শাহরুখ খান: কেন আজও ভারতের 'দ্য লাস্ট স্টার অফ দ্য স্টারস' বাদশা
Shah Rukh Khan Birthday: নিজের ট্রেডমার্ক হাসি হেসে শাহরুখ জবাব দিয়েছেন, "জীবনের নানা পর্যায়ে এক এক রকম চাওয়া থাকে। তবে একটা জিনিস আমি সব সময় চাই, আমার সন্তানরা যেন সুস্থ থাকে।"
আজ এমন এক প্রেমিকের জন্মদিন যার প্রেম 'স্বদেশ'-এর গণ্ডি ছাড়িয়ে 'পরদেশ'- এও মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে 'মহব্বতে' হয়, কীভাবে, 'ডর'কে জয় করে 'চলতে চলতে' নিজের জীবনের 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া'কে জয় করতে হয়। যার প্রেম দেখে মনে 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়', যার বিরহ দেখে মন ভাঙা প্রেমিক 'দেবদাস' হতে চায়, আর প্রিয় মানুষকে হয়তো শেষ বারের জন্য বলা যায় 'জব তক হ্যায় জান'! যার 'জিরো' থেকে শুরু করার কাহিনি শুনে জীবনের 'পহেলি'তে আটকে পড়া প্রতিদিন 'ইয়েস বস' বলতে বলতে ক্লান্ত বেসরকারি,,সংসারী কোনও যুবক দিনের শেষে ঠোঁটের কোণায় সিগারেট ধরিয়ে একদিন 'ডন' হওয়ার স্বপ্ন দেখে। হ্যাঁ, আজ সেই রাহুল, রাজ, কবির খান তথা কিং অব রোম্যান্সের ৫৭ তম জন্মদিবস।
কারও কাছে তিনি 'অতি-অভিনেতা', আবার কারও কাছে তিনি অভিনয় জগতের ঈশ্বর। কেউ কেউ তাঁকে তাঁর ফ্লপ ছবির জন্য গালমন্দ করে, আবার কেউ কেউ তাঁর কাল্ট সিনেমাগুলিকে বারবার দেখে বলছে 'অসাধারণ'। কেউ কেউ তাঁর বয়সে ছোটো নায়িকাদের সঙ্গে অনস্ক্রিন রোম্যান্সকে কটাক্ষ করছে। আবার হয়তো ক্লাস টেনে পড়া কোনও কিশোরী সেই একই দৃশ্য দেখে মনে মনে নিজের অদেখা প্রেমিকের ছবি আঁকছে। কেউ কেউ তাঁকে বলে বুড়ো, আবার কারও কাছে তিনি চিরতরুণ। যে যাই বলুন না কেন, তিনি ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। নিন্দুকের কথায় তিনি বিশেষ কান দেন না। আবার কখনও কখনও গা ভাসান ভক্তদের অতি আদুরে প্রশংসায়। তাই আজকে তিনি কিং খান, বলিউডের বাদশা, 'The last star of the Stars'।
আজকের দিনে মুম্বইয়ের বান্দ্রা এলাকার মন্নত নামের বাড়িটি গোটা ভারতের আগ্রহের কেন্দ্র। সকাল, সন্ধ্যা, রাত নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, যদি একবার দেখা মেলে মহানায়কের। আসতে, যেতে কিংবা ভক্তদের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যদি একবার বারান্দায় এসে দাঁড়ান, হাত নাড়েন। শাহরুখ খানের বাড়ির দরজা আজ হয়ে যায় বাসের স্টপেজ। মুম্বইয়ের সমস্ত লোকাল বাসের কন্ডাক্টাররাও আজ 'মন্নত' বলে একবার চিৎকার করবেনই।
আরও পড়ুন- ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের জন্য হোটেলে রাত কাটানো থেকে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক! বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ‘বাদশা’-র
কিন্তু কী এমন আছে এই মানুষটার মধ্যে? ১৯৬৫ সালের এই দিন অর্থাৎ ২ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শাহরুখ খান। ১৯৯২ সালে দিওয়ানা সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে তাঁর অভিষেক। আর নায়ক হিসেবে এই বলিউড সুপারস্টারকে শেষবারের মতো পর্দায় দেখা গিয়েছে ২০১৮ সালের জিরো ছবিতে। টানা চার বছর পর্দা থেকে দূরে, শেষ কবে দর্শকদের হিট ছবি উপহার দিয়েছেন তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কিন্তু এত কিছুর পরেও এই তারকার খ্যাতি একটুও কমেনি। ছবি হিট বা ফ্লপের কোনও প্রভাব পড়ে না স্টারডমে। নবীন তারকা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও তাঁকে রাখেন আদর্শের তালিকায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হোক বা নরেন্দ্র মোদি, রাজ্য এবং কেন্দ্রের শীর্ষ নেতারাও তাঁর সিনেমা দেখেছেন বহুবার। নায়িকাদের পছন্দের অভিনেতা তিনি। বহু নারী তাঁর রোম্যান্সের সঙ্গী হতে চান, তাঁর সঙ্গে যেতে চান ভ্রমণে। তাই বাংলাদেশ থেকে এই একটি দিনের জন্য মুম্বইয়ে ছুটে আসা তরুণী ডেইজি রহমান বলেন, "মুম্বই এলে আর কোথাও না গেলেও শাহরুখের বাড়ির সামনে একবার আসবই। ভাবি যদি কোনও একদিন স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নায়ক বলতে তো আমি শুধু শাহরুখকেই বুঝি।"
উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রং খুব একটা ফর্সা নয়, নাকটাও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি লম্বা। তাই সব মিলিয়ে দেখতে তিনি মোটেও খুব একটা 'ভালো' নন। অন্তত ভারতের অন্যান্য নায়ক এবং মডেলদের মতো তো নয়ই। কিন্তু তা সত্বেও পর্দায় তাঁর একটা উপস্থিতি হাজার হাজার তরুণীর হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। ইন শার্ট, গোটানো হাত, আর গালে টোল দেখে বুকে হাত রেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বহু নারী। তাঁকে দেখেই হয়তো আগামী দিনেও মন্দিরারা প্রেমে পড়বেন রিজওয়ানদের, জারারা মন দেবেন বীরদের। আর সকলের এই প্রেমকাহিনির মধ্যে কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকবেন শাহরুখ।
৫৭ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে আজকেও তিনি তারুণ্যের প্রতীক। পরপর চারটি ছবি ফ্লপ হওয়ার পরেও পাঠান ছবির জন্য অ্যাবস তৈরি করেছেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "এতগুলো বছর যা ছিলাম, এখনও আমি তাই আছি। শরীরে অনেক ব্যথা যন্ত্রণা আছে, তবুও আমি নিজেকে সুস্থ মনে করি।" আজ তাঁর জন্মদিনে সারা ভারত জুড়ে মানুষ শাহরুখ খানের দীর্ঘায়ু কামনা করছেন। কিন্তু এই বিশেষ দিনে তিনি কী চাইছেন? সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে আবারও নিজের ট্রেডমার্ক হাসি হেসে শাহরুখ জবাব দিয়েছেন, "জীবনের নানা পর্যায়ে এক এক রকম চাওয়া থাকে। তবে একটা জিনিস আমি সব সময় চাই, আমার সন্তানরা যেন সুস্থ থাকে।"
কয়েক বছর আগে জন্মদিনের আগের রাতে আলিবাগে নিজের বাগানবাড়িতে বলিউডের বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করেছিলেন তিনি। জন্মদিনে সকাল থেকে মন্নতে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের আনাগোনা থাকলেও, সেদিন রাত্রেই সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার পর শাহরুখ ছুটে গিয়েছিলেন হোটেল তাজ ল্যান্ডের একটি কক্ষে। সেখানে ছিলেন নানা বয়সী অ্যাসিড অ্যাটাকের শিকার নারীরা। তাঁদের সঙ্গে নিজের জন্মদিন কাটিয়েছিলেন কিং খান। ঘড়িতে রাত ১১টা বেজে গেলেও তিনি তখনও যেন ২৫ বছরের যুবক। সারা দিনের ক্লান্তি স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি তাঁকে। রাত্রিবেলা কেক কেটে নাচ-গান করে শাহরুখ তাঁর ফ্যান ক্লাবের ভক্তদের সঙ্গে খুশিতে গা ভাসিয়েছিলেন সেদিন।
আরও পড়ুন- ‘তুমি নেশাগ্রস্ত, তাই ঝামেলা করেছ’, কেন শাহরুখ খানকে বলেছিলেন বিগ বি?
গতবছর ড্রাগ মামলায় শাহরুখ পুত্র আরিয়ান খান আটক হওয়ার পরে দীর্ঘ কয়েক মাস কার্যত নিভৃত বাসে কাটিয়েছিলেন শাহরুখ। দেখা করেননি নিজের ভক্তদের সঙ্গে। ঘরের মধ্যেই আইনজীবিদের সঙ্গে চলছিল শলা পরামর্শ। ভক্তরা মনে মনে বিশ্বাসটা ধরে রেখেছিলেন, "ফিরবেন, কাম ব্যাক করবেন, আর যখন করবেন, কেউ পার পাবে না।" হলোও ঠিক তাই, একদিন যে সমস্ত মানুষরা অভিযুক্ত আরিয়ানকে ড্রাগ মামলায় ফাঁসিয়ে ছিল, আজ প্রায় সকলেই পড়েছে মহাবিপদে। আজ সব মানুষই জেনে গিয়েছেন, ড্রাগের কোনও ব্যাপারই ছিল না। আসল টার্গেট ছিলেন শাহরুখ আর আরিয়ান।
তাই আজকের জন্মদিন শাহরুখের জন্য খুবই স্পেশাল। আর সেই দিনকে আরও স্পেশাল করে তোলার জন্য এদিন বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে ফের রিলিজ হচ্ছে শাহরুখের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিনেমা 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'। এমনিতেই মুম্বইয়ে মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে নিয়মিত শাহরুখ খান এবং কাজল অভিনীত এই সিনেমাটি দেখানো হয়। তবে আজ, জন্মদিন উপলক্ষ্যে সেই ছবি আবার দেখানো হবে ভারতের বিভিন্ন পিভিআর, সিনেপলিস এবং আইনক্সের বেশ কিছু মাল্টিপ্লেক্সে। কলকাতাতেও আজ সারাদিন মাল্টিপ্লেক্সে চলবে শাহরুখ-কাজল জুটির এই কালজয়ী সিনেমা। সারা দেশের শাহরুখ ভক্তরা আবারও পাগলের মতো যাবেন ২৭ বছর আগের সেই সিনেমাটি দেখতে। আর সিনেমার শেষে 'Come, Fall in Love' দেখে সেই ১৯৯৫-এ ফিরে যাবেন আজকের পরিণত মস্তিষ্কের যুগলরা।
আজকে ইন্টারনেট আর নানান প্লাটফর্মের জন্য অনেক ধরনের সিনেমা হয়তো মানুষের মনে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। ঋষভ শেট্টির 'কান্তারা' কিংবা যশের 'কেজিএফ'এর হাত ধরে পুনর্জন্ম হয়েছে স্যান্ডালউডের। 'জাল্লিকাট্টু'র হাত ধরে ফিরেছে মালায়ালাম ছবির ভাগ্য। কিন্তু যে নাম বারবার ফিরে এসেছে, সেই নামটাই হল কিং খান বা শাহরুখ খান।
এই একটি মানুষ সবার কাছেই 'ইনস্পিরেশন'। দক্ষিণের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বর্তমানে যেখানে এত মাতামাতি, সেখানের সব অভিনেতাদেরই কথায়, যে মানুষকে দিয়ে বাইরের দেশ এখনও বলিউডকে চেনে, তিনি আর কেউ নন, এক এবং অদ্বিতীয় শাহরুখ খান। তাঁর মাথায় কোনও 'বাবা', 'কাকা' বা তথাকথিত কোনও গডফাদারের হাত ছিল না। প্রায় শূন্য পকেটে স্বপ্নের নগরীতে নিজের ভাগ্য তৈরি করতে চলে এসেছিলেন যুবক শাহরুখ। প্রথম জীবনে টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকের কাজ, তারপর সিনেমা, একটার পর একটা হিট, দিল্লির সেই যুবক তখন বলিউডের বাদশা।
দিওয়ানাতে সেকেন্ড লিডের অভিনয় দিয়ে ঋষি কাপুরকে ছাপিয়ে যাওয়া, তারপর বাজিগর হোক বা ডর ছবিতে একের পর এক অ্যান্টি হিরো চরিত্রে অভিনয়, তারপর সেই সিনেমা যা তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে, DDLJ। বলিউডে অনেক স্টার এসেছেন, গেছেন, কিন্তু রাজত্ব কায়েম করা এবং তাকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সকলের সাধ্যের ব্যাপার নয়। বাকিদের থেকে শাহরুখ খান যে কতটা এগিয়ে ছিলেন, সেটা বোঝা যায় তাঁর দূরদর্শিতা দেখে। অনেক আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রযুক্তি কতটা উন্নত হয়েছে এবং একটা সময় এই প্রযুক্তিই গ্রাস করবে সিনেমাকে। তাই আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে তিনি তৈরি করেন RA ONE সিনেমাটি। সেই সময় দুর্বল গল্প এবং ভিএফএক্সের জন্য ছবিটি মুখ থুবড়ে পড়লেও, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে ছবিটি ছিল অবশ্যই কিংবদন্তি।
চার বছর সিনেমা না করার পরেও তাঁর জন্য একই রকম উন্মাদনা রয়েছে। আজ যখন গোটা বলিউড ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে, সবাই তাকিয়ে রয়েছেন বাদশার দিকে, যদি পাঠান এবং জওয়ানের কাঁধে করে বৈতরণী পার করা যায়। শাহরুখের উদারতা নিয়ে নতুন করে কথা বলার অপেক্ষা থাকেনা। কামাল হাসানের সঙ্গে কাজ করার সময় তিনি কোনও পারিশ্রমিক নেননি বরং তার জায়গায় নিয়েছিলেন একটি ঘড়ি। যদিও সেটি কামাল হাসান নিজেই উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। খুব সাম্প্রতিককালে একটি ইন্টারভিউতে আর মাধবন বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য শাহরুখ খান কোনও পারিশ্রমিক নেন নি বরং নিজেই উৎসাহ দেখিয়ে কাজটা করেছিলেন। শাহরুখের বিষয়ে আরও একটি গুঞ্জন শোনা যায়, দেবদাস করার সময় শাহরুখ খান নাকি সেই সিনেমার পরিচালককে আর্থিক সহায়তা করেন, কারণ মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন নিয়ে পরিচালকের ঝামেলা শুরু হয়েছিল এবং শাহরুখ খানের সাহায্যে সেই আর্থিক সমস্যা দূর হয়।
হয়তো সলমান খানের মতো পাওয়ার প্যাক অ্যাকশন সিনেমা করতে পারেন না শাহরুখ, আমির খানের মতো ইন্টেলেকচুয়াল কমার্শিয়াল সিনেমা করার ক্ষমতাও তাঁর কম, অক্ষয় কুমারের মতো 'দেশপ্রেম' ফোটানো ভাব তাঁর আসেনা। তবে শাহরুখ যা পারেন তা হয়তো আর কারও পক্ষেই সম্ভব না। ২ নভেম্বর পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির এই মানুষের সারাদিন ব্যস্ত থাকার দিন। সারাদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা, ভক্তদের সঙ্গে দেখা করা, সব নিয়েই তিনি ব্যস্ত। কিন্তু দিনের শেষে নিজের ৫৭ তম জন্মদিনের অন্তিম কেক কেটে, ক্লান্ত শরীরকে নরম কোথাও এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে মনে মনে একবার নিশ্চয়ই বলবেন, 'পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত'।