সাইবাবার মৃত্যু পাথরের মতো ভারী
GN Saibaba: মুক্ত সাইবাবা খানিকটা হঠাৎই চলে গেলেন। বলা যেতে পারেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হলেন। তিনি অবশ্যই শহীদ। ব্যাক্তির মৃত্যু হয়। শহীদের নয়।
বিপ্লবের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এবং গভীর। অমিতাভ দাশগুপ্ত বলতেন, কবিতা লিখতে লিখতে কখনও তা ইস্তেহার হয়ে যায়। ইস্তেহার লিখতে বসলে তা আবার কখনও কবিতা হয়ে যায়। সদ্য চলে গেলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক জি এন সাইবাবা। চলে যাবার পর, এমনই পাতা উল্টোচ্ছিলাম অধ্যাপকের প্রোফাইলে। দেখছিলাম পারিবারিক বহু ছবি। মনে হলো, ভদ্রলোক বোধহয় সমুদ্র ভালবাসতেন। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মুখে ফুটে উঠত শিশুর সারল্য। আপাত অশক্ত মানুষটি বিপ্লবী ছিলেন বলেই হয়তো ছিলেন আদ্যন্ত রোমান্টিক। সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের মতো সারা জীবন তিনি অসংখ্য প্রতিকূল ঢেউ সামলেছেন, হাসি মুখে। কিন্তু কখনও নিজের বিশ্বাস, আদর্শ থেকে পিছু হটেননি।
জন্ম থেকেই তিনি পোলিও রোগের কারণে অন্যান্য শিশুদের মতো বেড়ে ওঠেননি। অথচ পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আশৈশব। পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষাসাহিত্য ছিল সাইবাবার প্রিয় বিষয়। অন্ধ্রপ্রদেশের ছেলে বলেই হয়তো কলেজজীবন থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন বিপ্লবী রাজনীতিতে। অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, আদিলাবাদ, খাম্মাম, শ্রীকাকুলাম তো পঞ্চাশ, ষাটের দশক থেকেই বামপন্থী রাজনীতির গড়। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের অবদান বিরাট। পরবর্তীতে নকশালবাড়ির লড়াই সংগ্রামেও অন্ধ্র অঞ্চলের গণজাগরণ সারা দেশকে উদ্দীপ্ত করেছিল। সত্তরের ঝোড়ো দিনে পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জেলের মধ্যে শহিদ হয়েছিলেন কেরলের ইঞ্জিনিয়রিং ছাত্র রাজন। অভিনেত্রী স্নেহলতা রেড্ডি। অন্ধ্রপ্রদেশের তরুণ দম্পতি পন্চাদ্রি ও নির্মলা কৃষ্ণ মূর্তি শহিদ হয়ে জন্ম দিয়েছিলেন কয়েক হাজার বিপ্লবীর। হয়তো সেই তালিকাতে কখন অজান্তেই যুক্ত হয়েছিলেন জি এন।
সময় পাল্টাতে লাগল দ্রুত। সত্তরের ভারত নব্বই পরবর্তীতে মুক্ত অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের হাত ধরে লগ্নি পুঁজির মৃগয়া ভূমিতে পরিণত হতে লাগল। বাম রাজনীতির বড় অংশ ততদিনে পুরোপুরিভাবে সংসদীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সশস্ত্র ধারা সংগঠিত চেহারায় অন্ধ্র, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, বিহারের বিস্তৃত এলাকায় আত্মপ্রকাশ করে ভারত রাষ্ট্রের রাতের ঘুম কেড়ে নিল। সাইবাবা ততদিনে পড়াশোনা শেষ করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন। ছাত্রদের মধ্যে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। মাওবাদী বিচারধারা সমর্থন করলেও, শারীরিক কারণে বা অন্য কোনও কারণেই হোক, কখনও সক্রিয় রাজনীতি করেননি।
তবে একাধিক সময়ে, শোনা যায় যে তিনি মানবাধিকার সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। ছাত্র জীবনে আল্ট্রা লেফট স্টুডেন্ট পলিটিক্স করতেন, ওইটুকুই। তবে সবসময় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের নিন্দা করতেন খোলাখুলিভাবে। মাওবাদী রাজনীতির মূল শক্তিই আদিবাসী। সমস্যা হচ্ছে, একুশ শতকের ভারতে পুঁজির দাপট যত বাড়ছে, তত রাষ্ট্র নখ দাঁত বের করে তার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। নরেন্দ্র মোসি সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই জোটবদ্ধ ভারতের শিল্পপতিরা নির্বাচনে বিজেপি জোটকে দু'হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ফলে ক্ষমতা পেয়ে তার প্রতিদান দিতে ভুল হয়নি চরম দক্ষিণপন্থী এই সরকারের। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। সস্তা শ্রম ও অফুরন্ত খনিজ সম্পদের কারণে ওইসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের দিকেই নজর পড়েছে দেশি, বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের। ঘটনাচক্রে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিই সেখানে আদিবাসী জনতার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। ফলে সরকার সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে মাওবাদী রাজনীতির বিপক্ষে। আকাশ পথে ড্রোন হামলা চলেছে আদিবাসী গ্রামগুলোতে। বাআস্তার, দণ্ডকারণ্যের জঙ্গল-পাহাড়ে রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ক্রমবর্ধমান।প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সর্বত্রই আর্বান নকশালের ভূত দেখছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে নিদান দিয়েছেন, ২০২৬-এর মধ্যে দেশে মাওবাদ বলে কিছু থাকবে না। যেটা বলেননি তা হচ্ছে, ঠারেঠোরে বোঝাতে চেয়েছেন মাওবাদ মুক্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখন আর কর্পোরেট পুঁজির মুনাফা অর্জনে কোনও বাধা থাকবে না।
সরকারের ধারণা একজন ভারভারা রাও বা জি এন সাইবাবা-কে জেলে রাখলেই যাবতীয় বিদ্রোহ, বিপ্লব শেষ হয়ে যাবে। ২০১৪ সালে মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার করা হলো সাইবাবাকে। ২০১৭ সালে নব্বই ভাগ শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষটিকে কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল। কুখ্যাত ইউএপিএ বা আনলফুল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনের একাধিক ধারা। তার মধ্যে মূল ধারাগুলি জামিন অযোগ্য। যেহেতু এই ধারায় বন্দি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বা দেশদ্রোহী হতে পারে, ফলে তার জামিন পাওয়ার অধিকার নেই। যদিও সাইবাবার মতো জনপ্রিয় অধ্যাপক ঠিক কীভাবে রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধে জড়িত তা দশ বছর ধরে চেষ্টা করেও দেশের মহামান্য সরকার প্রমাণ করতে পারেনি। সরকার চেষ্টা করেছিল বলতে যে, অধ্যাপকের কাছে কিছু লিফলেট ও কম্পিউটার থেকে ডাউনলোড করা কিছু মাওবাদী রাজনৈতিক লেখালেখি পাওয়া গেছে কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সাফ সাফ জানিয়ে দেয় যে, কোনও মতাদর্শের লেখালেখি পড়ার অপরাধে কাউকে যাবজ্জীবন জেল দেওয়া যায় না।
সাইবাবা বনাম রাষ্ট্র মামলা নিশ্চিত দেশের বিচার ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। রাষ্ট্র কিভাবে একজন প্রতিবন্ধীকেও অন্যায়ভাবে নির্মমতা দেখায় তার অকাট্য উদাহরণ হিসেবে। মাত্র সাত মাস আগে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সব 'অপরাধ' থেকে মুক্ত হয়েছিলেন অধ্যাপক জিএন সাইবাবা। তাঁর কলেজ চাকরি কেড়ে নিয়েছিল। অর্থনৈতিক কষ্ট ছিল চরম। তবুও সরকারের পায়ে মাথা নোয়াননি তিনি।
মুক্ত সাইবাবা খানিকটা হঠাৎই চলে গেলেন। বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হলেন। তিনি অবশ্যই শহিদ। ব্যাক্তির মৃত্যু হয়। শহিদের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম স্কুল জীবন থেকে। চলে যাবার পর স্ত্রী বলছিলেন, আমার জীবন থেকে বসন্ত বিদায় নিল। এমন প্রেমিক নিশ্চিত কবিতা ভালবাসতেন। সারা জীবন ধরে বিপ্লবের পথে থাকাও তো কবিতাই। কবি, রোমান্টিক, আদর্শবাদী সাইবাবার মৃত্যু পাথরের মতো ভারী।