করোনার পর ফের মহামারীর সামনে পৃথিবী? কারণ দেখিয়ে ভয়াবহ ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের
Global Warming Pollution: বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বরফ গলার ফলে কেবল মাটিই উন্মুক্ত হচ্ছে না। কয়েক হাজার বছর ধরে বরফের ভেতর আটকে থাকা ভাইরাস, জীবাণুরাও মুক্তি পাচ্ছে।
কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই সহ দেশের অধিকাংশ বড়ো শহরাঞ্চল ঢাকা পড়ছে ধোঁয়ায়। বাড়ছে শ্বাসকষ্ট। নদীর দূষণ চিন্তা বাড়াচ্ছে বিজ্ঞানীদের। কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের ছবিটা এমনই। দূষণের জেরে একটু একটু করে বিপদের মুখে এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা। প্রমাদ গুনছেন বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদরা। “নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই লাইনটিই যেন গবেষকদের প্রতিদিনের আশঙ্কার বাণী হয়ে গিয়েছে।
এরইমধ্যে ২০২০-২০২১ সাল দেখে ফেলেছে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব। কয়েক লাখ মানুষ এক নিমেষে হারিয়ে গেলেন, আরও কয়েক লাখ মানুষের শরীর আগের থেকে আরও দুর্বল হয়ে গেল। সমস্তটাই কেবল আণুবীক্ষণিক একটি ভাইরাসের জন্য। তখন থেকেই পরিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজ আরও গভীরতর পর্যায়ে নিয়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি প্যান্ডোরা ভাইরাসের খোঁজ সেই গবেষণারই ফল। এখানেই আশঙ্কিত হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কেন? এই প্যান্ডোরা ভাইরাস বা জোম্বি ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সাইবেরিয়ার তুষারাবৃত জায়গায়। বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, এই ভাইরাস আজকের নয়; প্রায় ৫০ হাজার বছরের পুরনো! এতদিন বরফে ঢাকা ওই অঞ্চলে গোপনে ছিল এই ভাইরাস। আজ ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সেটি। কিন্তু এতো বছর পর কেন হাজির হল জোম্বি ভাইরাস?
ঠিক এই প্রশ্নটি নিয়েই প্রমাদ গুনছেন বিজ্ঞানীরা। কেবল প্যান্ডোরা ভাইরাস নয়, এরকম আরও বেশকিছু প্রাচীন ভাইরাস বরফাঞ্চলের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হচ্ছে। সাইবেরিয়ান অঞ্চলে এরকম আরও বহু প্রাচীন ভাইরাস লুকিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি ফ্রান্স, রাশিয়া আর জার্মানি – এই তিনটি দেশের বিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে গবেষণায় মগ্ন হয়েছেন। তাঁদের সেই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অন্তত ১৩ রকমের ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সাইবেরিয়ার ওই অঞ্চল থেকে। আর প্রত্যেকটির বয়স কয়েক হাজার বছর। এখনও অবধি প্যান্ডোরা ভাইরাসই সবচেয়ে প্রাচীন, যেটি বরফের ঘেরাটোপ ভেঙে ফের জেগে উঠেছে। সবচেয়ে ‘কমবয়সি’ ভাইরাসটির বয়সও প্রায় ২৭ হাজার বছর!
আরও পড়ুন : সাড়ে ৪৫ হাজার বছরের পুরনো ভাইরাস ডেকে আনছে সর্বনাশ! আবার ঘনাবে মহামারীর কালো ছায়া?
এবারই প্রথম নয়। বিগত কয়েক বছরে এই ‘বৃদ্ধ’ ভাইরাসদের আনাগোনা বেড়েছে অনেকটা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এই ভাইরাস আগে সাইবেরিয়া, অ্যান্টার্কটিকা, আর্কটিক অঞ্চল ইত্যাদি শীতল, বরফাবৃত জায়গায় লুকিয়েছিল। সেখানে জমে থাকার কারণে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হতে পারেনি। তবে এখন ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে এরা। কারণ? পরিবেশ দূষণ।
সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই বেড়ে চলেছে কল কারখানার পরিমাণ। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরায়ন। যথেচ্ছভাবে গাছ কাটা হচ্ছে, জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বাঁধ, খনি প্রকল্প, শিল্প, হাউজিং। এই সমস্ত প্রভাবই পড়ছে পরিবেশের ওপর। আজ নয়, বহু বছর ধরে নাগাড়ে বেড়েই চলেছে এই দূষণের মাত্রা। তারই প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সভ্যতার কাছে দূষণ স্রেফ স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের একটি বিষয়। এর বাইরে গিয়ে সর্বাত্মকভাবে আন্দোলন করে চলেছেন গ্রেটা থুনবার্গের মতো মানুষেরা। তবুও অবস্থা তথৈবচ।
ফলস্বরূপ, পরিবেশও ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। পৃথিবী জুড়ে বিপদের লাল সংকেত ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন। জলবায়ুর খামখেয়ালিপনায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঋতুচক্র, বাড়ছে ঝড়-ঝঞ্ঝা-সাইক্লোন। পৃথিবী আরও গরম হওয়ার ফল সরাসরি পড়ছে বরফের রাজ্যের ওপর। হিমালয়, অ্যান্টার্কটিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় হিমবাহ গলতে শুরু করেছে ব্যাপক হারে। হিমালয়ান রিজিয়ন, সাইবেরিয়া, অ্যান্টার্কটিকা, আর্কটিক রিজিয়ন, গ্রিনল্যান্ড ইত্যাদি জায়গায় বরফ সরে উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে মাটি। বরফের সাদা চাদর বদলে যাচ্ছে সবুজের আস্তরণে।
আরও পড়ুন : আমাদের শরীরে লুকিয়ে প্রাচীন ভাইরাসের জিন! নতুন গবেষণায় তোলপাড় বিশ্বজুড়ে
সবুজ ফিরে এলে বিজ্ঞানীদের খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে শিয়রে সমন দেখছেন তাঁরা। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বরফ গলার ফলে কেবল নিচের মাটিই উন্মুক্ত হচ্ছে না। কয়েক হাজার বছর ধরে বরফের ভেতর আটকে থাকা ভাইরাস, জীবাণুরাও নিজেদের ডানা মেলার সুযোগ পাচ্ছে। প্রায় প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই হঠাৎ হাজির হয়ে যাচ্ছে তারা। সেখান থেকেই জোম্বি ভাইরাস সহ আরও বেশকিছু প্রাচীন ভাইরাসের আগমন। ভবিষ্যতে যত বরফ গল্বে, ততই এই ভাইরাসের সংখ্যা বাড়বে বলে অনুমান গবেষকদের।
তবে বিজ্ঞানীদের এও দাবি, এই ধরণের প্রাচীন ভাইরাস মানুষের পক্ষে খুব একটা ক্ষতিকারক নয়। বড়জোর নিউমোনিয়া গোছের রোগ হতে পারে। এর বেশি কোনও ভয়ের লক্ষণ তাঁরা এখনও দেখতে পাননি। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে ভয়ের কারণ রয়েছে অন্যত্র।
গবেষকরা বলছেন, কেবল জীবাণু আর ভাইরাসই নয়, বরফের ভেতর পাথরের মতো জমে পড়ে রয়েছে অনেক প্রাচীন মৃতদেহও। কয়েক দশক আগে যে রোগগুলি পৃথিবীতে আতঙ্ক তৈরি করেছিল, সেই রোগের আক্রমণে যারা মারা গিয়েছেন, তাঁদের অনেককেই সাইবেরিয়া, নরওয়ের তুষারাবৃত জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়েছে। প্রায় -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সেই দেহের বীভৎস বিকৃতি হয়নি। ফলে অটুট থেকে গিয়েছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটা সময় স্মলপক্স, স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মতো রোগ পৃথিবীতে মহামারী সৃষ্টি করেছে। সেই সমস্ত রোগে মৃত মানুষদের এখানে নিয়ে এসে দাফন করা হয়েছে। বরফ গলে গেলে সেই দেহগুলি বেআব্রু হয়ে পড়বে। ফলে ফের নতুন করে ফিরে আসতে পারে সেই প্রাচীন মহামারির রোগগুলি। প্রাচীন ভাইরাসের থেকেও এই তথ্যটি সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন : করোনার পর কোন ভাইরাস? অতিমারীর ভয়াল দিন ফেরাচ্ছে জলবায়ুর ভোলবদল?
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৬ সালে রাশিয়া, সাইবেরিয়ার আর্কটিক অঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ওই অঞ্চলের ২৬৫০ টি রেইন ডিয়ার বা বল্গা হরিণ এই ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের কবলে পড়েছিল। যার মধ্যে মারা গিয়েছিল ২৩৫০ টি হরিণ। হঠাৎ এমন রোগের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন, ১৮৪৮ সালে সাইবেরিয়ার ওই অঞ্চলে শেষবার অ্যানথ্রাক্স রোগ নিজের প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারপর এই রোগের চিহ্ন দেখা যায়নি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে যাচ্ছে। সেই কারণে পুরনো সেই অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া ফের জেগে উঠেছে।
এই একটি উদাহরণই ভবিষ্যতের ভয়াবহতার ছবি তুলে ধরে। পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়া রোগগুলি ফের ফিরে এলে আরও ভয়ংকর জায়গায় যেতে পারে পৃথিবী। করোনার মতো মহামারির ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে পারে গোটা বিশ্ব। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায়, পরিবেশ দূষণ রোধ। অবশ্য বহু বছর ধরে এই কথাটিই বলে আসছেন বিজ্ঞানীরা। সভ্যতার বিশেষ হেলদোল আছে কি?