সাড়ে সাত লক্ষ বছর আগেও মাছ রাঁধত মানুষ? যে ইতিহাস চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে
Human Cooking History: নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভলিউশনে সম্প্রতি একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রথমদিকের মানুষরা প্রায় ৭,৮০,০০০ বছর আগে প্রথম খাবার রান্না করেছিল।
ইলিশ ভাপা থেকে চিতলের মুইঠ্যা, পালংশাকের চচ্চড়ি থেকে শুরু করে মটন কষা। বাঙালি হেঁশেল মানে এমনই সব পদের বাহার। আবার বিদেশে বার্গার থেকে পাস্তা, থাই চিকেন থেকে শুরু করে সেজুয়ান নুডলস্। কোনও কিছুরই অভাব নেই হালফিল মাল্টিকুইজিনে। এখন প্রশ্ন ওঠে, রান্নায় মানুষের হাতেখড়ি কবে? গবেষণা বলছে, মানবজাতির রান্না শুরুর ইতিহাস লুকিয়ে আছে প্রায় ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ বছর আগে।
খননকার্যের সময় ১২ লাখ বছর আগের একটি দাঁতের টুকরো জীবাশ্মের মধ্যে পেয়েছেন ভূ-তত্ত্ববিদরা। গবেষণা বলছে, সেই দাঁতের টুকরোর মধ্যে কাঁচা মাংস থেকে শুরু করে ঘাসের নমুনা পর্যন্ত পাওয়া যায়। যা প্রমাণ করে, ১২ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের রান্না সমন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। আগুনের ব্যবহার নিয়ে গবেষক মহলে মতভেদ আছে। একদল মনে করেন, প্রায় ১৮ লাখ বছর আগে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়, অপর দলের মতে, মানবসমাজে আগুনের ব্যবহার শুরু হয় প্রায় ৩-৪ লাখ বছর আগে। কিন্তু এই নিয়েও মতভেদ আছে। একটি নতুন স্টাডি দেখায় যে, আদিম মানুষেরা পূর্বে যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক আগে রান্না করতে শিখেছিল। মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি রান্না করা মাছ থেকে এসে থাকতে পারে। বিবর্তনের যে মুহূর্তগুলো আদিম মানুষ পেরিয়ে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো, রান্না শেখা এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন। এটাই আমাদের আধুনিক মানুষে রূপান্তরিত করেছে।
ওয়াশিংটন ডিসি-র কলম্বিয়ান কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস-এর নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড ব্রাউন বলেছেন, 'প্রায় এক থেকে দুই মিলিয়ন আগের কথা, লম্বা শরীর এবং বড় মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছিল। ক্যালোরিসমৃদ্ধ খাবার এবং বিশেষ রান্না এই পরিবর্তনের কারণ।'
আরও পড়ুন : বাঁদরেরই জাত ভাই! তবে কেন মানুষের মতো বুদ্ধি ধরে না অন্য কোনও প্রাণীই?
নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভলিউশনে সম্প্রতি একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রথমদিকের মানুষরা প্রায় ৭,৮০,০০০ বছর আগে প্রথম খাবার রান্না করেছিল। আগে যে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, তার থেকে জানা যায় যে, প্রায় ১,৭০,০০০ বছর আগে মানুষ রান্না করে। নতুন গবেষণা থেকে এও জানা যায় যে, হোমো সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালরা শাকসবজি ও মাংস রান্না করতে আগুন ব্যবহার করত। তখন থেকেই মানুষ বিবর্তনের ইতিহাসে পা রাখল।
হোমো সেপিয়েন্সের আগে রান্নার আগুন জ্বলেছিল
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, হোমো ইরেক্টাস, অর্থাৎ আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ অনেক আগে রান্না করতে শিখেছিল। লন্ডনের 'দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম'-এর কো-অথর জেনস নাজোরকা বলেন, আদিম মানুষের বিবর্তনবাদের ইতিহাস নতুন করে চিহ্নিত করতে হলে অনেক পিছনের দিকে যেতে হবে।
গবেষক দলটি আধুনিক ইজরায়েলের উত্তর জর্ডন উপত্যকায় অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে তাদের মতের সপক্ষে প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে। হাতে গরম যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, তথাকথিত আচিউলিয়ান সংস্কৃতির হোমো ইরেক্টাস সম্প্রদায় এই অঞ্চলে বাস করত। এই সম্প্রদায় নানা বৈচিত্র্যময় খাবারে অভ্যস্ত ছিল। ফল এবং শাকসবজি খেত, কাছাকাছি প্যালিও-লেক হুলা থেকে মিষ্টি জলের মাছ ছিল তাদের অন্যতম মেনু। কিন্তু গবেষকরা এই নিয়ে ধন্দে ছিলেন যে, তারা খাবার কাঁচা, না কি রান্না করে খেত।
পোড়া মাছের দাঁত থেকে জানা যায় প্রাচীন রান্নার অভ্যাস
গবেষক দল গেশের বেনোট ইয়াকভের অগ্নিকুণ্ডের সান্নিধ্যে পাওয়া মাছের দাঁতের (কার্প এবং বারবেল) অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করেছে। দাঁতের স্ফটিক গঠন বিশ্লেষণ করে, দলটি দেখেছে যে আদিম মানুষেরা ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এর নিচে রান্না করে খেত। ইজরায়েলের তেল আভিভ ইউনিভার্সিটির গবেষণার কো-অথার ইরিট জোহর বলেন, "পোড়ানোর পরিবর্তে মাছটিকে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় রান্না করা হয়েছে।" এটিই প্রথম প্রমাণ যে, ইরেক্টাসের আগুন নিয়ন্ত্রণ করার এবং খাবার রান্না করার ক্ষমতা ছিল।
আরও পড়ুন : মানুষের মস্তিষ্ক খেয়েই বাঁচছে AI! পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে রোবটরা?
মানুষের রান্না শুরুর ইতিহাস এত কেন গুরুত্বপূর্ণ
মানুষ ইতিহাসকে, নিজের অতীত না জানলে এক পা-ও এগোতে পারে না, এটাই দস্তুর। মানুষের আগুন জ্বালতে শেখা এবং তারপর রান্নার কলাকৌশল-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিবর্তনের কাহিনি। ফলে অতীতের সেই কাহিনি আজও এত গুরুত্বপূর্ণ।
রান্নার বিকাশ মানব বিবর্তনের কথা বলে। মানুষের দেহের যে বিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। "মানুষ মনে করে যে, হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো সেপিয়েন্সের বিবর্তন অবশ্যই খাদ্যের পরিবর্তন এবং খাবার রান্না করার জন্য আগুনের ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ছিল। চোয়াল এবং মাথার খুলির পরিবর্তন এর প্রতি ইঙ্গিত করে," গবেষক জোহর এমনটাই বলেন।
মিষ্টি জলের কাছে বসত
গবেষক জোহরের মতে, আদিম মানুষ আফ্রিকা থেকে তাদের বসতি স্থানান্তরিত করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানুষ আফ্রিকার গুহায় বসতি স্থাপন করেছিল বলে জানা যায়। পরে সেখান থেকে তারা সরে যায় মিষ্টি জলের খোঁজে। বসতি স্থাপনের স্থান এবং প্রাথমিক মানুষের কার্যকলাপ সবসময় মিষ্টি জলের কাছাকাছি পাওয়া যায়। কারণ অবশ্যই মিষ্টি জলের মাছ। ফলে এর থেকে এটা প্রমাণ পাওয়া কঠিন নয় যে, মাছ কারণ আর মাইগ্রেশন তার ফল।
মাছ হলো প্রোটিন এবং পুষ্টির একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং সারা বছর খেতে পাওয়া যায়। "কিছু লোক মনে করে যে, প্রথম দিকের মানুষ শুধুমাত্র তখনই মাছ খেত যখন আর কিছুই পাওয়া যেত না। আমাদের গবেষণায় বলা হয়েছে যে এটি সত্য নয়- আমরা দেখতে পেয়েছি যে, মাছগুলি বছরের সব সময় রান্না করা হয়, প্রমাণ পাওয়া যায়, এটি আদিম মানুষের মেনুতে জায়গা করে নিয়েছিল,‘’ এমনটাই বলেন জোহর।
আরও পড়ুন : বাজারে পদ্মার ইলিশ কিনতে গিয়ে ঠকছেন? কীভাবে চিনবেন নদীর মাছ, যে তথ্য জানতেই হবে
কীভাবে হোমো ইরেক্টাসরা মাছ ধরত
মাছের টানে মাইগ্রেশন। মেনুতে মাছ। এর প্রমাণ তো মিলেছে। এখন প্রশ্ন হলো, মাছ কীভাবে ধরত হোমো ইরেক্টাস শ্রেণির মানুষ?
গবেষকরা বলেন, তখন মাছ ধরার বিশেষ কোনও প্রযুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে কোনও ক্ষেত্রে জলাভূমির জল খুব অগভীর থাকায় মাছ ধরার জন্য মানুষের জাল বা রডের মতো প্রযুক্তির প্রয়োজন হতো না। বর্শা এবং জালের মতো সরঞ্জাম দিয়ে তীরে মাছ ধরা মানব-ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক সংযোজন বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকালে বন্যপ্রাণী শিকারের মতো মাছ ধরার ক্ষেত্রে ভোঁতা অস্ত্র ব্যবহার করা হতো বলে অনুমান করা হয়।
আগুনের আবিষ্কারের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে মানবসভ্যতার ইতিহাস, তেমনই রান্নার বিকাশ এবং খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে নিবিড় যোগ মানবদেহের বিবর্তনের। কীভাবে হোমো ইরেক্টাস থেকে আজকের আধুনিক মানুষ এল? কবে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিল মানুষ? কবে সেই আগুনে মাছ-রান্না চেপেছিল? এসব নেহাত গল্পগাছা নয়। প্রাচীনতার প্রতি আকর্ষণ কিছু নতুন নয়। তাই কখনও কখনও ইতিহাসের টানে পিছনেও তো এগোতে হয়।