শয়ে শয়ে পাখি, হাজার হাজার ডলফিনের মৃত্যু! যুদ্ধের মাশুল যেভাবে গুনতে হচ্ছে ইউক্রেনের প্রাণীদের

প্রকৃতির ক্ষতি যে বিপুলভাবে হবে এই যুদ্ধের ফলে, তা-ও স্পষ্ট জানিয়েছিলেন পরিবেশবিদরা। যুদ্ধের মাশুল তো মানুষকে দিতে হয়েছেই, এখন জল ও স্থলের প্রাণীরাও তার মাশুল গুনছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে ব্যপকভাবে মানবজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, কারও কাছেই তা অজানা নয়। প্রকৃতির ক্ষতি যে বিপুলভাবে হবে এই যুদ্ধের ফলে, তা-ও স্পষ্ট জানিয়েছিলেন পরিবেশবিদরা। যুদ্ধের মাশুল তো মানুষকে দিতে হয়েছেই, এখন জল ও স্থলের প্রাণীরাও তার মাশুল গুনছে।

প্রতি বছর ইউক্রেনের প্রকৃতি-সংরক্ষণকারীরা তজ়লি লেগুন (Tuzly Lagoon) ন্যাশানাল পার্ক সংলগ্ন জায়গায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী লেগুন ও কৃষ্ণসাগরের (Black Sea) মাঝে অগভীর খাল কেটে দেন। এই অগভীর খালগুলি থাকলে তীরে কাছে থাকা একাধিক লেগুনের সঙ্গে কৃষ্ণসাগরের যোগাযোগ বজায় থাকে। বিগত তিরিশ বছর ধরে এই ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু যুদ্ধের ফলে, বিগত তিরিশ বছরের এই নিয়ম মানা সম্ভব হয়নি। এই সংযোগস্থাপনকারী খালগুলোই আসলে কোটি-কোটি ছোট মাছের জন্য সমুদ্র ও লেগুনের মাঝে যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করে।

এই মাছগুলি শীতকাল কাটায় কৃষ্ণসাগরে। তারপর প্রজনন ঋতুতে আবার লেগুনের দিকে ফিরে যায়। এই যোগাযোগ-পথ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মাছের প্রজনন ও তাদের প্রজাতির সংখ্যা টিকিয়ে রাখার জন্য।

আরও পড়ুন: ইউক্রেনে থেমে থাকবে না রাশিয়ার আগ্রাসন? পুতিনের হুমকিতে নয়া আশঙ্কা বিশ্বজুড়ে

বহু বছর আগে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীই ছিল লেগুন ও কৃষ্ণসাগরের মাঝে যোগাযোগের রাস্তা। মাছেরাও এই পথেই যাতায়াত করত। লেগুনের দিকে ফিরে যেত তাদের প্রজনন ঋতুতে (Breeding Season)। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগ্রিকালচার গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, কৃষিকাজের ফলে তৈরি হওয়া বর্জ্য ও দূষিত পদার্থ এসে ভরাট করে দেয় সেই ছোট ছোট নদীগুলিকে। তাই মাছগুলির প্রজননে যাতে সমস্যা না হয়, তাই পরিবেশ সংরক্ষণকারীদের উদ্যোগে খাল বানানো শুরু হয় প্রতি বছর।

এই বছর যদি খালের খনন সম্ভব না হয়, মাছেদের প্রজনন ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষ্ণসাগরের উপকূলজুড়ে এখন বিভিন্ন দূষিত রাসায়নিকে ভরে রয়েছে, যেগুলি মূলত রাশিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ইউক্রেনের সৈন্যরাই ব্যবহার করেছিল।

খালগুলি খনন করতে না পারায়, কেবল যে মাছের ক্ষতি হবে তা নয়। ক্ষতি হবে পাঁচ হাজার হেরন পাখির, যারা লেগুনে ঘুরে বেড়ানো ছোট ছোট মাছ খেত। হেরন আসলে লম্বা পা এবং ঠোঁটবিশিষ্ট পাখি, যাদের মূলত স্বাদু জলের উৎস এবং সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চলের আশপাশে পাওয়া যায়।

পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে কেবল কৃষ্ণসাগর নয়, আজো়ভ সাগর (Azov Sea) এবং তার নিকটবর্তী জলাভূমির বাস্তুতন্ত্ররও বিপুল ক্ষতি হবে। ইউক্রেনের পরিবেশ সুরক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগের সহকারী সচিব (Deputy Minister of Environmental Protection and Natural Resources), আলেকজা়ন্ডার ক্যাস্নোল্যুটস্কির (Oleksandr Krasnolutskyi) মতে প্রায় চার লক্ষ হেক্টর জলাভূমির (Wetland) বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছে এর ফলে, যার মধ্যে পড়ছে ইউক্রেনের চোদ্দটি সুবৃহৎ জলাভূমি। এই চোদ্দটি জলাভূমি ইউনেসকো-র তরফে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে।

ইউক্রেনের মিওটিডা ন্যাশানাল পার্কের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল। সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এইরকম সংবেদনশীল অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র। শুধু এখানেই শেষ নয়, মিওটিডা ন্যাশানাল পার্কের (Meotyda National Park) ক্রিভা কস স্পিট (Kryva Kosa Spit) বিলুপ্তপ্রায় পাখি প্যালাসেস গালের (Pallas’s Gull) বাসস্থান। ইতিমধ্যেই ২০১৪ সালে যখন ডনব্যাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন রাশিয়ার সংগঠন ক্রেমলিন, মিওটিডা ন্যাশানাল পার্কের ক্রিভা করাস স্পিট অঞ্চলকে রাশিয়ার সৈন্যদের নামানোর জন্যে ব্যবহার করেছিল। এবং রাতারাতি প্যালাসেস গালের বাসস্থান ধ্বংস করে দিয়েছিল।

ইউক্রেনের সমুদ্রতটের চল্লিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যজুড়ে অবস্থিত কিনবার্ন স্পিট (Kinbrun Spit), যেটি আবার ব্ল্যাক সি বায়োস্ফিয়ার রিজা়র্ভেরই অন্তর্গত। চলতি মাসের শুরুতেই রাশিয়ার দিক থেকে আসা রকেটের কারণে সেই বায়োস্ফিয়ার রিজা়র্ভের প্রায় দশ হাজার একর অঞ্চলজুড়ে আগুন লাগে, যে আগুন টানা এক সপ্তাহ ধরে জ্বলেছিল।

গবেষক ইভান রুসেভ (Ivan Rusev) 'দ্য গার্ডিয়ান'-কে (The Guardian) জানিয়েছেন, প্রায় দুশোটি বোমা কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী লেগুনগুলিতে পড়েছে। ফলে এভোসেট (Avocets) ও ডালমেশিয়ান পেলিক্যান (Dalmetian Pelican) থেকে শুরু করে জলের নিকটে বাস করা একাধিক পাখির প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের বাসা বানানো এবং পরিযাণের সময়। রুসেভ জানিয়েছেন, এই অঞ্চলগুলিতে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার সাদা পেলিক্যানের (White Pellican) বসবাস, যারা মূলত পাড়ি জমায় আফ্রিকার দিকে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে সেই সংখ্যা এক লাফে তিনশোতে এসে নেমেছে।

কেবল বিভিন্ন পাখির প্রজাতি-ই নয়, যুদ্ধ ও বোমাবাজির পরে কৃষ্ণসাগর-তীরবর্তী অঞ্চলে প্রায়ই মৃত ডলফিন ভেসে আসছে। গবেষকদের মতে যুদ্ধের ফলে হওয়া অস্বাভাবিক সমুদ্রদূষণই এর মূল কারণ। পাশাপাশি যুদ্ধজাহাজের থেকে ভেসে আসা শব্দতরঙ্গও (Sonar) এই ডলফিনগুলির মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

রুসেভের মতে অন্তত দু'হাজার ডলফিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে মাত্র তিনটি প্রজাতির ডলফিনই পাওয়া যায়। তাই এদের মধ্যে প্রতিটি সদস্যই গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

বোমা পড়ার ফলে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে তৈরি হয়েছে একাধিক খাদ। তার ফলেও বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক ও সমুদ্রতীরবর্তী প্রাণীদের জীবন। পাশাপাশি সমুদ্রের বালি ও জলে এসে মিশছে ক্ষতিকর রাসায়নিক।

বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বোমায় ভারী ধাতু, ট্রাই-নাইট্রোটলিউইন (TNT), ট্রাইনাইট্রো ট্রায়াজা়ইন (RDX -এর ক্ষেত্রে), হাই-মেলটিং এক্সপ্লোসিভ (HML) ইত্যাদি পাওয়া যায়। যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশে থেকে যায় এবং কোনও বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলে উপস্থিত বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে জমা হতে হতে সবথেকে বেশি পরিমাণে জমা হয় খাদ্যশৃঙ্খলের একদম ওপরে থাকা প্রাণীর (Tertiary Animal) শরীরে। এই ঘটনাকে বলা বায়োম্যাগনিফিকেশন।

'দ্য গার্ডিয়ান'-এর তরফে জানা যাচ্ছে, ইউক্রেন চায় রাশিয়া পরিবেশ-সংক্রান্ত এই ক্ষতির দায় স্বীকার করুক। তার জন্য পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলাও ইউক্রেন করছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে, ইউক্রেন চাইলেই এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধী আদালত (International Criminal Court) অবধি নিয়ে যেতে পারে।

More Articles