নবাবকে মুখ ভেংচে এসেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে! দেশপ্রেমিক গোপাল ভাঁড়ের গল্প

গোপাল ভাঁড়। বিখ্যাত হাস্যরসিক। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে তাঁর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে।তিনি ছিলেন নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর (১৭১০-১৭৮৩) রাজসভার অন্যতম সভাসদ বা বিদূষক। অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, এবং হাস্যরসে পরিপূর্ণ এক ব্যক্তি। আসলে তিনি ছিলেন মধ্যযুগের একজন রম্যগল্পকার।তিনি কৃষ্ণনগরের উত্তরদিকে ঘূর্ণি নামের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন (যদিও সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না)। অষ্টাদশ শতাব্দীতে গোপাল ভাঁড়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন হিসেবে মর্যাদা পান।

গোপাল ভাঁড়ের সব গল্পই আত্মজীবনীমূলক। চরিত্র হিসেবে ৩০০ বছরের বেশি পুরনো নয় গোপালের জীবনী। 'বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা' বইটিতে অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, "গোপাল রসিক-চূড়ামণি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন।" 'নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়' বই-এর লেখক নগেন্দ্রনাথ দাস নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর হিসেবে দাবি করেন এবং গোপাল ভাঁড়ের একটি বংশতালিকা প্রকাশ করেন। সেই তালিকায় গোপাল ভাঁড়ের প্রপিতামহ থেকে শুরু করে তাঁর ভাই, মা, স্ত্রী, কন্যা- সকলের পরিচয় পাওয়া যায়।


নগেন্দ্রনাথ দাস লিখেছেন, গোপাল ভাঁড়ের পদবি ছিল 'নাই'; অর্থাৎ, নাপিত। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে রাজভান্ডারি হিসেবে নিয়োগ করার ফলে তিনি ভান্ডারি থেকে ভান্ড এবং অপভ্রংশে শেষে 'ভাঁড়' বলে পরিচিতি লাভ করেন।

আরও পড়ুন: অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জীবন কাটিয়েছেন ভবানী মায়ের সাধনায় || ভবাপাগলা আজও মানুষের মনে

অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, গোপাল ভাঁড় নামে কোনও চরিত্র মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজদরবারে কোনওদিন ছিল না, সবটাই কাল্পনিক। এমন ভাবার পিছনে যুক্তি অবশ্যই আছে। কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি 'রায়গুণাকার' ভারতচন্দ্র, তাঁর লেখা অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে রাজা মানসিংহের সময় থেকে শুরু করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল পর্যন্ত তৎকালীন সময়, সমাজ এবং মহারাজার সভাসদ- প্রত্যেকের বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবৃত করে গেছেন, কিন্তু কোথাও গোপাল ভাঁড়ের উল্লেখ নেই। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রর নবরত্ন সভার প্রত্যেকের পরিচয়, তাঁদের অস্তিত্ব এবং তাদের গুণকীর্তির বিবরণ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে তাঁদের অস্তিত্বের কথা। কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্বের কোনও প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি, শুধুমাত্র কিছু কল্পনাপ্রসূত কাহিনি ছাড়া। গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্বের সন্ধান করতে গিয়ে গবেষকরা নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে, তার কোনও নথি পাওয়া যায়নি।কেউ কেউ বলেন, তিনি নদিয়ার ঘূর্ণি নামক একটি গ্রামে জন্মেছিলেন, আবার অনেকের মতে তিনি হুগলি জেলার খানাকূলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মবৃত্তান্তের সঠিক পরিচয় সম্বন্ধে কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। গোপালের কোনও ছবি কেউ কখনও দেখেনি। গোপালের যে ছবি আমরা দেখে থাকি, তা আমাদের কল্পনাপ্রসূত।

রসসম্রাট গোপাল ভাঁড় তবু বাঙালির কাছে চিরনবীন। ছোট-বড় সকলের কাছে অতি প্রিয় চরিত্র গোপাল ভাঁড়। মধ্যযুগে খনার বচন যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনই প্রসিদ্ধ গোপালের জীবনমুখী গল্পগুলো। আবহমানকাল ধরে প্রচলিত তাঁর জীবনরস-সমৃদ্ধ গল্পের ভান্ডার বাংলার এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুখরোচক গল্প হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। তাঁর বেশ কিছু গল্প প্রবাদের মতো ব্যবহার হয় এবং বেশ কিছু গল্প অত্যন্ত শিক্ষামূলক ও জীবনমুখী।

গোপাল ভাঁড়ের সব গল্পেই আমরা নবাবি আমলের সময়কালকে পেয়ে থাকি। পরাধীন ভারতের ইংরেজ শাসনের সময়কালকে পাই না। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদদৌল্লাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল, তাতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শামিল ছিলেন। গোপাল ভাঁড়ের সব গল্পেই আমরা তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাই।এই সময়েও গোপাল তাঁর দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝেছিলেন, ক্লাইভকে সমর্থন করার অর্থ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া। তিনি বারংবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে সমর্থন তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু মহারাজা কোনওভাবেই নিবৃত্ত হননি। মহারাজাকে গোপাল বলেন, ইংরেজ সূচ হয়ে ঢুকবে এবং বর্শা হয়ে বের হবে। তাদের স্বার্থবিরোধী কাজ করলে শূলে চড়াতেও দু'বার ভাববে না। এমন সর্বনাশা খেলায় মহারাজার অংশ না নেওয়াই শ্রেয় হবে। সভাসদ সকলেই মহারাজাকে সমর্থন করেন এবং গোপালকে বিদ্রুপ করতে থাকেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন গোপালের সামনে একটি শর্ত রাখেন। তাতে বলা হয়, যদি গোপাল নবাব সিরাজউদদৌল্লাকে 'মুখ ভেংচে' আসতে পারেন, তাহলে মহারাজা সমর্থন তুলে নেবেন এবং নবাবের বিরুদ্ধে যাবেন না।

এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গোপাল মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দেন, কিন্তু নবাবি দরবারে প্রবেশাধিকার মেলে না। ভাগীরথীর তীরে হীরাঝিল প্রাসাদে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। এমতাবস্থায় মরিয়া হয়ে গোপাল প্রহরীর হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন।ততক্ষণাৎ গোপালকে বিচারের জন্য রাজদরবারে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে নবাবের প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু 'মুখ ভেংচে' গেলেন। তখন নবাব তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুনেও হাসি হাসি মুখ করে গোপাল একই কাজ করে যেতে লাগলেন, নবাব ভাবলেন, এ নিশ্চয় পাগল। তাঁকে তখন মুক্তি দেওয়া হল। রাজদরবারে ফিরে একথা জানানোর পরেও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ‌তাঁর নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। গোপাল ভাঁড় ভাবলেন, নিজের জীবন তুচ্ছ করে, দেশকে রক্ষা করতে এবং মহারাজার আদেশ মানতে এত বড় বিপদের ঝুঁকি নেওয়ার পরেও যখন মহারাজাকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না, তখন এখানে আর থাকব না। অত্যন্ত ব্যথিতচিত্তে, রাতের অন্ধকারে পরিবার নিয়ে গোপাল ভাঁড় রাজধানী পরিত্যাগ করেন।এরপর থেকে গোপাল ভাঁড়ের সন্ধান আর মেলেনি। তিনি কবে, কোথায় দেহত্যাগ করেন জানা যায়নি।

কিংবদন্তি মানলে বলতে হয়, গোপাল শুধুমাত্র হাস্যরসিক বা ভাঁড় ছিলেন না।তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।

রস-চূড়ামণি, হাস্যরসিক, রস-সম্রাট, রসরাজ এই মানুষটি আপামর বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরদিন বিরাজ করবেন।

More Articles