ইউরেনাসের একাধিক চাঁদে রয়েছে মহাসাগর, যে-তথ্য পালটে দিচ্ছে সৌরজগতের হিসেবনিকেশ

Voyager 2 and Uranus: ইউরেনাসের প্রতিটি ঋতু প্রায় কুড়ি বছর স্থায়ী হয়। গ্রহটির দীর্ঘ ঋতুচক্রের কারণে এর শক্তিস্তরেও পরিবর্তন ঘটে, যা ভয়েজার ২-এর সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণে ধরা সম্ভব ছিল না।

অবশেষে, সৌরজগতের অনেক দিনের একটা ধাঁধার সমাধান করলেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি জানা গেছে, ইউরেনাস গ্রহের অভ্যন্তরেও রয়েছে নিজস্ব তাপের উৎস। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এই গ্রহটি ভেতর থেকে সম্পূর্ণ শীতল; কিন্তু হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি নতুন সমীক্ষা সেই ধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি জানাচ্ছে, ইউরেনাস সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি পায়, তার থেকে প্রায় ১২.৫% বেশি তাপ সে মহাকাশে বিকিরণ করে। এই আবিষ্কারটি নাসার ভয়েজার ২ মহাকাশযানের পাঠানো প্রায় ৩৮ বছরের পুরনো পর্যবেক্ষণকে ভুল প্রমাণ করেছে।

এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি গ্রহবিজ্ঞানের একটি মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধান করল। সৌরজগতের অন্যান্য গ্যাস-নির্মিত গ্রহ, যেমন বৃহস্পতি, শনি এবং নেপচুন, সূর্য থেকে প্রাপ্ত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি তাপ উৎপন্ন ও বিকিরণ করে। কিছু ক্ষেত্রে এই পরিমাণ একশো শতাংশেরও বেশি। কিন্তু ১৯৮৬ সালে ভয়েজার ২ যখন ইউরেনাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, সে-সময় তার পাঠানো তথ্য এক ভিন্ন চিত্র বিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরে। সেই তথ্য অনুযায়ী, ইউরেনাসের কোনও অভ্যন্তরীণ তাপের উৎস ছিল না। তাহলে কি ভয়েজার ২ ভুল তথ্য পাঠিয়েছিল? 

আরও পড়ুন-

আলোকে জমিয়ে ফেলা সম্ভব! বিজ্ঞান গবেষণায় যে ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য

১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে, ভয়েজার ২ ইউরেনাসের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। তখন থেকে এখনও পর্যন্ত এটিই একমাত্র মহাকাশযান যা এই গ্রহটিকে এত কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিল। মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণে, ভয়েজার ২ ইউরেনাসের দশটি নতুন চাঁদ এবং দুটি নতুন বলয় আবিষ্কার করে। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্যও ভয়েজার ২ পৃথিবীতে পাঠায়, যার মধ্যে অন্যতম হল ইউরেনাসে অভ্যন্তরীণ তাপের অনুপস্থিতির তথ্য।

ভয়েজার ২

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ভয়েজার ২-এর এই ভুল পর্যবেক্ষণটি ছিল এক মহাজাগতিক কাকতালীয় ঘটনার ফল। নাসার বিজ্ঞানী এমি সাইমনের কথায়,

ভয়েজার ২-এর ফ্লাইবাইয়ের পর থেকে সকলেই বলে এসেছেন যে ইউরেনাসের কোনও অভ্যন্তরীণ তাপ নেই। কিন্তু কেন এমন হবে, তা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন ছিল, বিশেষ করে যখন আমরা অন্য দৈত্যাকার গ্রহগুলির সঙ্গে এর তুলনা করি।

গবেষকরা এখন বিশ্বাস করেন যে ভয়েজার ২ মহাকাশযানটি যখন ইউরেনাসের কাছে পৌঁছয়, তখন গ্রহটিতে গ্রীষ্মকালীন সৌরস্থিতি (summer solstice) চলছিল। ঠিক সেই সময়েই একটি অস্বাভাবিক সৌর ঝড় শুরু হয়, যা গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্রকে (magnetosphere) সংকুচিত করে দেয়।  বিজ্ঞানীদের মতে, এ এক অত্যন্ত বিরল আকাশঘটনা।  এই সৌরঝড় (হারিকেন) ইউরেনাসের চৌম্বকীয় বুদবুদকে এতটাই চেপে দিয়েছিল যে এর ফলে গ্রহের চারপাশের পরিবেশ এবং ভয়েজারের শক্তি পরিমাপের যন্ত্রের পাঠ-ও প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিল। এখানে এ-কথাও বলে রাখা উচিত, ভয়েজার ২ তার সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথে গ্রহটির শুধুমাত্র একটি গোলার্ধ-ই পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিল। 

ইউরেনাসের কেন্দ্র অংশ

এই গবেষণার প্রধান ড. শিনইউ ওয়াং বলেন,

এর অর্থ হল, গ্রহটি এখনও তার প্রাথমিক স্থিতি থেকে প্রাপ্ত অবশিষ্ট তাপ ধীরে-ধীরে হারাচ্ছে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, যা আমাদের পৃথিবীর উৎস এবং সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এর পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে।

এই আবিষ্কারটি ইউরেনাসের আরও কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের উপর নতুন আলোকপাত করেছে। যেমন, গ্রহটি তার অক্ষের উপর প্রায় ৯৮ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে এবং উল্টো দিকে ঘোরে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, গ্রহের অভ্যন্তরীণ তাপের অবস্থানের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই, ইউরেনাসের প্রতিটি ঋতু প্রায় কুড়ি বছর স্থায়ী হয়। গ্রহটির দীর্ঘ ঋতুচক্রের কারণে এর শক্তিস্তরেও পরিবর্তন ঘটে, যা ভয়েজার ২-এর সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণে ধরা সম্ভব ছিল না।

আগের পর্যবেক্ষণে, ইউরেনাসের চৌম্বক ক্ষেত্রটিকে প্রায় শূন্য বলে মনে করা হয়েছিল, যে-কারণে ইউরেনাসের পাঁচটি প্রধান চাঁদকেও ভূতাত্ত্বিকভাবে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই চাঁদগুলি ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় হতে পারে এবং তাদের মধ্যে মহাসাগরও থাকতে পারে। ইউরেনাস সম্পর্কে এই সাম্প্রতিক গবেষণা-তথ্য সৌরজগতের গ্রহগুলির গঠন এবং বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এবং এর থেকে এ-কথাও আরেকবার প্রমাণিত হল যে, একটি মহাকাশযানের একটিমাত্র পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সবসময় সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি এবং ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণই মহাজাগতিক বস্তুর আসল প্রকৃতি উন্মোচন করতে পারে।

More Articles