জেলায় জেলায় ফের স্ক্রাব টাইফাসের হানা, এই ভয়াবহ অসুখের লক্ষণ কী? কীভাবে প্রতিকার?

"অদূর ভবিষ্যতে আমরা স্ক্রাব টাইফাসের জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে, ভ্যাকসিন তৈরির কথাও ভাবছি", জানাচ্ছেন ড. ভারগিস

গত বছর কোভিডের আতঙ্কের মধ্যেই দার্জিলিং-এ স্ক্রাব টাইফাসের ঘটনা চোখে পড়েছিল। এই বছর স্ক্রাব টাইফাস ধরা পড়ল কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে। স্ক্রাব টাইফাসের জন্য দায়ী ওরিয়েনশিয়া সুসুগামুশি নামের একটি ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়াটি ছড়ায় চিগার নামের ছারপোকাদের মতো দেখতে পোকাদের লার্ভাদের আক্রমণের ফলে। কারণ এই ব্যাকটেরিয়ার বাহক হল চিগার মাইটস।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই রোগের প্রাবল্য দেখা যায়। আর এর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে বর্ষাকালে। কারণ এই সময় ঝোপঝাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে, যা হয়ে ওঠে চিগারের বেড়ে ওঠার আদর্শস্থল।

 

২০২০ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবথেকে বেশি একান্ন থেকে ষাট বছর বয়সিদের মধ্যে। তারপরেই এগারো থেকে কুড়ি বছর বয়সিদের সম্ভাবনা রয়েছে এই রোগে ভোগার। লিঙ্গ অনুযায়ী দেখলে, মহিলাদের মধ্যে স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবথেকে বেশি।

 

আরও পড়ুন: কোভিডের মতোই সংক্রমিত হচ্ছে মাঙ্কিপক্স? যে কারণে পৃথিবীজুড়ে চিন্তা বাড়ছে বিজ্ঞানীদের

 

ভেলোরের স্ক্রিশ্চান মেডিক‍্যাল কলেজের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের অধ্যাপক ড. জর্জ ভারগিস ইন্সক্রিপ্ট-কে জানিয়েছেন, "বিগত দশ বছরের কাছাকাছি সময় ধরেই স্ক্রাব টাইফাসের সংক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। তবে স্ক্রাব টাইফাসের ঘটনা একেবারে নতুন নয়।"

 

কিন্তু হঠাৎ করে স্ক্রাব টাইফাস আক্রান্তর সংখ্যা কেন বাড়ছে? বছরকয়েক আগেও, এই হারে স্ক্রাব টাইফাসের কথা আমরা শুনতাম না।

 

"স্ক্রাব টাইফাসের জন্য আগে ব্যবহৃত হতো টেট্রাসাইক্লিন ও ক্লোরামফেনিকল জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক। যেগুলো স্ক্রাব টাইফাসের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। পরে বিটা-ল্যাকটামেজ় জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা শুরু হয়, যা কিন্তু স্ক্রাব টাইফাস নিরাময়ে কোনও কাজে আসে না”, ড. ভারগিস জানাচ্ছেন, “পাশাপাশি, আমাদের ধারণা বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনও দায়ী স্ক্রাব টাইফাসের ঘটনা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে।"

 

স্ক্রাব টাইফাস-এর উপসর্গই বা কী?

স্ক্রাব টাইফাসের মূল লক্ষণ হল জ্বর এবং শিরশিরে ভাব, মাথা যন্ত্রণা, গায়ে ব্যথা বা শরীরের বিভিন্ন পেশিতে ব্যথা, র‍্যাশ, পোকার কামড়ের স্থানে কালো দাগ প্রভৃতি দেখা যায়। একাধিক শারীরিক লক্ষণের পাশাপাশি দেখা যেতে পারে মানসিক সমস্যাও। যার মধ্যে অন্যতম মানসিক বিভ্রান্তি, স্পষ্ট করে ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, এবং কোমায় চলে যাওয়ার প্রবণতা। এমনকী, মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে এর ফলে।

 

"তবে শুরুর দিকে যখন স্ক্রাব টাইফাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের নজরে পড়ে, তখন আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল পনেরো শতাংশের কাছাকাছি। এখন তা কমে বড় জোর পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে নেমেছে", জানাচ্ছেন ড. ভারগিস।

 

স্ক্রাব টাইফাস রোগটিকে অ্যাকিউট মাল্টিসিস্টেম ফিব্রাইল ইলনেসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অ্যাকিউট ফ্রিব্রাইল ইলনেসকে আবার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অ্যাকিউট আনডিফারেনশিয়েটেড ফিভারও বলা হয়। গত বছর বহু শিশু আনডিফারেনশিয়েটেড ফিভার বা অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। আর যেহেতু স্ক্রাব টাইফাসের সঙ্গে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, টাইফয়েড এমনকী কোভিডের লক্ষণেরও অনেকাংশে মিল রয়েছে, অনেকেই মনে করেন, এই রোগগুলোর মধ্যে কোনও একটিতে আক্রান্ত হয়েছে শিশুরা। পরে দেখা যায়, সেই অজানা জ্বর বা অ্যাকিউট আনডিফারেনশিয়েটেড ফিভারের কারণ স্ক্রাব টাইফাস।

 

যে কোনও ধরণের ফিব্রাইল ইলনেস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সেরে গেলেও, স্ক্রাব টাইফাসের মতো জ্বরের পাশাপাশি দেহের একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভয়াবহভাবে। যার মধ্যে অন্যতম কিডনির কার্যক্ষমতা হারানো, যকৃতের কোশ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। ব্যাকটেরিয়া আক্রমণের ফলে তৈরি হওয়া ইনফ্লেমেশনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, রক্তবাহী শিরা-ধমনিও।

 

পাশাপাশি, একাধিক নিউরোলজিক্যাল প্রভাব বারো থেকে ছাব্বিশ শতাংশ স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। নিউরোলজিক্যাল এফেক্টের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মস্তিষ্কের আবরণ বা মেনিনজেস। রোগের প্রভাব বাড়লে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেরিবেলাইটিস, এক্সট্রাপিরামিডাল সিন্ড্রোম, মায়োক্লোনাস, এবং অপসোক্লোনাসের মতো নিউরোলজিক্যাল রোগে।

 

স্ক্রাব টাইফাসের সঙ্গে টাইফয়েড, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, এবং কোভিডের লক্ষণের কী কী তফাৎ?

যেহেতু স্ক্রাব টাইফাসের সঙ্গে ডেঙ্গি, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া এবং কোভিডের অনেকাংশে মিল আছে, অধিকাংশ সময়ে একটির সঙ্গে আরেকটির তফাৎ করা মুশকিল হয়ে যায়। ফলে রোগী ও তাঁর পরিবার বিভ্রান্তির শিকার হন।

 

ডেঙ্গির সঙ্গে স্ক্রাব টাইফাসের লক্ষণের পার্থক্য হল, ডেঙ্গির ক্ষেত্রে গাঁটে এবং চোখের পিছনে ব্যথা হয়। স্ক্রাব টাইফাসের ক্ষেত্রে তা হয় না। তবে দুই ক্ষেত্রেই পেশিতে ব্যথা হয়। ডেঙ্গিতে বমি হয় বা গা গুলোয়, স্ক্রাব টাইফাসের ক্ষেত্রে আবার তা হয় না। এদিকে স্ক্রাব টাইফাসে চামড়ায় কালো-কালো দাগ দেখা যায় চিগারের কামড়ের কারণে।

 

অন্যদিকে টাইফয়েডের সঙ্গে স্ক্রাব টাইফাসের তফাৎ হল, টাইফয়েডের ক্ষেত্রে ডায়েরিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা যায়, যা আবার স্ক্রাব টাইফাসের ক্ষেত্রে হয় না।

 

এদিকে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, স্ক্রাব টাইফাসের ক্ষেত্রে এই জাতীয় কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। স্ক্রাব টাইফাসের মতো ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে ত্বকে কালো-কালো দাগ দেখা যায় না।

 

কোভিড আর স্ক্রাব টাইফাসের লক্ষণের মধ্যে মিল থাকলেও, কোভিডের মতো কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, সর্দির মতো লক্ষণ স্ক্রাব টাইফাসে দেখা যায় না।

 

এলাইসা টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় কোনও রোগী স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত কি না। এবং ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানানো হচ্ছে ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম দিয়ে এলাইসা টেস্ট করলে তা অনেক বেশি কার্যকরী হয় এবং পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে অনেক বেশি নিশ্চিত হওয়া যায়।

 

প্রতিকার কী?
স্ক্রাব টাইফাসের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া যেহেতু চিগার মাইটসের শরীর থেকে ছড়ায়, যেগুলি আবার ঝোপ-ঝাড়েই বসবাস করে, তাই কাজের প্রয়োজনে ঝোপ-ঝাড়ে গেলেও, শরীরকে ঢেকে রাখবে এমন পোশাক পরা উচিত।

 

"অদূর ভবিষ্যতে আমরা স্ক্রাব টাইফাসের জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে, ভ্যাকসিন তৈরির কথাও ভাবছি", জানাচ্ছেন ড. ভারগিস, "তবে আপাতত আমরা স্ক্রাব টাইফাসের প্রতিকারের জন্য কিছু গবেষণা চালাচ্ছি। যার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুব তাড়াতাড়ি জানা যাবে।"

More Articles