলা'-কে আজীবন ধরে রাখা যায়নি। ১৯৭২ সালে পাশ হল 'বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন'। এরপর হিসেবমতো আর বাড়িতে বাঘ রাখা চলে না। ফলত, তাঁদের স্থান পরিবর্তন করে ২ নং ব্রাইট স্ট্রিটের ঠিকানা থেকে নিয়ে যাওয়া হল চিড়িয়াখানায়।
তথ্যঋণ: কলকাতার বাঘবাড়ি: একটি বিস্মৃত অধ্যায়। সঞ্জিত দত্ত