কান্না বিক্রিই পেশা, উচ্চবর্ণের বঞ্চনায় যেভাবে লেখা হয় রুদালিদের বারোমাস্যা!
Rudaali: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তি এই রুদালিদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। সেক্ষেত্রে পরিবারের লোকজনের কাছে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জরুরি তথ্য নিয়ে নেয় মহিলারা।
কথায় বলে, কাজের কোনও ছোট বড় নেই এবং কাজের কোনও ধর্ম নেই। কেউ ব্যবসা করে রোজগার করে তো কেউ চাষ করে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ এই ভারতে কিছু বিচিত্র পেশাও আছে যার সম্বন্ধে অনেকেই অবগত নয়। ভারতের রাজস্থানে এরকম বিচিত্র পেশার এক সম্প্রদায় বাস করে, ‘রুদালি’ সম্প্রদায়। বহুকাল ধরেই এই সম্প্রদায়ের মহিলাদের একমাত্র পেশা হল মৃত ব্যক্তির জন্য চোখের জল ঝরানো! আর এই পেশার দ্বারাই জীবিকা নির্বাহ করেন রাজস্থানের ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের মহিলারা।
রুদালি কারা?
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কারা এই রুদালি সম্প্রদায় আর কীভাবে সমাজে তাদের এই বিচিত্র পেশার প্রচলন হল? ‘রুদালি’ আসলে কারা, এর উত্তরে বলা যায়, রাজস্থানে যদি কেউ নীচু বর্ণের মানুষ হন এবং তাঁরা যদি অর্থনৈতিক কষ্টে থাকেন তাহলে তাঁদেরকে রুদালি হতে বাধ্য করে সমাজের উচ্চবর্ণ পরিবারগুলি। এ প্রথা এখনও বিদ্যমান। সমাজের উচ্চবর্ণের বা জমিদার শ্রেণির মানুষ নীচু বর্ণের দরিদ্রদের রুদালি হতে বাধ্য করে। এই শ্রেণির মানুষদের চোখের জল টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই কিনে নেয় উচ্চবর্ণের জমিদার শ্রেণি। সাধারণ মানুষের কাছে এটি অদ্ভুত পেশা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, ভারতের রাজস্থানে কয়েক শত বছর ধরে টিকে রয়েছে রুদালি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। এখনও রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে কালো পোশাক পরিহিত রুদালিদের দেখা মেলে।
রাজস্থানের নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, “যতদিন স্বামী বেঁচে থাকবে ততদিনই গ্রামে সম্মান থাকবে।” অর্থাৎ স্বামী বেঁচে থাকলে সংসার থাকে, জীবনে রঙ থাকে। স্বামী মারা গেলে পেটের দায়ে কালো পোশাকে নিজেকে ঢেকে রুদালি পেশায় নাম লেখাতে হয়। রুদালিদের পোশাকের রঙ কালো যেহেতু কালো মৃত্যুর রঙ। বিশ্বাস অনুযায়ী, যমের প্রিয় রঙও নাকি কালো তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে কালো পোশাক পরেন মহিলারা। চোখে মোটা করে কাজল পরেন। গলায় নানারকম রাজস্থানি কারুকাজের উল্কি আঁকা। গ্রামের ঠাকুর বা জমিদার সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে বা শেষ সময় উপস্থিত হলে রুদালিদের ডাক পড়ে।
এখানেই প্রশ্ন আসে যে, জমিদার বাড়ির নিজস্ব আত্মীয় থাকতে কেন বাইরে থেকে মহিলাদের ভাড়া করে আনা হয় কাঁদার জন্য? এই প্রসঙ্গে রোর মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের মানুষ মৃত্যুর খবর পেয়ে ভিড় জমান। সমাজের উচ্চবর্ণের নারীদের অন্য বর্ণ-গোত্রের মানুষের সামনে নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শনের অনুমতি নেই রাজস্থানে। উচ্চবর্ণের নারীদের বাড়ির অন্দরমহলেই স্বাভাবিকভাবে থাকতে হবে। কিন্তু সমাজের সামনে নিজেদের প্রতিপত্তি বা কষ্ট জাহির করতে গেলেও কান্নাকাটি করার জন্য কিছু লোক দরকার। বলা ভালো, উচ্চবর্ণের এই চাহিদা থেকেই জন্ম নেয় রুদালিরা। অন্দরের মহিলাদের হৃদয়ের জমানো চরম দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় রুদালি নারীরা। রুদালিদের এই পেশা অর্থহীন মনে হলেও রাজস্থানের কিছু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে এ এক নির্মম সত্য। এখানেই শেষ নয়।
কলকাতার এক সাংবাদিক নিধি দুগার তাঁর ‘দ্য লস্ট জেনারেশন’ বইতে কিছু বিলুপ্ত প্রথার কথা বলেছেন। সেই বইতে রাজস্থানের এক উচ্চবর্ণের জমিদারের নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে রুদালিদের সম্পর্কে এক স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “আমাদের রাজ পরিবারের কেউ মারা গেলে তো কান্নার জন্য একজন লোক চাই, তা-ই না? নারীদের মস্তিষ্ক বিধাতা বানিয়েছেনই এমন করে, যাতে তাঁরা দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলো ভালো করে বুঝতে পারে। তাঁদের মন খুবই নরম। অন্দরমহলের মেয়েদের তো আমরা বাড়ির বাইরে বের হতে দিতে পারি না। পরপুরুষের সামনে গিয়ে তাঁরা কাঁদলে আমাদের পরিবারের মাথা নিচু হয়ে যাবে। স্বামী মরুক আর বাবা মরুক, আগে তাঁদেরকে নিজেদের মর্যাদাটা বুঝতে হবে। কাজেই তাঁদের হয়ে কান্নার কাজটা করে দেয় নিচু জাতের মহিলারা, রুদালিরা। রুদালিদের কান্নায় পুরো গ্রাম বুঝতে পারে তাঁদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সবার দুঃখের প্রতিনিধিত্ব করতেই ডেকে আনা হয় রুদালিদের।”
আরও পড়ুন- আজও বিলিতি খড়্গে বলি হয় তিনশো বছর পুরনো হালদারবাড়ির কালীপুজোয়
রুদালিদের ব্যক্তিগত জীবন
রুদালিদের পেশার মতোই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও খুব একটা সুখকর নয়। সমাজে দু’ধরনের রুদালি সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। দারোগি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে রুদালিরা আসেন বিয়ের সময় যৌতুক বা ‘দহেজ’ হিসেবে, পরিবারের সদস্য হয়ে। তবে ঠাকুরদের হাভেলি বা অন্দরমহলে এঁরা স্থান পান না। তাঁরা থাকেন বাইরে আলাদা কুটিরে, একা। পরিবারের অন্তঃপুরে রুদালিদের জন্য জায়গা নেই। অধিকার নেই সংসার বা বিয়ে করার। ঠাকুর পরিবারের পুরুষদের যথেচ্ছ ব্যবহারে খুব অল্পদিনেই তাঁরা সন্তানসম্ভবা হয়। কিন্তু সন্তানের কোনও পিতৃপরিচয় থাকে না। শিশুরা রুদালির সন্তান নামেই পরিচিত হয়। পুত্রসন্তান হলে তাঁরা ভবিষ্যতে ঠাকুর পরিবারের পরিচারকরূপে নিযুক্ত হয়। আর কন্যাসন্তান হলে ঠাকুর পরিবারের মতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে মেরে ফেলা হয়। যদি কোনওভাবে বেঁচে যায় তাহলে সেও ভবিষ্যতে রুদালি প্রথাকে বয়ে নিয়ে চলে মায়ের মতোই।
রাজস্থানি প্রবাদ অনুযায়ী, ‘পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি না এক, লেনো ভালো না বাপকো, সাহিব রাখিয়া টেক।’ অর্থাৎ খালি পায়ে কয়েক ক্রোশ হাঁটাও ভাল, কিন্তু বাড়িতে যেন কোনও কন্যার জন্ম না হয়। ভয়ঙ্কর পণপ্রথার চাপেই কন্যাসন্তানের এত অনাদর! ঠাকুর পরিবারের রুদালিদের কাজ হল দিনের বেলা ঠাকুরের শিশুদের দেখাশোনা করা, জল তুলে দেওয়া, এছাড়া নানান ফাইফরমাশ খাটা, আর রাতে ঠাকুরদের মনোরঞ্জন করা। এছাড়া ঠাকুর পরিবারে কেউ মারা গেলে কাঁদার জন্য এদের প্রয়োজন হয়। কাঁদার জন্যই জন্ম হয়েছে যেন আস্ত এক গোষ্ঠীর। অনেক ক্ষেত্রেই এই শোকের উৎসব চলতে থাকে টানা ১২ দিন ধরে। যত বেশি কান্না আর শোকের বহিঃপ্রকাশ, সেই ঠাকুরের তত বেশি প্রভাব প্রতিপত্তি বলে বিশ্বাস করা হয়।
মিরাসি সম্প্রদায়ের রুদালিরা অবশ্য ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে থাকে না। এরা গ্রামের বাইরে আলাদা থাকে। নিচুজাত বলে গ্রামের কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে এদের প্রবেশাধিকার নেই। শুধু ডাক পড়ে উচ্চবংশীয় পুরুষদের মৃত্যু হলে। তবে এরাও ঠাকুরদের হাতে যথেচ্ছভাবে অত্যাচারিত হয়। রুদালিদের আরাধ্য দেবতা ভৈরুজি। তিনি নিজেও এক কামুক দেবতা, যিনি অসংখ্য নিচুজাতের নারীর হেনস্থা করেছেন। এই দেবতার লাম্পট্যের গল্প রাজস্থানের গ্রামগুলিতে মুখে মুখে ফেরে। তবু এই ভৈরুজিই রুদালিদের নিয়তি। এই দেবতারই আরাধনা করে আসছে রুদালিরা বছরের পর বছর ধরে।
কীভাবে অচেনা মানুষের দুঃখে কাঁদেন রুদালিরা?
রুদালিদের কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে লিঙ্গ, জাত, শ্রেণি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি আগে বিবেচনা করা হয়। যদি কেউ নিচু জাতের হন আর অর্থের খুব বেশি প্রয়োজন বলে জমিদার শ্রেণি মনে করে, তাহলে জোর করেও অনেককে রুদালি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়ার নজির আছে। নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে, আবেগ অনুভূতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের চাহিদা মতো চোখের জল ঝরানো এই নারীদের অবশ্য সমাজে তেমন কোনও কদর নেই। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে না চিনেও তাঁর জন্য অঝোরে কাঁদা- এই কঠিন কাজের বিনিময়ে যে অর্থ প্রদান করা হয়, তাকে নামমাত্র বললেও কম বলা হবে। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও মরা বাড়িতে গিয়ে কাঁদার জন্য ৫-৬ টাকা করে দেওয়া হত। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়া, বুক চাপড়ানো, শ্মশান ঘাটে গিয়ে আছড়ে পড়া- এমন যত কলাকৌশল সেই কান্নার সঙ্গে যুক্ত হত, ততই তাঁদের অর্থের পরিমাণ বেড়ে যেত। টাকার সঙ্গে পুরনো কাপড়, ভাত, রুটিও দেওয়া হতো কোনও কোনও বাড়ি থেকে। তবে খাবারের মধ্যে কাঁচা পেঁয়াজ আর বাদি রুটিই ছিল বেশি।
কখনও কখনও রুদালিদের টানা ১২ দিনও কাঁদতে হয়। যত দীর্ঘদিনব্যাপী শোকের প্রকাশ চলবে, ততই লোকজন ওই পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে কানাঘুষা করবে। পারফরম্যান্স ভালো করতে তাই পেশাদার রুদালিরা নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করার চেষ্টা করে। সবসময় চাইলেই চোখে জল আসে না, তখন শুধু মুখের বিলাপই ভরসা। তবে যারা পুরোপুরি পেশাদার, তাঁদের নিজস্ব কিছু কৌশল আছে চোখে জল আনার। কেউ কেউ থুতু লাগিয়ে মুখে জলের রেখা তৈরি করেন, কেউ বা এক ধরনের গাছের শেকড় ব্যবহার করেন যা অনেকটা গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। কাজলের মতো এক ধরনের কালিও পাওয়া যায়, যা চোখে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে তীব্র জ্বলুনি শুরু হয় আর চোখের জল পড়তে থাকে।
জমিদার পরিবারের কেউ তাঁদের বাড়ির আত্মীয়ের মৃত্যু ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে রুদালিদের বুকফাটা কান্নায় গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তি এই রুদালিদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। সেক্ষেত্রে পরিবারের লোকজনের কাছে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জরুরি তথ্য নিয়ে নেয় মহিলারা। এরপর শুরু হয় তাঁর নামে বুক চাপড়ে কান্না। সে এমন কান্না যা পাড়া প্রতিবেশীকেও কাঁদতে বাধ্য করে। নিজের বুকে করাঘাত করে, মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে সকলকে জানানো হয় মৃত ব্যক্তি কত মহান ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ায় কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল গ্রামের। দু’ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ওড়না ভিজে গেলেও চোখ মোছে না রুদালিরা।
নানা সূত্রের তথ্য অনুসারে আরও জানা যায়, রাজস্থানের কিছু অজপাড়াগাঁয়ে এখনও রুদালিদের দিয়ে কান্না এবং বিলাপ করিয়ে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, অভিজাত ইংরেজ সমাজে এমন শোককারী বা Mourner-দের প্রচলন আছে। সেখানে কালো রঙের কফিনবাহী গাড়িতে করে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর, তার সামনে সামনে কান্নার অভিনয় করে চলতে থাকে Mourner-রা। তাই একথা ভাবলে খুব বেশি অযৌক্তিক হয়ত হবে না যে, এই রুদালি প্রথা ইংরেজ রাজত্বের সমসাময়িক। বিশেষত ভারতের রাজা জমিদার ও সুলতান বা নবাবরা ইংরেজদের অন্ধ অনুকরণকেই তাদের বিশেষত্ব বলে গণনা করতেন।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই ‘professional mourners’ ছিল এবং আছে। কিন্তু কোথাও এই পেশা এমন অপমানের নয়। জাতপাতের কড়াকড়ি কোথাও তাঁদের এভাবে প্রান্তিক করে দেয় না। সারা পৃথিবী জুড়ে অজস্র আশ্চর্য পেশা রয়েছে মানুষের। অর্থের বিনিময়ে মানুষকে অনেক সময়ই অনেক অদ্ভুত কাজ করতে হয়। দিনের শেষে প্রত্যেকে এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে পরিচিত হবেন এমনটাই আশা করা যায়। কিন্তু মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন তাঁদের শোষণ করে যাওয়ার ঘৃণ্য কাজ সেই আশায় জল ঢেলেই এসেছে তা বলা বাহুল্য।